আদিবাসীরা আরো প্রান্তিক হচ্ছে: সন্তু লারমা

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

আদিবাসীদের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চয়তা ও শঙ্কায় ভরা বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।

তিনি বলেছেন, “ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে চলমান সংস্কার কার্যক্রমে আদিবাসীদের কার্যকর কোনো সংগঠন বা নেতৃত্বের সাথে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়নি।”

শারীরিক অসুস্থতার কারণে শনিবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের সমাবেশে তিনি উপস্থিত না থাকলেও লিখিত বক্তব্য পাঠান। সমাবেশে তার বক্তব্য পাঠ করা হয়।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ওই শান্তি চুক্তি হয়। তবে দীর্ঘ সময়েও চুক্তির বেশির ভাগ বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ করে আসছেন পাহাড়ি নেতারা।

সন্তু লারমা বলেন, “বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের অধিকাংশ জনগণ এখনও অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে দিন যাপন করছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশে তারা ক্রমশ ভূমিহীন ও দেশান্তরী হচ্ছেন।

“পাহাড়ের আদিবাসীদের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ২৮ বছরেও এ রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করছে না। ফলে পাহাড়ে বিদ্যমান সমস্যার নানা রূপ প্রতিফলিত হচ্ছে।

“সমতলের আদিবাসীদের পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক। ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নারী নিপীড়ন, বৈষম্য, বিচারহীনতা- এসবের মাধ্যমে প্রান্তিক থেকে আরো প্রান্তিক হচ্ছেন আদিবাসী জনগণ।”

আদিবাসী জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম জোরদারকরণে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সন্তু লারমা বলেন, “প্রান্তিকতার খাদ থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে আদিবাসীদের লড়াইকে আরো ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করে অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার জন্য সমগ্র আদিবাসী জনগণ ও প্রজন্মের তরুণদেরকে আমার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি।”

অধিকার আদায়ের লড়াই ও সংগ্রামকে বেগবান করা এবং গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রগতিশীল আদর্শের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন এই আদিবাসী নেতা।

আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়, ভূমি কমিশন গঠনসহ সাতটি দাবি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।

আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার পাশাপাশি সমাবেশ ছিল আদিবাসী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাদ্যযন্ত্রসহ ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।

হাজং, বম, খাসিয়া, মারমা, গারোসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা ব্যানার নিয়ে সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন।

এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ’।

আলোচনা পর্বে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “বর্তমান সরকারে যারা আছেন, তাদের অনেকেই অধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী। জুলাই আন্দোলনেও আদিবাসীদের অনেকেই যুক্ত হয়েছিলেন।

“মাইকেল চাকমার গুম হওয়ার কথা আমরা জানি। তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছেন। এখন মাইকেল চাকমার গুম হওয়ার বিচারের দাবি তুলতে হবে। কল্পনা চাকমা, আলফ্রেড সরেন, পীরেন স্নালের হত্যার বিচারের দাবিও তুলতে হবে।”

তিনি বলেন, “যারা অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন- তাদের অনেকে ফিরে এসেছেন। অভ্যুত্থানের পরও আমরা দেখেছি, অনেক অধিকারকর্মী ফিরেছেন।

“কিন্তু পাহাড়ে অধিকারের দাবি নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কারণে যারা বাড়ি ছাড়তে হয়েছে, তারা এখনো কেন ফিরতে পারছে না? বম সম্প্রদায়ের অনেকে এখনো বাড়ি ছাড়া হয়ে আছেন। তাদের যে ন্যূনতম আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার, তা তারা পাচ্ছেন না।”

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “অভ্যুত্থানের পর দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি। অঙ্কিত হল, সেখানেও আদিবাসীদের অধিকারের কথা আঁকা হয়েছিল। কিন্তু এখন দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও আদিবাসীদের জন্য কোনো সুখবর নেই। বরং পাহাড়ে দখল অব্যাহত আছে।

“রাখাইনে করিডোর দেওয়ার নামে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। এই সরকার আসার পর বিভিন্ন সংস্কার কমিশন করেছে। কিন্তু আমরা দেখলাম আদিবাসীদের নিয়ে সংস্কার কমিশন হলো না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আদিবাসীদের আর কোনো প্রত্যাশা রইলো না। তাই সামনে আমাদের লড়াই ছাড়া আর পথ নাই।”

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানে ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ নামে একটি গ্রাফিতি আঁকলো ছাত্ররা। সেই গ্রাফিতিটি পাঠ্যবইয়ে ছাপাও হলো। গ্রাফিতিটিতে লেখা ছিল- হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান, আদিবাসী, বাঙালি। কিছু লোক সেই পাতাটি ছিঁড়তে চাইল। তাদের কথা শুনে পাঠ্যবই থেকে সেই পাতাটি সরকার নিজেই ছিঁড়ে ফেলল। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ছাপানো বই থেকে সেই পাতাটি ছেঁড়া হলো।”

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যে স্লোগান দেওয়া হল- ‘পাহাড় কিংবা সমতলে/লড়াই চলবে সমানতালে’। জুলাই অভ্যুত্থানের পর সরকার কি আদিবাসীদের জন্য ভূমিকা পালন করেছে? বাস্তবতা হল রাষ্ট্র চেষ্টাই করেনি।”

রতনের ভাষ্য, অতীতেও আদিবাসীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু রাষ্ট্র তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়নি।

নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার ক্ষমতায় বসলেও সরকারের কাজের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী অবস্থান দেখা যাচ্ছে না।”

সমাবেশ থেকে সাতটি দাবি জানানো হয়, যার মধ্যে রয়েছে-

১. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।

২. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।

৩. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

৪. আদিবাসীদের সম্পর্কে বিকৃত, খণ্ডিত বা মিথ্যা তথ্য প্রচারকৃত সকল গণমাধ্যম, মিডিয়া বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে।

৫. আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ করাসহ সব মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।

৬. জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নম্বর কনভেনশনে অনুসমর্পণ এবং আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন করতে হবে।

৭. রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদ্‌যাপন করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ সবাইকে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান।

শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের দেওয়া বাণীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করেন বৈশাখী হাজং।

আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, নারী বিষয়ক সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা, সদস্য হেলেনা তালাং, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্তনী রেমা, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যাসহ অনেকে বক্তব্য দেন।

পরে একটি শোভাযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে আবার শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।

সমাবেশের শুরুতে জাতীয় সংগীত ও গণসংগীত পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *