অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট : সংবাদ অনলাইন

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

গত আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এটি নিজেকে একটি সংস্কারমুখী ও সুশাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রূপান্তরকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। কিন্তু এক বছরের কাছাকাছি সময় পেরিয়ে গেলেও দেশ এখন আরও গভীর অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিতÑযেখানে চরম অব্যবস্থাপনা, বেড়ে চলা বৈষম্য এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে নাগরিক কল্যাণের বিভেদ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। যা স্থিতিশীলতার সেতু হওয়ার কথা ছিল, তা এখন অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে পতনের রূপ নিচ্ছে।

জনগণের দুর্ভোগ এবং খালি প্রতিশ্রুতির ভার : প্রথমদিকে বলা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু দেশের কোটি কোটি মানুষ এখনো স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার মারাত্মক সংকটে ভুগছে। কোভিড-১৯ মহামারী এবং তার পরবর্তী সময়ে জীবনযাত্রার ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

বরং শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তরে অনেকেই যেন নিজেদের ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করতেই বেশি মনোযোগী। ফলে সাধারণ মানুষের কণ্ঠ এখন রাজনীতির চাতুর্যের আওয়াজে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

ক্ষমতার ছায়ায় দুর্নীতির বিস্তার : দুর্নীতি রোধ করার বদলে অন্তর্বর্তী প্রশাসন যেন তার পৃষ্ঠপোষকতাই করে চলেছে। আমলা, স্থানীয় নেতা ও শাসক দলের ঘনিষ্ঠরাÑরাজনৈতিক দায়মুক্তির সুযোগেÑরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। সরকারি অর্থের অপব্যবহার, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, এবং নিয়োগে অস্বচ্ছতা এই সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

এভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের যোগসাজশ তৈরি হয়েছেÑযেখানে এক দুর্নীতিবাজ আরেকজনকে রক্ষা করছে, বিনিময়ে পাচ্ছে আনুগত্য। এই জবাবদিহির অভাব শুধু জনগণের আস্থা ভঙ্গ করেনি, বরং আইন ও ন্যায়ের ভিত্তিক শাসনকেও দুর্বল করে ফেলেছে।

প্রতিশ্রুতির রাজনীতি অগ্রগতির নয় : গত দশ মাসে সরকার বারবার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, সেবা খাতে সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো কেবল কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাস্তব ও কার্যকর কোনো সংস্কার হয়নি। নতুন উদ্যোগ ঘোষণার সময় আড়ম্বর থাকলেও, বাস্তবায়নে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি।

এই দেখনদারির শাসনব্যবস্থাÑযেখানে প্রচারণা আছে, কিন্তু নীতিগত অঙ্গীকার নেইÑমানুষের মধ্যে ব্যাপক হতাশা তৈরি করেছে। এখন আর কেউ প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে না; মানুষ চায় দৃশ্যমান উন্নয়ন। পরিবর্তনের অভাবে, আশা রূপ নিচ্ছে নিরাশায়, নেতৃত্বের ওপর আস্থা প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যাচ্ছে।

বিশেষ সুবিধা, আনুগত্যের পুরস্কার ও গণতান্ত্রিক অবক্ষয় : যখন জনগণ মূল্যস্ফীতি, সেবার ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক স্থবিরতার বোঝা বইছিল, তখন ক্ষমতার ভেতরে গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠরা পেয়েছে নিয়োগ, চুক্তি ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। অন্তর্বর্তী নেতৃত্ব বলেছিল, তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন চালাবে, কিন্তু বাস্তবে তারা গড়ে তুলেছে এক সংকুচিত ক্ষমতাকেন্দ্র।

এই পক্ষপাতিত্ব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি দুর্বল করেছেÑপ্রতিরোধী কণ্ঠ ও নাগরিক অংশগ্রহণকে কোণঠাসা করে দিয়েছে। যে সরকার নিরপেক্ষ ও জনগণকেন্দ্রিক হওয়ার কথা ছিল, তা এখন একটি দলীয় স্বার্থকেন্দ্রিক যন্ত্রে পরিণত হয়েছেÑযেখানে নীতির বদলে বিশেষ সুবিধা আর মেধার বদলে আনুগত্য বেশি মূল্য পায়।

একজন আন্তর্জাতিক প্রতীক, কিন্তু স্থানীয়ভাবে অনুপস্থিত? : এই অন্তর্বর্তী সময়ের সঙ্গে যার নাম সবচেয়ে বেশি যুক্ত, তিনি হচ্ছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষুদ্রঋণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে তার বৈশ্বিক অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এই সরকারের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা দেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকের মতে, তিনি মূলত আন্তর্জাতিক ফোরাম, সম্মাননা ও মিডিয়া-চিত্রে ব্যস্ত থেকেছেনÑদেশের গ্রামীণ বাস্তবতায় তার সম্পৃক্ততা ছিল খুবই সীমিত।

সমালোচকরা মনে করেন, তার এই সংশ্লিষ্টতা বাস্তব সমস্যা সমাধানের চেয়ে ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড উন্নয়নের অংশ হিসেবেই কাজ করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতীকী শক্তি গ্রামীণ ক্ষমতায়নের হলেও, আজও দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের সঙ্গে তা বেমানান মনে হয়।

অনেক সাধারণ মানুষের চোখে ড. ইউনূস এক ধরনের দ্বৈততাÑবিশ্বমঞ্চে গরিবদের মুখপাত্র, অথচ বাস্তবে তাদের জীবন থেকে ক্রমেই দূরে চলে যাওয়া এক প্রতীক।

স্বচ্ছতা ও জনগণকেন্দ্রিক শাসনের এখনই সময় : অন্তর্বর্তী সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলÑঅখ-তা, নিরপেক্ষতা এবং সংস্কারÑতা আজ ভেঙে পড়েছে। জনগণের মধ্যে গভীর হতাশা তৈরি হয়েছে, আর এই শূন্যতায় বেড়ে উঠেছে দুর্নীতি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক লুটপাটের সংস্কৃতি। মানুষকে বলা হয়েছিল, তারা একটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থার অংশ; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক, অমানবিক এবং জনগণের কষ্টের প্রতি নির্লিপ্ত।

বাংলাদেশ যদি সামনে এগোতে চায়Ñগণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ, সামাজিক ন্যায় এবং জাতীয় ঐক্যের দিকেÑতবে জবাবদিহি এখনই শুরু করতে হবে। নেতৃত্বকে বিচার করতে হবে, তারা বিদেশে বক্তৃতা দিয়েছে কি না, তা দিয়ে নয়Ñবরং সাধারণ মানুষের জীবনে তারা কতটা বাস্তব উন্নয়ন এনেছে, তা দিয়েই।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন সাহসী আত্মসমালোচনা এবং সৎ পদক্ষেপ। আমাদের বেছে নিতে হবেÑক্ষমতা না কি নীতি, ব্যক্তিগত লাভ না কি জনকল্যাণ? এর চেয়ে কম কিছু হলে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অস্তিত্বকেই এক প্রতারণা বলে বিবেচনা করা হবে।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন ]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *