অবহেলায় পড়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী

Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল

বন্দরনগরী থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দুই পার্বত্য জেলা সংযোগ পথ চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি মহাসড়কের পাশঘেঁষা হাটহাজারীর উত্তর ফতেয়াবাদ নন্দীরহাট গ্রামটি লোকমুখে ‘মন্দিরের গ্রাম’ হিসাবে খ্যাত। এই গ্রামে নান্দনিক সৌন্দর্য-স্থাপত্যশৈলীর বাড়িটি একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক ও সুরকার সত্য সাহার বাড়ি হিসাবেও বেশ পরিচিত। যদিও এটি দলিল-দস্তাবেজে লক্ষ্মীচরণ সাহার জমিদার বাড়ির নাম উল্লেখ রয়েছে।

সত্য সাহার ঐতিহ্যবাহী এই জমিদার বাড়িটিতে আগের সেই জৌলুস নেই। প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে পুরোনো এই বাড়িটি হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য ও গৌরব। বর্তমানে চরম অযত্ন ও অবহেলায় শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ৫ একর জায়গার ওপর ১৮৯০ সালে দুই গম্বুজবিশিষ্ট এ জমিদার বাড়িটি তৎকালীন জমিদার শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহা নির্মাণ করেছিলেন। জমিদার লক্ষ্মীচরণ সাহা, মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহা এ জমিদারির সূচনা করেন। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জমিদারি দেখাশোনা করেন লক্ষ্মীচরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন সাহা। ১৯৩৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সত্য সাহার জন্ম হয় এ জমিদার বংশে। ১৯৪৬-৪৮ মাঝামাঝি সময়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৫১ ও ১৯৫২ সালে কলকাতার একটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। সত্য সাহারা ছিলেন ১২ ভাই। এ বাড়িতে প্রায় ১০০ কর্মচারী ছিল।

জমিদারি আমলে ওই বাড়িতে গড়ে তোলা হয় আকর্ষণীয় দ্বিতল-ত্রিতল দালানকোঠা ও বাগানবাড়ি। এখানকার সারিবদ্ধ দালানকোঠা ও পূজামণ্ডপ আজও মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। বাড়িটির চারদিকে রয়েছে ফসলি জমি, গাছগাছালি ও তিনটি পুকুর। এছাড়াও আছে একটি দোতলা কাচারিঘর, একটি বিগ্রহ মন্দির ও দুটি বাসভবন। দৃষ্টিনন্দন এ জমিদার বাড়িটি কালের প্রবাহে জরাজীর্ণ হলেও এর ভাবগম্ভীর ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য এখনো বিদ্যমান। জমিদার ভবনের দেওয়াল ও কার্নিশগুলো নানা কারুকাজে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। কাঠের ছাদের বাড়িটির দুই পাশে আছে দুটি গম্বুজ।

ঐতিহাসিক এ বাড়িটিতে একসময় সিনেমার শুটিংও হয়েছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক ও সুরকার সত্য সাহার প্রযোজনায় ১৯৭৫ সালে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার দৃশ্য ধারণ করা হয় এই বাড়িতে। যদিও এর আগে ১৯৫৫ সালে সত্য সাহার প্রথম ছবি ‘সুতরাং’ দিয়ে সংগীতশিল্পী হিসাবে যাত্রা শুরু করেন তিনি। সুতরাং ছবিটি এই জমিদারবাড়িতে ১৮ দিনে শুটিং শেষ করেছিলেন তিনি।

১৯৯৯ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্তমানে সত্য সাহার দুই ছেলে বড় ছেলে সুমন সাহা এবং ছোট ছেলে ইমন সাহা সংগীত শিল্পী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে জমিদারবাড়িটি বর্তমানে দেখাশোনা করেন জমিদারের বংশধর সাবেক কাস্টমস অফিসার ননী গোপাল সাহা ও রাঙামাটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বপন কুমার সাহা। দুজনে জানান, এই বাড়ির ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা।

স্থানীয় বাসিন্দা সুমন গোস্বামী বলেন, ঐতিহাসিক ও পুরাকীর্তির প্রাচীন নন্দীরহাট গ্রামে ব্রিটিশ আমলে এই গ্রামে বেশ কয়েকজন জমিদার বাস করতেন। জমিদারদের রাজবাড়ির পাশাপাশি ছিল তাদের তৈরি রাধাকৃষ্ণ মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, দুর্গা মন্দির। সারা বছর নানা অনুষ্ঠান হয় এই মন্দিরে। সে কারণেই এ গ্রামকে মন্দিরের গ্রাম হিসাবে অভিহিত করা হয়। আর এ নন্দীরহাট গ্রামের একটি ঐতিহাসিক জমিদারবাড়ি লক্ষ্মীচরণ সাহার জমিদার বাড়ি।

তিনি আরও জানান, সপ্তদশ শতাব্দীতে এই জমিদারদের গোড়াপত্তন হয়। জমিদার লক্ষ্মীচরণ এবং তার দুই ভাই মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহা মিলে এই এলাকায় জমিদারি চালু করেছিলেন। ওই সময় এই জমিদারবাড়ির অনেক জৌলুস ছিল। তবে ১৯৫০ সালের দিকে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পর থেকে ওই বাড়িতে পূর্বের জৌলুস না থাকলেও নির্মিত পুরাকীর্তি, মন্দির ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির সৌন্দর্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেইসব দিনের ইতিহাস, ঐতিহ্য-নিদর্শন বহনকারী জমিদার বাড়িটি বর্তমানে অবহেলার পড়ে আছে। পুরোনো এই বাড়িটি প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ধ্বংসের মুখোমুখি।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *