আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারেই জোর দিতে হবে

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন-বাগাছাস আয়োজিত আদিবাসী ফুটবল টুর্নামেন্টে দেখা হয়, সংগঠনটির সাবেক নেতা ডন জেত্রার সঙ্গে। আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে আলতো করে করমর্দন করেন। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেলাম, তার হাতটি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। আর কখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে কিনা, তা অনিশ্চিত। খুব মায়া হলো তার প্রতি। একইসঙ্গে ক্ষোভ জন্মাল যে, ডন জেত্রার এই অবস্থার জন্য দায়ীরা এখনও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর পুলিশ নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

কী হয়েছিল ডনের? বলছি।

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি, অধিকার আদায়ের একটি কর্মসূচিতে আদিবাসীরা প্রথমবারের মতো রাজধানীতে হামলার শিকার হন। কর্মসূচিটি ছিল, পাঠ্যবইয়ে জুলাইয়ের একটি গ্রাফিতিতে সম্প্রীতির বার্তা বহনকারী গাছ থেকে, আদিবাসী লেখা সংবলিত পাতা মুছে ফেলার প্রতিবাদে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ঘেরাও কর্মসূচি। হামলাকারীরা ছিল ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’, যারা উগ্র, সাম্প্রদায়িক, আদিবাসী-বিদ্বেষী একটি সংগঠন। যারা হামলার শিকার হন, তাদের মধ্যে ডনের অবস্থা সবচেয়ে গুরুতর হয়। হামলার আরেক শিকার রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যাকে বাঁচাতে গিয়ে ঢাল হয়েছিলেন ডন। ডনের হাতের কয়েকটি আঙুল ভেঙে বেঁকে যায়, আঘাত পান শরীরের বিভিন্ন স্থানে। হামলার সময় কর্তব্যরত পুলিশ ছিল নির্বিকার। আমি ঘটনার সাক্ষী এবং ওই নিজেও আহত হয়েছিলাম সেদিন। তবে ডন ও শ্রেষ্ঠার তুলনায় সামান্যই। ডনের চোখে সেদিন ছিল ব্যথা আর হতাশার মিলন, তবু অন্যকে বাঁচাতে নিজের যন্ত্রণাকে অগ্রাহ্য করেছিলেন—ওই দৃশ্য দেখার পর থেকে আমার মনে তার জন্য গভীর শ্রদ্ধা, সহানুভূতি জেগে আছে।

আদিবাসীরা মামলা করার পর, হামলার দায়ে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টির ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠানো হয়েছিল, অথচ কয়েকদিনের ভেতর জামিন নিয়ে বের হয়ে যায় তারা। পুলিশ এখনও চার্জশিট প্রস্তুত করতে পারেনি। পুলিশের ভাষ্য, হামলার শিকার ব্যক্তিরা প্রাথমিক চিকিৎসা যেখানে নিয়েছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এখনও মেডিকেল সার্টিফিকেট দেয়নি পুলিশকে। ওদিকে ডনসহ হামলায় আহত ব্যক্তিরা, দীর্ঘস্থায়ী নানা শার‍ীরিক জটিলতায় ভুগছেন। একইসঙ্গে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। কেননা, সমস্যার সুষ্ঠু সুরাহা এখনও হয়নি।

জটিল পরিসংখ্যানে যেতে চাই না। যাব না এবারের আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য (‘আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ’) নিয়ে আলোচনায়। সাধারণ অর্থে সোজাসুজি বলতে চাই, ২০২৪ সালের ৫ অগাস্টের পর থেকে দেশে যে বৃহৎ গণঅভ্যুত্থানের চেতনা তৈরি হয়েছিল—যেখানে বৈষম্যহীন, সবার সমান অধিকার মিলবে এমন স্বপ্ন ছিল—সেটাই এখন আদিবাসীসহ দেশের সব প্রান্তিক মানুষদের ক্ষেত্রেও লুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে।

অর্থাৎ, যেসব মানুষ অতীতে আরও বেশি অবহেলিত-উপেক্ষিত ছিল, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের উন্নয়ন আজও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা অন্য কোনো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সত্ত্বেও সঠিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না, বরং সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

কে লুণ্ঠন করে? প্রথম ও প্রধান দায় তো রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা থাকেন, তাদের ওপরই বর্তায়। জাত্যাভিমানী বাঙালি বারবার ভুলে যায় যে, তারাও একসময় জাতিগত নিপীড়নের শিকার ছিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগপর্যন্ত। খবরের কাগজ খেয়াল করলে দেখা যাবে—২০২৪ সালের ৫ অগাস্টের পর থেকে এই জুলাই পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র এক বছরের মধ্যেই আদিবাসীদের প্রতি নির্মমতার হার আগের সময়ের তুলনায় বেড়েছে। সব খবর তো সংবাদমাধ্যমে আসে না, তবু এই কথার সমর্থনে পরিসংখ্যান দেওয়া যাবে। আমি তো নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করতে পারি না। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকার ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বৈষম্যহীন বাংলাদেশে বৈষম্য কেন?

পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিকল্পিতভাবে সেটলারদের দিয়ে অবিরাম উত্তপ্ত করে রাখা, আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন, হত্যা ও খুন, যৌন নিপীড়ন, বাড়িঘর ও সম্পদ-সম্পত্তি ধ্বংস—সবই বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন, পাহাড়ে বাঙালিদের সেটল করাবেন বলেও প্রচার ছিল, তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় পরিসরে সেটলার পাঠানো শুরু হয় ১৯৭৯ সালে, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে অপারেশন দাবানল কর্মসূচির মাধ্যমে। এরপর জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে সরকারি সুবিধা, জমি ও সেনা সহায়তায় তিন লক্ষাধিক বাঙালিকে পাহাড়ে নিয়ে বসতি স্থাপন করে দেওয়া হয়। ফলে স্থানীয় ভূমি দখল, জীবিকায় আঘাত ও সামাজিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে।

১৯৭১ সালেও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল আদিবাসী, বাঙালি ছিল মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তী চার দশকে অনুপাত নাটকীয়ভাবে বদলে যায়—২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাঙালি ৪৭শতাংশ এবং আদিবাসী ৫৩শতাংশ; ২০২২ সালের শুমারিতে প্রায় সমান। জনসংখ্যার এই পরিবর্তন পাহাড়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূল পাল্টে দিয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি কি কখনও বুঝবে, একই দেশের নাগরিক হয়েও বিশেষ ব্যবস্থায় শাসনাধীন থাকার যন্ত্রণা কেমন? বাঙালিদের একটি বড় অংশ চায়, পাহাড়িরা সশস্ত্র আন্দোলন অব্যাহত রাখুক—তাহলেই সেখানে ভিন্নতর শাসন কায়েম রাখার যৌক্তিকতা টিকে থাকবে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বেশির ভাগই প্রচার করে পাহাড়িরা বিচ্ছিন্নতাবাদী; অন্য বাঙালিরাও তা বিশ্বাস করে এবং মনে করে পাহাড়িদের কড়া শাসনে রাখা দরকার। প্রচারও করা হয়—পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের আদিবাসীরা বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। তারাও এই দেশের নাগরিক এবং নিজেদের মতো করে শান্তিতে থাকতে চায়।

কারাগারে বম জনগোষ্ঠীর তিনজন নাগরিকের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং সকল নিরপরাধ বম নাগরিকের মুক্তির দাবিতে বারবার কণ্ঠ উচ্চকিত করছ এদেশের আদিবাসী সমাজ। কিন্তু রাষ্ট্র বধির সেজে বসে আছে, যেন এই দাবি শোনার মতো কোনো দায়িত্বই তার নেই।

পাহাড়ের এত এত নিপীড়নের ঘটনার কয়টি মূলধারার সংবাদমাধ্যমে আসে? আসে না কারণ, ওখানকার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ তারাই করে, যারা রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাদের প্রতি নিবেদিত হয়ে সহযোগিতা করে সেটলার বাঙালিরা, অসৎ ও লোভী ব্যবসায়ীরা আর স্থানীয় প্রশাসন। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও ‘ভাঙো ও শাসন করো’ নীতি জারি রেখেছে রাষ্ট্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে দেশের উত্তরাঞ্চল, গারো পাহাড়ের পাদদেশ, মধুপুরের বন, সিলেটের চা-বাগান যেখানেই আদিবাসীরা আছে——কোথাও কি তারা ভালো আছে? উত্তর হলো, না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অতি সম্প্রতি সিলেটের জাফলংয়ে লামা পুঞ্জিতে দুর্বৃত্তরা খাসিদের প্রায় দুই হাজার পান গাছ কেটে ফেলেছে। পান গাছ তাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড; এক আঘাতে সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়া মানে তাদের জীবিকার মূল শিকড় উপড়ে ফেলা।

৫ অগাস্টের পরপরই ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার নিতাই নদের বালুমহাল হাতবদল হয়। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বালুদস্যুরা পালালেও কিছুদিনের মধ্যে সেখানে চলে আসে নানানদলীয় নতুন বালুদস্যু। এই বালুমহালের কারণে নদের প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নদ-তীরবর্তী আদিবাসীরা—যাদের নদীর সঙ্গে জীবিকা ও সংস্কৃতির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। একইভাবে উন্নয়নের নামে মধুপুরের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার কূট পরিকল্পনাও অব্যাহত রয়েছে, যেখানে বন উজাড়, জমি দখল ও সাংস্কৃতিক নিঃশেষীকরণ একই সঙ্গে চালানো হচ্ছে।

উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা প্রায়ই নিজেদের ভিটেমাটি রক্ষা, পুনরুদ্ধার এবং তাদের ওপর চালানো জুলুম-অত্যাচারের প্রতিবাদে রাজপথে নামে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাগদাফার্মের জমির অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য যে কত মিছিল-সমাবেশ দেখেছি। কিন্তু এর যেন শেষ নেই—একটি সমাধানহীন সংগ্রাম বারবার নতুন করে শুরু হয়।

আদিবাসীদের ওপর চালানো অন্যায়-অত্যাচারের কয়টির সুরাহা হয়েছে—কেউ কি প্রমাণ দিতে পারবেন? পারবেন না। আর সুরাহা না হলে প্রমাণই বা আসবে কোথা থেকে?

তাহলে সমাধান কী? একজন আদিবাসী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, সমাধান একটাই—আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিতে অবিচল থাকা। কেননা রাষ্ট্র আদিবাসীদের প্রতি সংবেদনশীল নয়। সরকার যায়, সরকার আসে। ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ভোট ব্যাংক ভারি করার স্বার্থে তারা কখনো কখনো নৈকট্য দেখায় বটে, কিন্তু সেই নৈকট্যে আন্তরিকতা নেই।

আমি রাষ্ট্রের কাছ থেকে একটুও সংবেদনশীলতা আশা করি না। বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চাপে রাখতে হবে—যাতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, নাগরিক অধিকার এবং যাবতীয় বিশেষ ও সংরক্ষিত অধিকার দিতে তারা বাধ্য হয়।

এক্ষেত্রে আদিবাসীদের দায়-দায়িত্বও বিপুল। রাজপথে আন্দোলন জোরদার করতে হবে, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসূচি চালাতে হবে, অনলাইন প্রচারণা বাড়াতে হবে, বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখি ও জনমত তৈরি করতে হবে।

বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের আদিবাসী প্রতিনিধিরা ইদানিং তাদের বাস্তবতা তুলে ধরছেন, কিন্তু এই তুলে ধরার কৌশল আরও মজবুত, যুক্তিযুক্ত ও বৈচিত্র্যময় হতে হবে—যেন তা থেকে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের সরকারের ওপর শক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

অধিকার তো আদায়ের বিষয়—চেয়ে নেওয়ার নয়। তাই না?

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *