Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল
রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য অঞ্চলে আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রায়ই গোলাগলির ঘটনা ঘটছে। ফলে পার্বত্যাঞ্চলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় জেলা রাঙ্গামাটি। এখানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ নাগরিক সুযোগ-সবিধা এবং পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সম্পর্কসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকার দেন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ (মারুফ)। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের নয়া দিগন্তের সিনিয়র রিপোর্টার এস এম মিন্টু হোসেন।
নয়া দিগন্ত : আগে যে রকম আঞ্চলিক সশস্ত্রবাহিনীর ভয়ঙ্কর তৎপরতার কথা শুনতাম বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন?
ডিসি : আপনাকে ধন্যবাদ। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এখানে বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রুপের কিছু সন্ত্রাসী কার্যক্রম থাকলেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ পুলিশ বিভাগ ও প্রশাসন আমাদের সবার সমন্বয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণেই আছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপের তৎপরতা বেড়েছে বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য পাচ্ছি। তবে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীসহ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার কারণে সেটা জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে খারাপ করতে পারেনি। বিশেষ করে এখানে আমরা কিছু চাঁদাবাজির অভিযোগ পেয়ে থাকি। যখন যেখানে অভিযোগ পাই তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎপরতার কারণে এখানে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি।
নয়া দিগন্ত : আপনি বলছিলেন যে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। এই সন্ত্রাসী গ্রুপ কারা?
ডিসি : এখানে কিছু আঞ্চলিক গ্রুপ আছে যারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে থাকে। যেহেতু তারা প্রকাশ্যে আসে না, তাদের বিষয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির কোনো তথ্য নাই। তারা বিভিন্ন ছদ্মনামে কার্যক্রম চালায়। সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে অভিযোগ যখনই আসে সেগুলো আমরা ক্ষতিয়ে দেখি। এই মূলত চাঁদাবাজির জন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে আসছে।
নয়া দিগন্ত : এখানে কোন সংগঠনগুলোর নামের কথা শোনা যায়?
ডিসি : যেটা আমরা জেনে থাকি তাতে দেখা যায় আঞ্চলিক দলগুলোর দু’টি বড় দল আছে। অন্যান্য কিছু দলেরও নাম আমরা শুনে থাকি। তবে তাদের কোনো প্রকাশ্য কার্যক্রম নেই। তাদের কোনো নাম-ঠিকানা অফিশিয়ালি জানার সুযোগ নেই।
নয়া দিগন্ত : চাঁদাবাজি বলতে কী ধরনের চাঁদাবাজি?
ডিসি : বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চাঁদাবাজি হয় বলে মাঝেমধ্যে আমরা অভিযোগ পাই। যখনই অভিযোগ পাই তখনই আমরা সেগুলো প্রতিহত করার। তবে চাঁদাবাজ ওরকম কোনো প্রকাশ্যে কেউ আসছে না। আপনারা জেনে থাকবেন যে, সীমান্ত সড়ক নির্মাণসহ সরকারের বিভিন্ন নিয়মিত কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এটা একটা পার্বত্য জেলা বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি সাহায্য সহযোগিতাগুলো পৌঁছানো একটু কঠিন। আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ সেক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তা নিচ্ছি এবং সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সহায়তা নিচ্ছি। আপনারা জেনেছেন, কোনো কোনো জায়গা এমনও দুর্গম এলাকা আছে, যেখানে সাহায্য পৌঁছানোর জন্য তিন দিন লাগে। একজন পোর্টারকে আমরা হায়ার করি তার মাধ্যমে তিন দিন হেঁটে ত্রাণগুলো পৌঁছাতে হয়।
নয়া দিগন্ত : দুর্গমতা কাটানোর জন্য আপনারা কী করছেন?
ডিসি : দুর্গমতা কাটানোর জন্য সরকার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে। যাতে আমাদের গ্রোথ সেন্টারগুলো আমাদের সাথে ওয়েল কানেক্টেড হয়। আপনারা জেনে খুশি হবেন সরকার আরেকটি প্রজেক্ট এখানে নিয়েছে। সেটা হচ্ছে পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলায় চারটি উপজেলা রয়েছে যেগুলোর মূল যোগাযোগ হচ্ছে নৌপথে অর্থাৎ কাপ্তাই লেকের মাধ্যমে। সেই কাপ্তাই লেকটাকে ড্রেজিং করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, এটা ড্রেজিং করলে যোগাযোগ সহজ হবে। এ কারণে এখানে শুষ্ক মৌসুমে পানি যখন কমে যায় তিন চারটি উপজেলা আছে যেগুলো অনেকটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই উপজেলাগুলোর সাথে আমাদের সারা বছর নৌ যোগাযোগ থাকবে। পাশাপাশি যদি নদীর তলদেশটাকে ড্রেজিং করতে পারি তাহলে দুই পাশে যে কৃষিজমি আছে শুষ্ক মৌসুমে সেসব কৃষির আওতায় চলে আসবে।
নয়া দিগন্ত : সিএনজি চালকরা সন্ধ্যার আগে শহরের বাইরে যেতে পারছে না, ছাত্ররা বলছেন পুলিশ আসলে অনেক জায়গায় তৎপরতা দেখাচ্ছে না। তাদের ডেকে পাওয়া যায় না। তারা কাউকে গ্রেফতারও করছে না। এই বিষয়টি আপনি জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কিভাবে দেখছেন?
ডিসি : ছাত্ররা দাবি তুলেছিল, তাদের ক্যাম্পাসের আশপাশের হলগুলো দ্রুত সম্ভব চালু করা। রাঙ্গামাটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অনেক ডেভেলপমেন্ট কার্যক্রম চলছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে অনেক সমস্যাই দূর হবে। এখানে যখনই কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ আমরা পাচ্ছি সেখানে পুলিশ সাথে সাথে রেসপন্স করছে। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী যারা আছে বিশেষ করে তিন পার্বত্য জেলার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনী ভূমিকা পালন করছে।
নয়া দিগন্ত : পাহাড়ে একটা বিতর্ক রয়েছে আদিবাসী শব্দটা নিয়ে। আমাদের সংবিধানে আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবস কেন্দ্র করে এখনো যে দ্বন্দ্ব শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন আপনারা কিভাবে সমাধান করবেন?
ডিসি : আসলে জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি শুধু জেলার আইনশৃঙ্খলাটা দেখি। আপনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন সেগুলো আরো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। অথবা সংবিধানে এবং দেশের আইনে যেটা রয়েছে এটাই আমাদের আনুষ্ঠানিক এবং দাফতরিক অবস্থান। এর বাইরে আসলে জেলা প্রশাসক হিসেবে আমার কর্মপরিধির আওতায় পড়ে না বলে মনে হয়েছে।
নয়া দিগন্ত : এখানে বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপ নিজেদের মধ্যে অনেক সময় সঙ্ঘাত জড়িয়ে পড়ে। এটা এই পার্বত্য এলাকার মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ?
ডিসি : যেকোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম কর্মকাণ্ড ওই এলাকার মানুষের জন্য অবশ্যই দুঃখজনক ঘটনা। বিশেষ করে আমরা যারা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করি আমাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা থাকে, যেকোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম সেটা যে নামেই হোক বা উপদলে করে থাকুক তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। কোনোভাবেই যাতে জনগণের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট না হয়। সেটাই আমরা মূলত নিশ্চিত করে থাকি। দল-উপদলগুলো আমরা দেখে থাকি আপনাদের রিপোর্টের মাধ্যমে। আমাদের গুরুত্ব থাকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম যেই করবে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসাটাই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য এবং আমরা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে কার্যক্রম চালিয়ে থাকি।
নয়া দিগন্ত : পাহাড়ি বাঙালি অনেক সময় দেখা যায় সঙ্ঘাতে জড়ায়। এই কারণে মাঝে মাঝে পাহাড় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সেই জায়গাটাতে আপনারা কী করছেন?
ডিসি : জনপ্রশাসনের অংশ হিসেবে আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে সকল মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা করা। প্রায় ১২ থেকে ১৪টি জনগোষ্ঠীর বসবাস এখানে। আমরা জেলা প্রশাসন থেকে সবসময় চেষ্টা করে থাকি সব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করার জন্য। বিগত বিজু উৎসবের সময় আমরা এখানকার প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাথে মতবিনিময় করেছি এবং বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে যে বিভিন্ন ধরনের জনগোষ্ঠী রয়েছে সেটাকে অটুট রাখা। সেটাকে আরো দৃঢ় করার জন্য আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম করে থাকি। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ছাড়াও আমরা মত বিনিময় করে থাকি, আন্তঃজনগোষ্ঠী বিভিন্ন রকমের ডায়লগ বা সংলাপ করার চেষ্টা করে থাকি। আমাদের বিভিন্ন কমিটি যখন হয় চেষ্টা করি সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যাতে সরকারি কর্মকাণ্ডে থাকে। জেলা প্রশাসন তার সকল কর্মকাণ্ডে এখানকার মানুষের মধ্যে যে সম্প্রীতি রয়েছেন, যে ইতিহাস রয়েছে সেটাকে আরো দৃঢ় করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকি।