‘আমরা চোর নই মুচি’ বলে হাত জোড় করে বাঁচার আকুতি, তবু শেষ রক্ষা হয়নি

Bangla Tribune

‘আমরা চোর নই। জুতা সেলাই করে জীবন চালাই। আমাদের মারবেন না।’ দুই হাত জোড় করে মারধরকারীদের কাছে এভাবে বাঁচার আকুতি জানান রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় পিটিয়ে হত্যার শিকার রুপলাল দাস ও প্রদীপ দাস। কিন্তু তাদের আকুতি শোনেনি মারধরকারীরা। শেষ পর্যন্ত পিটিয়ে মেরেই ফেললো। মারধরের সময় তাদের এই আকুতির একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে সমালোচনা করছেন স্থানীয় লোকজন। অনেকে এটিকে ‘মব সৃষ্টি’ করে হত্যা বলছেন। চেয়েছেন বিচার।

৯ আগস্ট রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায় ভ্যানচোর সন্দেহে এই দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রুপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস (৩৫)। প্রদীপ দাস সম্পর্কে রুপলাল দাসের ভাগনি জামাই। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রুপলাল দাস জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। আর প্রদীপ দাস ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ভ্যানে বসে আছেন রুপলাল দাস ও প্রদীপ দাস। তাদের ভ্যান ঘিরে রেখে কিছু লোকজন নানা প্রশ্ন করছেন। চুরির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তাদের সঙ্গে থাকা প্লাস্টিকের বস্তা খুলতে বলছেন কয়েকজন। বস্তা খুললে সেখানে চার বোতল বাংলা মদ পাওয়া যায়। সেটি নিয়েও প্রশ্ন করছেন লোকজন। এ সুযোগে কয়েকজন তাদের মারধর শুরু করেন। কেউ ঘুষি মারছেন, কেউ লাথি দিয়ে ভ্যান থেকে ফেলে দিচ্ছেন। আবার কয়েকজনে মিলে তুলে ভ্যানে বসিয়ে ভ্যান চুরির বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন। মারধরের মুখে রুপলাল বলছেন, ‘আমরা চোর নই, দলিত সম্প্রদায়ের লোক। বাজারে জুতা সেলাই করে জীবন চালাই। আমার মেয়ের বিয়ে হবে। এ জন্য আমাদের সম্প্রদায়ের প্রথা অনুযায়ী বাংলা মদ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। কোনও চুরির সঙ্গে জড়িত নই। চুরির বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।’

এ সময় মেহেদী হাসান নামের এক যুবককে তাদের মারধর না করার জন্য অনুরোধ করতে দেখা যায়। তিনি পুলিশকে খবর দেওয়ার কথা বলে মারধরকারীদের থামানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু মারধরকারীরা কিছুতেই থামছিল না। তাদের জেরার মুখে রুপলাল আবারও বলতে শুরু করেন, ‘আমি চোর না, ডাকাতও না। মুচি, তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করি।’ তখন উপস্থিত এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘তুই চোর, ডাকাতের বাপ।’ এ সময় রুপলাল প্রস্রাব করতে চাইলে মারধরকারী কয়েকজন বলছিল সে পালাবে। তাই প্রস্রাব করতেও দেওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পর আবারও তাদের মারধর শুরু করে লোকজন। এ অবস্থায় ভ্যান থেকে নিচে পড়ে যায় রুপলাল। তখনও ভ্যানে বসে ছিলেন প্রদীপ। ওই সময় মারধরকারীদের বলতে শোনা যায়, ‘শালারা মাল খেয়ে আসছে, অভিনয় করছে। পরে আবার ভ্যানে তুলে তাদের মারধর করা হয়।’

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানিয়েছেন, ভ্যানচোর সন্দেহে ওই দুজনকে শতাধিক লোকজন মব সৃষ্টি করে তিন দফায় মারধর করেছে। মূলত গণপিটুনিতে তাদের অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়। দুজন বারবার বাঁচার আকুতি জানালেও মারধরকারীদের মন গলেনি। মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে লোকজন দূরে সরতে থাকে। প্রায় মৃত অবস্থা দেখেও তাদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি।

নিহতদের স্বজন, পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে রুপলাল দাসের মেয়ের বিয়ে কথাবার্তা চলছিল। ঘটনার দিন বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রুপলাল দাসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রদীপ দাস। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ দাস সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন। রুপলাল সেখানে যান। তারা দুজনে ভ্যানে চড়ে রুপলালের বাড়ি ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের থামান স্থানীয় কয়েকজন। এরপর সেখানে জড়ো হন শতাধিক লোক।

রুপলাল দাসের ভাই খোকন দাস, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ জুলাই ওই এলাকায় এক কিশোরকে হত্যা করে একটি ভ্যান চুরির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন প্রদীপ দাসের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে চারটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করেন। সেগুলোতে চোলাই মদ ছিল। একটি বোতল খুললে ভেতরে থাকা তরলের ঘ্রাণে সেখানকার দুই ব্যক্তি অসুস্থবোধ করেন। এ ঘটনায় লোকজনের সন্দেহ আরও বাড়ে। অজ্ঞান করে ভ্যান চুরির সন্দেহে তাদের মারধর শুরু করেন। বটতলা থেকে মারতে মারতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হয় তাদের। মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে তাদের সেখানে ফেলে রাখা হয়। রাত ১১টার দিকে তাদের উদ্ধার করে পুলিশ তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রুপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপ দাসকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ওই দিন ভোরে তিনিও মারা যান।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সয়ার ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মো. শাহীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাত সাড়ে ৯টার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান করে ভ্যান ছিনতাই করতে এসে ধরা পড়েছে দুজন। গিয়ে দেখি শতাধিক লোকের ভিড়। ভ্যানে বসে থাকা দুই ব্যক্তি বারবার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন। তারা চোর নয়, মুচি বলছিলেন। হাতজোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন। কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনছিল না। একপর্যায়ে তাদের পেটাতে পেটাতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন দুজন অজ্ঞান অবস্থায় মাটিতে পড়েছিল। তা দেখে আমি চলে আসি। পরে শুনেছি মৃত্যু হয়েছে। এটি অমানবিক ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুড়িরহাট বাজারের এক ব্যবসায়ী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই ঘটনার ১০-১২ দিন আগে ইরফান বাবু (১৫) নামে এক কিশোরকে জবাই করে হত্যার পর তার ভ্যানটি চুরি হয়। ওই ভ্যান চোর ধরা পড়েছে এই গুজব ছড়িয়ে নিরপরাধ দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কাজটি ভালো হয়নি। চোর হলেও পুলিশ ডেকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত ছিল। এমন হত্যা কোনোভাবেই মানা যায় না। ঘটনায় জড়িতরা এখানের লোকজনই। অবশ্যই চিহ্নিত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’

স্বজনরা জানিয়েছেন, রুপলাল জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। এই আয়ে মা, স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ ছয় জনের সংসার চালাতেন। সহায় সম্বল বলতে চার শতক জমি। প্রদীপ ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

ঘনিরামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রুপলালের বাড়িতে চলছে আহাজারি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা তারা। ১০ বছর বয়সী মেয়ে রুপা দাস ও ১৩ বছরের ছেলে জয় দাসকে জড়িয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন ভারতী দাস। বিলাপ করে বলছিলেন, ‘এ্যালা মুই কেমন করি বাঁচিম? ছোট ছাওয়া দুইটাক কায় খাওয়াইবে পড়াইবে? মোর নির্দোষ স্বামীক কেন মারিল, বেটিটার বিয়ার কী হইবে? মুই কোনটে যাইম, কী করিম? কার কাছোত বিচার চাইম?’ বড় মেয়ে নুপুর দাস (১৮) মায়ের গলা ধরে কাঁদছিলেন। তার কণ্ঠেও অসহায়ত্বের হাহাকার, ‘এ্যালা কয় হামাক দ্যাখপে, কায় মাও কয়া দাকপে, হামরা যে এতিম হয়া গেইনো।’ ছেলেকে হারিয়ে বৃদ্ধ রুপলালের মা লালিচা দাস কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। 

রবিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে দুজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। এরপর লাশ নিয়ে স্বজনরা তারাগঞ্জে এলে বিক্ষোভ শুরু হয়। হত্যার প্রতিবাদে ও বিচার দাবিতে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় লোকজন। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুই ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাত ১০টার দিকে তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।  

তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুক জানান, খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে রুপলালকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। আর প্রদীপ দাসকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। 

কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তুহিনুর ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন রুপলাল। মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। তাকে মেরে ফেলায় পুরো পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছে। যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তা অমানবিক। এ ঘটনায় কঠোর বিচার হওয়া উচিত।’

ওসি এম এ ফারুক বলেন, ‘দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় রুপলালের স্ত্রী বাদী হয়ে তারাগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় ৫০০-৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। ঘটনার সময়কার ভিডিও বিশ্লেষণ করে ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় এখন পর্যন্ত চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। 

গ্রেফতারকৃতরা হলেন সয়ার ইউনিয়নের বালাপুর গ্রামের এবাদত হোসেন (২৭), বুড়িরহাট এলাকার আখতারুল ইসলাম (৪৫), রফিকুল ইসলাম (৩৩) ও রহিমাপুরের মিজানুর রহমান (২২)। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংগঠনটি বলছে, ঘটনাটি প্রচলিত আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য। সোমবার সংগঠনটি এক বিবৃতিতে এ কথা জানায়। বিবৃতিতে আসক বলেছে, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে হত্যা করা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের আইনগত সুরক্ষা ও জীবন রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যা এই ঘটনায় গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা দেশের নাগরিকের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি সামাজিক সম্প্রীতি ও আইনের শাসনের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *