অভিবাসন খাতের বার্তা অস্পষ্ট

Google Alert – প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফর

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১১ থেকে ১৩ আগস্ট মালয়েশিয়া সফর করেন। এই সফরে দুপক্ষের মধ্যে শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, জ্বালানিসহ একাধিক খাতে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সমাঝোতা ও নোট বিনিময় হয়েছে। কিন্তু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসন নিয়ে এই সফরে পরিষ্কার কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। জনশক্তি খাতের সিন্ডিকেট রুখে দিতে এই সফরে কোনো পক্ষ থেকেই শক্ত কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। এই ইস্যুতে হতাশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় গত মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে জিটুজি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে দক্ষ পেশাজীবী নেওয়া ও অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার আহ্বান জানানো হয়। এই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম নেতৃত্ব দেন। 

বৈঠকে দুই দেশের সরকারপ্রধান বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সম্পর্ককে গভীর, ভবিষ্যৎমুখী কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে দুই দেশের সরকারপ্রধান মঙ্গলবার সকালে প্রথমে একান্তে বৈঠক করেন। তার আগে বাছাই করা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি সীমিত পর্যায়ের বৈঠক হয়। পরে তারা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অভিবাসন, জ্বালানি সহযোগিতা, ব্লু ইকোনমি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক করেন। 

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ইতিহাস, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সহমর্মিতার গভীর বন্ধন। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম প্রফেসর ইউনূসকে ‘মালয়েশিয়ার বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি অভিবাসী শ্রমিক কল্যাণ, শিক্ষা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের প্রচেষ্টায় বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। একান্ত বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস অত্যন্ত সহজভাবে বাংলাদেশ থেকে যেতে না পারা প্রায় আট হাজার বাংলাদেশি কর্মীকে সেই দেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া এবং মাল্টিপল-এন্ট্রি ভিসা চালু, শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি না নিয়ে দেশে ফেরার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মালয়েশিয়াকে ধন্যবাদ জানান। উভয় পক্ষই অভিবাসন ব্যয় হ্রাস এবং শ্রমিক কল্যাণে স্বচ্ছ ও ন্যায্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব দেন।

প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মালয়েশিয়াকে জিটুজি কাঠামোর মাধ্যমে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীসহ আরও দক্ষ বাংলাদেশি পেশাজীবী নিয়োগের আহ্বান জানান। 

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা বোয়েসেল এখন মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলোতে কর্মী পাঠাতে সক্ষম উল্লেখ করে তিনি বাংলাদেশি নিরাপত্তারক্ষী ও কেয়ার গিভার নিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত বা কাগজপত্রহীন বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়মিতকরণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান। মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, বাংলাদেশি কর্মীরা এখন মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের মতো একই সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাবেন এবং বাংলা ভাষায় অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্যপরিষদের সভাপতি টিপু সুলতান দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সদ্য সমাপ্ত সফর থেকে রেমিট্যান্সযোদ্ধা বা মালয়েশিয়ায় নতুন করে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বার্তা পাইনি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানি স্থগিতের বিষয়টি প্রত্যাহার করা হবে এবং স্বচ্ছভাবে কর্মী প্রেরণের বিষয়ে পরিষ্কার বার্তা পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট পাওয়া যায়নি। আমরা যতটুকু জানি যে মালয়েশিয়ায় বোয়েসেলসের (বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লি.) মাধ্যমে অল্প কিছু কর্মী পাঠানোর চাহিদা পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের যতগুলো রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে তারা সবাই সামনের দিনে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারবে কি না-তা এখনও পরিষ্কার না। প্রধান উপদেষ্টার এই সফরে মালয়েশিয়ার সঙ্গে জনশক্তি খাত ইস্যুতে নতুন করে কোনো সমাঝোতা স্মারক বা চুক্তি হয়নি। ফলে অভিবাসন খাতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে থাকা আগের সমাঝোতা স্মারক বা চুক্তিই এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে। কিন্তু আগের সমাঝোতা অনুযায়ী মালয়েশিয়ার সিলেকটেড রিক্রুটিং এজেন্সিই কর্মী পাঠাতে পারবে। আর শুধু সিলেকটেড রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর অনুমতি পেলে আবারও এই বাজার দুর্নীতির শিকার হবে। কিন্তু বায়রার সব সদস্যের প্রত্যাশা, অতীতে যাই ঘটুক না কেন ভবিষ্যতে সবাই এই বাজারে বৈষম্যহীনভাবে কর্মী পাঠাতে পারবে, প্রধান উপদেষ্টার সফর থেকে এমন পরিষ্কার ঘোষণা আসেনি।

সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারপারসন এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এসএম সেকিল চৌধুরী বলেন, মালয়েশিয়া আমাদের অনেক পুরোনো বন্ধুদেশ। অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর একজন ভালো বন্ধু। প্রধান উপদেষ্টার সদ্য সমাপ্ত মালয়েশিয়া সফর আমাদের কনফিডেন্স বাড়িয়ে দিয়েছে। আশা করছি, সামনের দিনে দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অন্যতম জনশক্তি রফতানির গন্তব্য। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই বাজার নিয়ে আমরা অনেক মিসইউজ করেছি। মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীরাও অনেক মিসইউজ করেছে। এই খাতে সিন্ডিকেটের বিষয়টি সবাই জানেন।

আমাদের প্রত্যাশা যে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সফর এই সিন্ডিকেট বাণিজ্য দূর করতে দৃঢ় ভূমিকা রাখবে কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছি না। কারণ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই বিশাল বিত্তবান। দুটি সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা থাকলেই এই সমস্যা দূর করা সম্ভব। আবার এই প্রক্রিয়ায় সরকারের সঙ্গে অনেক ধরন বা স্তরের যোগাযোগ রয়েছে। যেখানে যেকোনো একটা স্তরকে বাগে আনতে পারলেই অনেক কিছু করা সম্ভব হয়।

আমাদের প্রত্যাশা যে দুই দেশের সরকারই সক্রিয় থাকবে, যাতে এই খাতে সিন্ডিকেটের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। কিন্তু ঘটবে না এটা বলতে পারছি না। কেননা, এসব নিরসনের জন্য শক্ত হাতে দমন করতে হবে। সামনের দিনগুলো বলে দিবে যে আসলেই এই খাতে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসবে কি না। কেননা দেখতে পাচ্ছি, এই বাজার থেকে আগের মতো পয়সা বাগিয়ে নিতে দুই দেশেরই সংশ্লিষ্ট লোকরা প্রচুর অর্থ খরচ করছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর সময়ের আলোক বলেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে, উভয়েই ভালো বন্ধু। এই সফরে অভিবাসন খাত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কিন্তু মনে হয়েছে, এই সফরে আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি বা ফলোআপ কম ছিল। প্রেস সচিব সফরের আগে অভিবাসন খাতকে গুরুত্বপূর্ণ বলেছিলেন কিন্তু সফর শেষে উল্লেখ করার মতো কিছু পেলাম না। অভিবাসন খাত নিয়ে ওভার অল আলাপ হয়েছে কিন্তু অভিবাসন খাতের সংকট বা সমস্যাগুলো নিরসনের জন্য পরিষ্কার কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। এই খাতের জটিলতা নিরসনে কোনো ফলোআপ নাই।

এর মধ্যে একটা বিষয় খুব চোখে লাগার মতো যে অতি সম্প্রতি একাধিকবার দেখা গেছে যে অনেককেই মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন থেকেই দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তারা বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পরই মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন ফেস করছে। তাহলে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ওই লোকদের না আটকালে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ফেরত দিচ্ছে কেন? এখানে বাংলাদেশ অথবা মালয়েশিয়া কোনো এক দেশের ইমিগ্রেশনের সমস্যা আছে। এসব বিষয়ে দুই দেশের ইমিগ্রেশন বা সংশ্লিষ্টদের বা দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলাপ হওয়া প্রয়োজন। মালয়েশিয়ায় আমাদের কিছু বাংলাদেশি জঙ্গি অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে এবং সেখানে তাদের বিচার চলছে। জঙ্গি ইস্যুতে সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের তৎপরতা প্রয়োজন। অভিবাসন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ রয়েছে এবং তারা বৈঠকও করে কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যা জিইয়ে রেখে ভালো কিছু করা সম্ভব না। প্রধান উপদেষ্টার সফরে এসব বিষয়ে কিছু দেখিনি। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে যে সিন্ডিকেট প্রথা রয়েছে, সে বিষয়ে আগের সরকার কিছুই করতে পারেনি। এবার প্রধান উপদেষ্টার সফরেও এই বিষয়ে সরাসরি কিছু দেখিনি। অর্ন্তবর্তী সরকার ভেতরে ভেতরে কিছু করে থাকতে পারে, তা জানি না। কিন্তু সিন্ডিকেট ইস্যুতে কিছু হয়েছে বা করেছে এমন কিছু দেখিনি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে দুই পক্ষের মধ্যে ৫টি সমাঝোতা স্মারক সই এবং ৩টি নোট বিনিময় হয়েছে, যা ‍দুই পক্ষের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে ভালো হবে। এর বাইরে এই সফর থেকে একটা ভালো সংবাদ পেয়েছি যে এই প্রথম রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর জোট) ৩টি দেশের প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফর করবে। এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কেননা, এর আগে ওই অঞ্চলের আঞ্চলিক সংগঠন বা আসিয়ান রোহিঙ্গা ইস্যু কোনো পাত্তা দিত না। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা নিজেরা হোমওয়ার্ক করছি না। গত সরকারের আমলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো হোমওয়ার্ক হয়নি। এবার খলীলুর রহমানকে এই দায়িত্ব দেওয়ার পর কিছু হওয়ার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য কিছু দেখিনি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মালয়েশিয়া আমাদের জনশক্তি রফতানির অনেক বড় খাত, সেখানে অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু সফরে এই খাত নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেখলাম না। এই শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক আলাপ আছে কিন্তু এই সফরে এই বিষয়ে কিছুই চোখে পড়ল না। 

এমএইচ

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *