অন্তর্বর্তী মান-অভিমানে ইউনূস সরকারের এক বছর, প্রত্যাশা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন

Bangla Tribune

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্যান্টনমেন্টে একাধিক রাজনীতিক, নাগরিক সমাজের কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে বঙ্গভবনে নতুন সরকার নিয়ে ঐকমত্য হয় রাজনৈতিক দলগুলোর। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের আহ্বানে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রথম দিকে দেশের কয়েকজন প্রবীণ বুদ্ধিজীবী বিপ্লবী সরকার গঠনের পরামর্শ দিলেও বর্তমান সংবিধানের আলোকেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। সর্বোচ্চ আদালত থেকে আইনি অনুমোদন নিয়ে পথচলা শুরু করা অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ এক বছরে পড়েছে আজ শুক্রবার (৮ আগস্ট)।

এই এক বছরে মান-অভিমানের মধ্য দিয়ে চলেছে সরকার-রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক। কখনও প্রধান রাজনৈতিক পক্ষ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে দোটানা থাকলেও আবার কখনও সামনে এসেছে ইসলামপন্থি দলগুলোর অভিমান। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বছরপূর্তিতে (৫ আগস্ট) সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত জুলাই-ঘোষণাপত্র নিয়েও আপত্তি উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিরোধী জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ডান, বাম ও প্রগতিশীল দলগুলোর পক্ষ থেকেও নানামাত্রিক অভিযোগ এসেছে।

কোনও কোনও দলের পক্ষ থেকে রয়ে গেছে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত না আসার ক্ষোভ। এসব সত্ত্বেও দেশের রাজনীতিকরা এক বছরকে সাফল্যের সঙ্গে বিবেচনা করছেন। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমি সবসময় এবং অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করি। এজন্য করি— এ সরকার তো অনভিজ্ঞ সরকার।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘তারা এসে দায়িত্ব নেওয়ার পরে একটি ভঙ্গুর, ভাঙা একটা অর্থনীতি, ভঙ্গুর সমাজ এবং একটা রীতিমত সরকারহীন অবস্থায় দায়িত্ব নিয়েছে। সেই অবস্থায় তারা এসেছে, কাজ শুরু করেছে।’

‘অন্তর্বর্তী সরকার যে সময়ের প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নিয়েছে— তখন ছিল খুবই বিপর্যয়কর একটি পরিস্থিতি। দেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছানো এবং এতবড় গণহত‍্যার বিচার, ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় ব‍্যবস্থার সংস্কার ও একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বিরাট চ‍্যালেঞ্জ তাদের সামনে। সব প্রত‍্যাশার আলোকে সরকারের এক বছরের মূল‍্যায়ন তাই সহজ নয়।’ এভাবে মূল্যায়ন করছিলেন আমার বাংলাদেশ পাটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু।

গত বছরের ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের পর থেকে প্রথম দিকে বেশ কয়েকটি আন্দোলন-কর্মসূচির কবলে পড়েন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সচিবালয়ে আন্দোলন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিক্ষোভ, অটো-রিকশাচালকদের কর্মসূচিসহ ছোট-বড় অনেক বিক্ষোভ সামাল দিতে হয় সরকারকে।

এই বিক্ষোভের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে স্বয়ং জুলাই আন্দোলনে যুক্ত পক্ষগুলোর প্রতিবাদ। কখনও বিএনপির তরুণ নেতাদের লাগাতার কর্মসূচি, আবার কখনও জুলাই আন্দোলনের নেতাদের সমন্বয়ে সরকারি বাসভবন যমুনা ঘেরাও, কখনও জামায়াতের অবস্থান কর্মসূচির হুমকি বা সচিবালয়ে জাতীয়তাবাদী ঘরানার কর্মরত ও সাবেক সচিবদের কর্মসূচিতে বিব্রত হয়েছে সরকার।

সবচেয়ে বেশি দ্বিধায় ফেলেছিল চলতি বছরের মে মাসে। চট্টগ্রাম বন্দর, মিয়ানমারের সঙ্গে করিডরের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে যমুনার দূরত্ব তখন প্রকাশ্যে। স্বয়ং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে সংবাদ সম্মেলন করে সতর্ক করে দেন। এমন পরিস্থিতিতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দেখা করতে গেলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের কথাও তোলেন বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের। ওই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। নেতাদের উদ্দেশে তিনি উল্লেখ করেন, তারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি সাহস পান।

কয়েকটি ইসলামি দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বলছিলেন— এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের এসব চ্যালেঞ্জের কথা। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘সরকারের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পার করাই অনেক বড় ব্যাপার। নানা ঝুঁকি ছিল, নাশকতা আশঙ্কা ছিল, পরাজিত শক্তি, ভারতসহ বহুদিক থেকে যারা আমাদের পরিবর্তনকে মেনে নেয়নি। তাদের দিক থেকে তো কনস্ট্যান্ট একটা অস্থিতিশীলতা তৈরি করার তৎপরতা ছিল। সেটা মোকাবিলা করে এক বছর এ সরকারের পার করা— এটা এক ধরনের সাফল্য বলা যেতে পারে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব আকরাম হোসাইনের পর্যবেক্ষণ, ‘এই সরকারের এক বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলো— বিশেষত বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতসহ যত জুলাই আন্দোলনের যত শক্তি— সবাই এ জায়গায় বাংলাদেশে খুবই সহনশীল আচরণ করেছে। এই সরকারের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে— বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আনস্টেবল করতে দেয়নি।’

বিএনপি, এনসিপি, এবি পার্টি সরকারের এক বছরকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও কয়েকটি দলের অভিযোগও রয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পরস্পরবিরোধী অবস্থান বিরাজ করছে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুর ভাষ্য, ‘এই এক বছরে আমাদের দৃষ্টিতে সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার দিক হলো— গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর ঐক‍্য ধরে রাখতে না পারা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ধ্বসে পড়া নৈতিক মনোবল সুসংহত করতে না পারা। অন‍্যান‍্য প্রত‍্যাশিত বিষয়ে সন্তোষজনক জায়গায় না পৌঁছালেও এক বছরে বেশ সরকারের অগ্রগতি আছে বলে মনে করি— যা হয়তো আগামী তিন মাসে দৃশ্যমান হবে।’

রাজনৈতিক দলের মতো জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতারাও মনে করেন— জুলাই জুলাই আন্দোলনের শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে পারেনি সরকার। এ প্রসঙ্গে ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব ছাত্র সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আর কোনও ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেই অন্তর্বর্তী সরকার কোনও বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেনি। এতে করে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্ব সরকারকে দুর্বল করেছে।’

গত মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকালে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা। পাশাপাশি সেদিন রাতেই তিনি আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচনের অনুষ্ঠান করতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়ার কথা জানান। এই দুই বিষয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধিতামূলক অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

কোনও দলের অভিযোগ, জুলাই ঘোষণাপত্রে আন্দোলনের সক্রিয়দের কথা রাখা হয়নি। কেউ বলছে, আনুপাতিক হারে নির্বাচনের বিষয়ে সরকার কোনও অবস্থান ব্যক্ত করেনি। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় সনদে সই করা নিয়ে প্রভাব পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে অনেক রাজনীতিকের।

রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

গণফোরামের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন, সেটি একতরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট। এছাড়া এতে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার পাঠ করা জুলাই ঘোষণাপত্র, ‘ঘোষণার আয়োজন এবং একটিমাত্র দলের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা— সব কিছুই প্রমাণ করে, ইসলামপন্থিদের মতামত, আত্মত্যাগ ও সাংগঠনিক ভূমিকাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এটি শুধু দুঃখজনক নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অবহেলার শামিল।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্মমহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান চাওয়া সংস্কারের বিষয়ে কোনও সুরাহা এখনও হয় নাই। সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও জুলাই সনদ— যা জুলাই অভ্যুত্থানের আইনি রক্ষাকবচ, তা এখনও ঘোষণা করা হয় নাই। কবে নাগাদ তা করা হবে, তাও অনিশ্চিত হয়ে আছে।’

তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের প্রধান দাবি— স্বৈরতন্ত্রের পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে পরীক্ষিত পদ্ধতি নিম্নকক্ষে পিআর নিয়েও কোনও সিদ্ধান্ত হয় নাই। এমনকি এজেন্ডাও তোলা যায় নাই। সংস্কারকে এমন অসম্পন্ন ও অনিশ্চিত অবস্থায় রেখে সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।’

প্রত্যাশিত দিনে জুলাই  ঘোষণাপত্র ঘোষণা করায় সরকারকে ধন্যবাদ দিলেও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করিম চরমোনাই পীর বুধবার (৬ আগস্ট) সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে ৭১, ৭৫ এর ৭ নভেম্বর ও ৯০ এর আন্দোলনসহ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় ৪৭ এবং পতিত ফ্যাসিস্ট আমলের সবচেয়ে নির্মম শাপলা হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও আলেম-উলামাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ না করে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন মনে করে, এতে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।’

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা

এছাড়া গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকেও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। ঘোষণাপত্রের পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় সনদ নিয়েও কোনও কোনও দলে হতাশা কাজ করছে।

তবে রাজনীতিকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের বাইরে বাকি সব দলই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে। ফলে কখনও বিরোধিতা, মান-অভিমান তৈরি হলেও আদতে তা ‘অন্তর্বর্তী’। জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ‘অন্তর্বর্তীই’ থাকবে। সরকারের পক্ষে থেকেই পরবর্তী সরকারের পথে থাকবে এসব রাজনৈতিক দলগুলো।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় কোনও মান-অভিমান হয়নি। আমরা যেখানে প্রয়োজন মনে করেছি স্ট্রেইট বলেছি, যেখানে ভুল হয়েছে, উল্লেখ করেছি। এই সরকার তো থাকছে না, কোনও দলও করছে না। তারা তো কোনও দল করবে না। ফলে এসব কিছু আমি ‘অন্তর্বর্তী’ হিসেবেই দেখি। তারা তো পরের সরকার হবে না। একটা ভালো, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিয়ে যাক।’

‘বড় সংস্কার না হলেও হুলস্থূলের কিছু নেই। অসমাপ্ত কাজগুলো তো পরের সরকার করবে। তারা যা সম্ভব তা এখন করবে।’ বলে মনে করেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না।

বদরুদ্দীন উমর নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশ বা সমাজের কোনও মৌলিক পরিবর্তন আনতে হলে বা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে হলে— শ্রমিক কৃষকসহ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী জনগণের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজন।’

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এনসিপির প্রতিনিধি দল

‘যে গণঅভ্যুত্থানের  লক্ষ্য হবে— লুটেরা সন্ত্রাসী দুর্নীতিবাজ শাসক শ্রেণির বিদ্যমান শাসন উচ্ছেদ করে, সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করে বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার গঠনের মাধ্যমে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনা। জনগণের সরকার সংবিধান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়া।’ বলে মনে করেন ফয়জুল হাকিম।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা রাজনৈতিক দলগুলোর

প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) জাতির উদ্দেশে নেওয়া ভাষণে। তার বক্তব্যে মূলত গত ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বহুল আলোচিত বৈঠকের পর যৌথ প্রেসনোটের প্রতিফলন এসেছে। যদিও কারও কারও ভাষ্য— এই সরকার গঠনের পর গত বছরে আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমে সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের যে প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানও সেই পরামর্শকে আমলে নিয়েছেন।

নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন, এবার সবাই ভোট দেবে। কেউ বাদ যাবে না। যদিও রাজনীতিতে বিগত ১৬ বছরের শাসক দল আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হতে পারে, এ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। দৃশ্যত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার, সংস্কারের কথা বলা হলেও ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনও নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাদ যাবে কিনা, দেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এই প্রশ্ন নেতাদের মধ্যেও রয়েছে। আর এর সঙ্গে রয়েছে নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য আশঙ্কা, যা আগামী নভেম্বর-নাগাদ প্রকাশ্যে আসতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বিএনপিসহ একাধিক দলের সিনিয়র নেতা।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কারণ, দেশবাসী মনে করে— ইতোমধ্যে এই সরকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, সেটিও জানতে চাই।’

লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা

প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, ‘এই সরকারের দায়িত্ব ভার শেষ হবে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। তারা যদি সবার অংশগ্রহণে প্রশ্নমুক্ত ও অবিতর্কিত একটি নির্বাচন দিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে— সেটা হবে তাদের বড় সাফল‍্য। নির্বাচন নিয়ে এখনও অনেক সংকট আছে বলে মনে করি।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বিগত জুলাই-আগস্টে তঃকালীন সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আন্দোলনকারীদের গুলি করার বিষয়ে বিবরণী দিলেও সংস্থাটি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে। যদিও এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনেও বিকল্প ভাবনার সুযোগ কম। বিশেষত, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার সব ধরনের চেষ্টা করা হবে, বলে জানান একাধিক দলের প্রধান।

তবে কোনও কোনও রাজনীতিক মনে করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বর্তমান জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহতদের বিচারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে রায় আসার পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে যারা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায়— এটাকে একটি ইস্যু হিসেবে তাদের সামনে আনবে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা। আগে যেমন বিরোধীরা একটা কনটেক্সটে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, এখন এই সরকারই  আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্রদেরকে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখছে। এখন হয়তো বিদ্যমান দলগুলো এর কিছু সুবিধা পেতে পারে, যেহেতু বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী নেই মাঠে।’

‘তবে বাংলাদেশের একটা স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনীতির জন্য এটা বড় ধরনের দুর্বলতা— একটা বিশাল সংকট হিসেবে থেকে যাচ্ছে। ফলে সেই জায়গাটা থেকে এবং নির্বাচনন এগিয়ে আসলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে যদি কোনও সুযোগ না পায়, এমনকি আওয়ামী লীগ নামে যারা কাজ করতে চান, তাহলে তাদের তরফে বহুমাত্রিক নাশকতা তৈরি করার একটা আশঙ্কা আছে।’ উল্লেখ করেন সাইফুল হক।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা

যদিও মজিবুর রহমান মঞ্জু অবশ্যই আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনও সুযোগই দেখেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের নেতাদের ব‍্যক্তিগত ও তাদের দলগত অপরাধের যথাযথ বিচার চাই। আওয়ামী লীগকে আমরা রাজনৈতিক দল মনে করি না। তাদের সহায়তায় সংঘটিতত গুম, খুন, সন্ত্রাস, গণহত্যা, দুর্নীতি ও লুটপাট প্রমাণ করে তারা একটি সন্ত্রাসবাদী দল। তারা দেশের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রু।’

‘অতএব নির্বাচন তো দূরের কথা, তারা যদি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আত্মসমর্পণ পূর্বক  নিজেদের সংশোধন ও নীতি পরিবর্তন না করে, তাহলে আমরা আওয়ামী লীগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করার পক্ষে।’ উল্লেখ করেন মজিবুর রহমান। তার ভাষ্য, ‘আমরা আহ্বান করবো— যেসব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী তাদের দলের গুম, খুন, দুর্নীতি ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে সমর্থন করেন না, তারা যেন দলত‍্যাগ করে গণতন্ত্রের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানান। তারা যাতে রিকনসিলেশন প্রসেসের মধ‍্য দিয়ে ন‍্যায়নিষ্ঠ পথে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।’

এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘স্বৈরাচারি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। ফলে এ সিদ্ধান্ত এখন নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ওপর নির্ভরশীল।’

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *