আন্দোলনকারী শক্তিগুলোকে বিভক্ত রাখার কৌশল

CHT NEWS


সোহেল চাকমা



কেউ পাহাড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনীতি বিষয়ে যুক্তি সহকারে কথা বললে সেনাবাহিনী,
জেএসএস (সন্তু) ও অন্যান্য ঠ্যাঙাড়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো তাকে “ইউপিডিএফ ট্যাগ”
লাগিয়ে দেয়। কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইলে তাকেও “ইউপিডিএফ ট্যাগ” থেকে বঞ্চিত
করা হয় না। খুবই উদারভাবে, মুক্ত হস্তে সেটা দেয়া হয়।

কোন কোন ধর্মে সেই ধর্মের বিধান নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না, সংশয় প্রকাশ করা
যায় না, যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না – তা অধর্ম হয়ে যায়, তার জন্য শাস্তি দেয়া হয়।
জেএসএস সন্তু গ্রুপকেও তাদের রাজনীতি ও কর্মসূচি ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না। কেউ
প্রশ্ন করলে বা যুক্তি সহকারে কথা বললে তকে বলা হয়: ‘তুমি ইউপিডিএফ, তুমি বেশী বোঝ’
ইত্যাদি। এভাবে জেএসএস সন্তু গ্রুপ “ইউপিডিএফ ট্যাগকে” অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তার
মুখ বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তারা এই ট্যাগ লাগিয়ে দেয়? তাদের এই ট্যাগ দেয়া
হলো আসলে একটি কৌশল, যার উদ্দেশ্য হলো আন্দোলনকারী শক্তিগুলোকে বিভক্ত রাখা। কারণ তারা
জানে জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সংগ্রাম করে, তাহলে তাদের (প্রতিক্রিয়াশীলদের) পরিণতি
খুবই খারাপ হবে। এজন্য তারা বিভিন্ন কলাকৌশল খাটিয়ে চেষ্টা করে জনগণ যাতে ঐক্যবদ্ধ
হতে না পারে, সঠিকভাবে নেতৃত্বদানকারী পার্টি ও সংগঠনের সাথে একতাবদ্ধ হতে না পারে।

প্রতিক্রিয়াশীলরা চায় জনগণকে নেতৃত্বহীন করতে। কারণ সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না। তাই আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য সেনা-শাসকরা নতুন সময়ের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল ইউপিডিএফের ওপর দমনপীড়ন চালায়, যা সাধারণ জনগণ দেখতে পায়। এই দমনপীড়নের মাধ্যমে তারা একই সাথে সাধারণ জনগণকেও বোঝাতে চায়, কেউ ইউপিডিএফের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে, সংগ্রাম করলে তার ওপরও জেল-জুলুম করা হবে। তাই তারা তাকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, ইউপিডিএফের প্রতিবাদী ধারার রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করতে “ইউপিডিএফ ট্যাগ” লাগিয়ে দেয়, যাতে সে ভয় পেয়ে “লক্ষ্মী ছেলেটির “ মতো চুপটি করে বসে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি রাজনীতিতে বর্তমানে সুস্পষ্ট দু’টি ধারা বিরাজ
করছে। একটি হলো জেএসএস (সন্তু গ্রুপ)-এর নেতৃত্বে চরম প্রতিক্রিয়াশীল, লেজুড়বাদী, সুবিধাবাদী
ধারা; এবং অন্যটি হলো আন্দোলনমুখী, আপোষহীন, প্রগতিশীল ধারা। প্রথম ধারাটির অর্থাৎ
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন সুবিধাবাদী-লেজুড়বাদী ধারাটির পৃষ্ঠপোষক হলো সেনাবাহিনী ও
ডিজিএফআই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে তারা আন্দোলন-বিমুখ। সে কারণে সেনা-শাসকগোষ্ঠী এই ধারাটি
যাতে প্রাধান্যে থাকে তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে থাকে।

অপরদিকে তার বিপরীতে ইউপিডিএফ হলো পাহাড়ে একমাত্র দল, যে সেনা-শাসকদের দমনপীড়ন,
নারী নির্যাতন ও ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের
জনগণের আজন্ম লালিত স্বপ্ন স্বায়ত্তশাসনের পতাকা উর্ধে তুলে ধরে রেখেছে। তাই স্বাভাবিকভাবে
ইউপিডিএফের রাজনীতি আন্দোলন সেনা-শাসকদের পছন্দ হয় না। অন্যদিকে জেএসএস সন্তু গ্রুপসহ
জুম্ম দালাল প্রতিক্রিয়াশীলদের ইউপিডিএফ বিরোধীতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইউপিডিএফের
আন্দোলন ও রাজনীতি তাদের মুখোশ জনগণের সামনে খুলে দেয়, তাদের দালালী, সুবিধাবাদী ও
প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে প্রকাশ করে দেয়।

প্রতিক্রিয়াশীলরা চায় জনগণকে নেতৃত্বহীন করতে। কারণ সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোন
আন্দোলন সফল হতে পারে না। তাই আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য সেনা-শাসকরা নতুন সময়ের আন্দোলনে
নেতৃত্বদানকারী দল ইউপিডিএফের ওপর দমনপীড়ন চালায়, যা সাধারণ জনগণ দেখতে পায়। এই দমনপীড়নের
মাধ্যমে তারা একই সাথে সাধারণ জনগণকেও বোঝাতে চায়, কেউ ইউপিডিএফের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ করলে, সংগ্রাম করলে তার ওপরও জেল-জুলুম করা হবে। তাই তারা তাকে আন্দোলন থেকে
দূরে সরিয়ে রাখতে, ইউপিডিএফের প্রতিবাদী ধারার রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করতে “ইউপিডিএফ
ট্যাগ” লাগিয়ে দেয়, যাতে সে ভয় পেয়ে “লক্ষ্মী ছেলেটির “ মতো চুপটি করে বসে থাকে।

এভাবে ট্যাগ দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলরা এতদিন অনেককে ভীতসন্ত্রস্থ করে রাখতে
সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তাদের এই ট্যাগ দেয়ার কৌশল আর খাটছে না। মানুষ আর ট্যাগ
খাওয়ার ভয়ে ভীত নয়। সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়কের কমেন্টে
সেটা ফুটে উঠেছে। তিনি তার ফেইসবুক আইডিতে লিখেছেন: “ভবিষ্যৎঅ হদা হরব নপেম, কিন্তু
বর্তমানে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে হিলো জুম্মোউনো অধিকারত্তেই লাড়েই গরদে যেনেই যদি
ইক্কু মানুজ ইউপিডিএফ ট্যাগ নহায়, সালেন, সে মানুজর চিদে গরানা উচিত, তে আন্দোলন সংগ্রাম
অর সঠিক পধত আগে না নেই!!!” অর্থাৎ ভবিষ্যতের কথা জানি না, তবে বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে
পাহাড়ের জুম্মদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে গিয়ে যদি একজন লোক ইউপিডিএফ ট্যাগ না পায়,
তাহলে সে লোকটির চিন্তা করা উচিত, সে আসলে আন্দোলন সংগ্রামের সঠিক পথে আছে কি নেই!!!”
পাহাড়ের মানুষ এখন বুঝেছে, আন্দোলন ছাড়া অধিকার অর্জিত হবে না, তাই আন্দোলনকারী সকল
শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

পৃথিবীতে যারাই ন্যায়ের পক্ষে, স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে লড়াই করেছে,
শাসকগোষ্ঠী তাদের ওপর নির্দয় দমনপীড়ন চালিয়েছে। এটাই হলো নির্মম বাস্তবতা। মুক্তির
পথ, অধিকারের পথ কখনই সহজ, সরল ও মসৃন ছিল না, এখন নেই। বৃ্টিশ আমলে স্বাধীনতাকামী
বিপ্লবীদের ওপর কি দমনপীড়ন চলেনি? আমরা জানি মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, সরদার প্যাটেলসহ
কংগ্রেস নেতাদেরকে বৃটিশরা বার বার জেলে পুরে রেখেছিল। কত অসংখ্য বিপ্লবীকে ফাঁসি দিয়েছে,
নির্বাসনে পাঠিয়েছে, দণ্ডিত করেছে, অত্যাচারে জর্জরিত করেছে তার হিসাব মেলা ভার। কিন্তু
তারপরও বৃটিশরা কংগ্রেস পার্টিকে ধ্বংস করতে পারেনি, বরং ভারতবাসীকে স্বাধীনতা দিতে
বাধ্য হয়েছে।

দেশভাগের পর ন্যাপ ও আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য মুক্তিকামী দলগুলোর ওপরও পশ্চিম
পাকিস্তানীরা নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালিয়েছিল। সে কথা অল্পবিস্তর সবার জানা। কিন্তু তারপরও
মানুষ সে সময় আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিল (অবশ্য আওয়ামী লীগ পরে একটি ফ্যাসিস্ট পার্টিতে
পরিণত হয়, যার আলোচনা এখানে নয়) এবং ফলে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে পাটাতারি গোটাতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও গত ২৭ বছর ধরে ইউপিডিএফ ও অধিকারের জন্য লড়াইরত
অন্যদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালাচ্ছে। কিন্তু তা সত্বেও তারা ইউপিডিএফকে দমাতে পারেনি,
ভবিষ্যতেও পারবে না। বরং ইউপিডিএফের ওপর যতই দমনপীড়ন চালানো হয়েছে, ততই ইউপিডিএফ শক্তিশালী
হয়েছে। জনগণ ইউপিডিএফের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।

শেষে যে সত্য কথাটি বলতে চাই তা হলো, প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা সবচেয়ে যা ভয়
পায় তা হলো জনগণের মধ্যে একতা। তাই তারা চায় যাতে এই ঐক্য কোনভাবে গড়ে না ওঠে। এজন্য
তারা নানা কৌশল প্রয়োগ করে থাকে – যার মধ্যে একটি হলো ট্যাগ দেয়া। কিন্তু সব সময় এই
কৌশল কাজ করে না। সেনা শাসক ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলদেরও আজ “ইউপিডিএফ ট্যাগ” লাগিয়ে
দেয়ার কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ জেগে উঠেছে এবং তাদের এই কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে। জনগণের
এক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিজয় হবেই হবে। (সমাপ্ত)

* সোহেল চাকমা, সহ-সাধারণ সম্পাদক, পিসিপি।

** লেখাটি সোহেল চাকমার ফেসবুক থেকে নেওয়া হয়েছে। 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *