আতঙ্ক কাটছে, ফিরছে স্বাভাবিক জীবন

Google Alert – সেনাবাহিনী

সরকার মাজহারুল মান্নান রংপুর ব্যুরো

রংপুরের গঙ্গাচড়ার আলদাদপুরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে নিয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্টকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতার পর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পল্লীর ঘরবাড়ি দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। এরইমধ্যে বহু পরিবার নিজ বাড়িতে ফিরেছে, কাজেও সহযোগিতা করছেন ক্ষতিগ্রস্তরাই। আতঙ্ক কাটতে শুরু করেছে এলাকাজুড়ে।

গতকাল মঙ্গলবার ২৯ জুলাই সকাল ৯টায় বেতগাড়ি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ছয়আনি বালাপাড়ায় সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঘর মেরামতের কাজ চলছে পুরোদমে। সরকারি টিন, শ্রমিক ও নির্মাণ খরচে চলছে টিনের বেড়া ও ছাদ লাগানোর কাজ। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুল হাসান মৃধা নিজেই কাজের তদারক করছেন, প্রতিটি পরিবারের সাথে কথা বলে তাদের সাহস জোগাচ্ছেন।

ইউএনও জানান, হামলায় ২২টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে ৫-৬টি সম্পূর্ণভাবে। বাকিগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যেই সব ঘর ঠিক করা হবে। একটি পরিবার টিউবওয়েলের অনুপস্থিতির কথা জানিয়েছে, সেটিও বসানো হবে, জানান তিনি।

ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতি

প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী, ধরণীকান্ত রায়ের চারটি ঘর, ধনঞ্জয় রায়ের দু’টি ঘর ও আসবাবপত্র, সুশান্ত চন্দ্রের ঘর ও টিভি, সুবল চন্দ্রের চাল ও আসবাব, মনোরঞ্জনের আধাপাকা ভবনের জানালা-গেট, কেশব চন্দ্রের পাকা বাড়ির দেয়ালসহ আসবাবপত্র সবই হামলার শিকার। জয় চাঁদ, সুজন চন্দ্র, লাল মন, অবিনাশ, বিনয় মহন্তের ঘরগুলোও আক্রান্ত হয়।

একাধিক পরিবার সোনার অলঙ্কার, নগদ টাকা এবং খাসি লুট হওয়ার অভিযোগ করেছে। প্রমোদ মহন্তের আলমিরা ভেঙে নেয়া হয়েছে ৩০ হাজার টাকা ও এক ভরি সোনা।

হামলা ও প্রশাসনের পদক্ষেপ

শনিবার ২৬ জুলাই মহানবী ও ইসলাম সম্পর্কে ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট দেয়ার অভিযোগে রঞ্জন রায়কে গ্রেফতার করা হয়। এরপর একদল দুর্বৃত্ত তার চাচার বাড়িতে হামলা চালায়।

রোববার (২৭ জুলাই) বিকেলে পাশের কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা উগ্র জনতা আলদাদপুর হিন্দুপল্লীতে হামলা চালায়। পুলিশের উপস্থিতিতেও তারা হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। পরে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

রোববার রাতে ও সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সালের নেতৃত্বে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেখানে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের দাবি জানানো হয়, যা প্রশাসন বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছেন ডিসি।

সম্প্রীতির বার্তা

হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন। স্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও প্রতিবেশীরা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ধরণী মহন্ত বলেন, ডিসি স্যার রাতে এসে আমাদের সাহস দিয়েছেন। এখন আতঙ্ক কিছুটা কমেছে। ধনঞ্জয় রায় জানান, হামলাকারীরা আমাদের এলাকার লোক নয়, পাশের উপজেলা থেকে এসেছে। প্রশাসনের সহায়তায় আমরা আবার ঘরবাড়ি ঠিক করছি।

পুরোহিত বলরাম সাধু বলেন, শনিবার রাতে সেনাবাহিনী থাকায় হামলা ঠেকানো গিয়েছিল, কিন্তু তারা রোববার সকালে চলে যাওয়ায় দুর্বৃত্তরা সুযোগ নেয়। এই ভুল আর যেন না হয়।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা আহ্বায়ক তপন কুমার রায় বলেন, রোববার সেনাবাহিনী থাকলে এমন ঘটনা হতো না। তবে পরবর্তী পদক্ষেপে আমরা সন্তুষ্ট। প্রশাসনের সহায়তায় সবাই নিজ ঘরে ফিরেছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আইনশৃঙ্খলা

রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু বলেন, এই হামলা পরিকল্পিত। পাশের উপজেলা থেকে লোক এনে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। এর সাথে শাসক দলের কিছু লোকও জড়িত, তদন্ত হওয়া উচিত।

রংপুরের ডিসি বলেন, প্রত্যেকটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তৎপর।

রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করলে আমরা সাথে সাথেই ব্যবস্থা নেবো। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে এমন হামলা মেনে নেয়া যায় না।

ঘটনার ভয়াবহতা এখনো এলাকাবাসীর মনে ক্ষত তৈরি করেছে, কিন্তু প্রশাসন ও প্রতিবেশীদের উদ্যোগে দ্রুত সহায়তা ও পুনঃস্থাপন কাজ চলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। সম্প্রীতির এই দেশ আবারো একসাথে বাঁচার অঙ্গীকার করছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *