Google Alert – পার্বত্য অঞ্চল

বিশ্বের সর্বত্রই পর্যটন শিল্প ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। বস্তুত, এটি অতি সম্ভবনাময় ও লাভজনক শিল্প। সর্বোপরি পর্যটন বর্তমান বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের দেশও তা থেকে মোটেই আলাদা নয় বরং পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনার দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এ দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র ও সৌন্দর্য পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তাই আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ খুবই সম্ভবনাময় ও উজ্জ্বল।

বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান লাভজনক খাত। ১৯৫০ সালে বৈশ্বিক পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। যা বিগত ৬৮ বছরে পর্যটকের সংখ্যার প্রায় ৫০ গুণ। পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার।

বিপুল সম্ভবনা থাকলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে অনেকটাই পশ্চাদপদ। এজন্য সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা প্রধানত দায়ি। ২০১৮ সালে আমাদের দেশে জিডিপি খাতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা। এ খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার। একই বছর পর্যটন খাতে বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ বিলিয়ন টাকা। তাছাড়া সঠিক তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয়, গত বছর বাংলাদেশে প্রায় ৭ লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। যা খুবই আশাব্যঞ্জক ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।

করোনা মহামারীর পর ২০২১ সাল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে পর্যটন ও ভ্রমণ খাত। ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, খাতটি আবার প্রাক্‌-মহামারি পর্যায়ে ফেরত এসেছে। যদিও সূচকের মান সামগ্রিকভাবে খুব একটা বাড়েনি; ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। যে ১১৯টি দেশ নিয়ে এ সূচক করা হয়েছে, এর মধ্যে ৭১টি দেশের মান ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে। ১১৯টি দেশের মধ্যে ১ নম্বরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। আর বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের দেশে দেশে পর্যটনের আগমনের পরিমাণ এ বছরই প্রাক্‌-মহামারি পর্যায়ে ফেরত যাবে। ২০২৩ সালে যা ছিল ২০১৯ সালের ৮৮ শতাংশ। গত বছর বৈশ্বিক জিডিপিতে পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের অবদান ছিল ৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন বা ৯ লাখ ৯০ হাজার কোটি ডলার। সেটিও প্রাক্‌-মহামারি পর্যায়ের প্রায় সমান। পর্যটক আগমনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য; ২০২৩ সালে এই অঞ্চলের পর্যটক আগমন প্রাক্‌-মহামারি সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি ছিল। ইউরোপ বরাবরের মতোই স্থিতিশীল; সে সাথে আফ্রিকা, আমেরিকাসহ প্রায় অঞ্চলেই পর্যটকের আগমন বেড়েছে। এসব দেশে ২০২৪ সালে পর্যটক আগমনের সংখ্যা ছিল প্রাক্‌-মহামারি সময়ের প্রায় ৯০ শতাংশ। চলতি বছরও পর্যটন খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

আমাদের দেশের পর্যটনের সম্ভবনা বিষয়ে সম্প্রতি শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, আমাদের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ও দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, সোনারগাঁও, রামপাল, বজ্রযোগিনী এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল। যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তার ভাষায়, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান কম। অন্য দেশের তুলনায় আমাদের পর্যটনখাত এখনও পিছিয়ে আছে। সরকার টেকসই ও সবুজ পর্যটনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশগত টেকসই এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

অপূর্ব সৌন্দর্য্য ও প্রাকৃতিক নৈসর্গিকতার আধার আমাদের এ বাংলাদেশ। তাই এ রূপসী বাংলার পর্যটন শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে লাভজনক হিসেবে গড়ে তোলা খুবই সম্ভব। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্য, সিলেটের সবুজ অরণ্যসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমুদ্র সৈকতের চেয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত তাৎপর্যপূর্ণ ও সম্ভবনাময়।

নিকট অতীতে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে প্রতি বছর বাড়তি ২শ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হল সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক।

সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এটি ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সুন্দরবনের প্রকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে এ বনের জীববৈচিত্র এটিকে পৃথিবীর অন্য যে কোনো পর্যটন কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্ররূপে উপস্থাপন করেছে। সুন্দরবনকে বেষ্টিত করে রেখেছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, খাল, শত শাখা নদী, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। সুন্দরবনের নামের সঙ্গে যে বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত, তা হল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বনভূমিটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, ডলফিন ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। যা সুন্দরবনকে অধিকতর ঐশ্বর্যমন্ডিত ও বৈচিত্রময় করে তুলেছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অধিক পরিচিত। পর্যটনের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের অপার সম্ভবনাও রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা, যা তিনটি জেলা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হল পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের মোহাবিষ্ট করে তোলে। এখানে শীতে যেমন এক রূপ ধরা দেয় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে, ঠিক তেমনি বর্ষা অন্য এক রূপে হাজির হয়। শীতে পাহাড় কুয়াশা আর মেঘের চাদরে যেমন ঢাকা থাকে, তার সঙ্গে থাকে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চারদিক জেগে ওঠে সবুজের মহাসমারোহ। এ সময় প্রকৃতি ফিরে পায় আপন যৌবন। বর্ষায় মূলত অতিকৌতুহলী ট্যুরিস্টদের পদচারণা সবচেয়ে বেশি থাকে পার্বত্য অঞ্চলে। তখন এখানে ঝরনা, হ্রদ কিংবা নদীপথগুলো নতুন রূপে সেজে ওঠে যা দেখার জন্য অসংখ্য পর্যটক এখানে ভিড় জমান। এর সঙ্গে আছে পাহাড়ের মানুষের ভিন্নধর্মী ও বৈচিত্রময় জীবনাচরণ।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এ শহরে রয়েছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহত চা বাগান ‘মালনীছড়া’। এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের মন জুড়ায় সৌন্দর্যের রানীখ্যাত ‘জাফলং’, নীলনদ খ্যাত স্বচ্ছ জলরাশির ‘লালাখাল’, পাথর জলের মিতালিতে বয়ে যাওয়া বিছনাকান্দির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, পাহাড় ভেদ করে নেমে আসা ‘পাংথুমাই ঝরনা’, সোয়াম্প ফরেস্ট ‘রাতারগুল’, মিনি কক্সবাজার খ্যাত ‘হাকালুকি’ এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার সৌন্দর্য।

আমাদের দেশের হাওর অঞ্চল পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এ সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। হাওর অঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপরূপ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারেন। হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, হাওর-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নল, খাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজপ্রাণী আর হাওর পারের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের।

আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে রয়েছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। তাই দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করা দরকার। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

মূলত, পর্যটন একটি সর্বাধুনিক ও লাভজনক শিল্প। প্রকৃতি পাগল মানুষ সময়-সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান; লাভ করেন আত্মবিনোদন। দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া, থাকা, বিনোদন ও যাতায়াতের খরচাদি সঙ্গে নিয়ে যিনি পর্যটন করেন তিনিই তো ‘পর্যটক’। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন পর্যটনকে ‘শিল্প’ হিসাবে পরিশীলিত করেছে। পর্যটন একটি আকর্ষণ এবং একজন পর্যটক ‘জ্ঞান পিপাসু’। তাই জানার নেশায় পর্যটক ঘুরে বেড়ান দেশ-দেশান্তরে। নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেয়া, থাকা-খাওয়া, বিনোদন সব কিছুর খরচ বহন করতে হয় নিজেকেই। তার ব্যয়িত অর্থই হয় অন্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। কাজেই যে কোনো দেশের জন্য পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ খুবই লাভজনক। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে কোনো বর্ধনশীল আয়ের রফতানি বাণিজ্যের চেয়েও বেশি লাভজনক এই পর্যটন শিল্প।

হিমালয় দুহিতা নেপাল ও বৈচিত্রময় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, মালেশিয়াকে এর উদাহরণ হিসাবে দেখানো যেতে পারে। এ কয়েকটি দেশের বৃহত্তর রাজস্ব আয় অর্জিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প থেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য সযত্নে রক্ষা করছেন ঐতিহাসিক পুরার্কীতি, প্রত্ন-নিদর্শনসমূহ, গড়ে তুলছেন নিত্য-নতুন আকর্ষণীয় কীর্তিসমূহ। সচক্ষে জ্ঞান আহরণ ও চিত্ত বিনোদনের জন্য মানুষ তাই দেখতে ছুটে যাচ্ছে, আসছে। ভ্রমণের ফলে পরিচিত হচ্ছে ভিন্ন প্রকৃতির সঙ্গে। লাভ করছে এক অনন্য অনুভূতি ও নতুন অভিজ্ঞতা। অনুসন্ধিৎসু মানুষ আহরণ করছে অন্য দেশের শিল্প, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জ্ঞান। ফলে মানুষে মানুষে বাড়ছে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা। বিকশিত ও পরিশীলিত হচ্ছে জ্ঞানের ভাণ্ডার।

সভ্যতা ও সংস্কৃতি ক্রমবিকাশ ঘটছে। অনুসন্ধিৎসাও বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মসংস্থানের পরিসরও। জানা গেছে, পর্যটন শিল্পের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ১৩ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি জড়িয়ে রয়েছেন। ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করেছেন ৯০ কোটি লোক। এ শিল্প থেকে আয় হয়েছে ৫০ হাজার কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাপী এ শিল্পের প্রসারতা প্রমাণ করে, প্রকৃতির কাছ থেকে চিত্তবিনোদনের ও জ্ঞানের পাঠ নেয়ার প্রতি ঝোঁক দিনের পর দিন আরও বাড়বে। ভুটান, নেপাল ও ভারতের কাছাকাছি দেশ বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রচার করা হয় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, বৃষ্টি, খরা, বস্তি, ভূখা-নাঙ্গা মানুষ, বর্জ্য, ভূমিকম্প ও হরতালের দেশ হিসাবে। এদিক থেকে ছোট আমাদের দেশটিতে বহির্বিশ্বেও মানুষদের ভ্রমণের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে।

যেখানে সচ্ছলতা, শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন ও নিরাপদ পরিবেশ সেখানেই মানুষ যেতে চায়। এদেশে ঝড়-ঝলোচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু এর মাঝেও বহমান জীবন একেবারে তিক্ত নয়। এদেশের ভূমি ও হাজার বছরের ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ। বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার বৌদ্ধ বিহার, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, ছোট কাটারা, বড় কাটারা, মোগল পাঠান যুগের ঐতিহাসিক মসজিদ, ঈদগাহ, সোনারগাঁ ইত্যাদির ঐতিহ্য এখানে রয়েছে। রয়েছে একটি অনন্য সাধারণ সুন্দরবন-যার সমপর্যায়ের আর একটি অঞ্চল পৃথিবীতে নেই। আছে কুয়াকাটা ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, পাহাড় ঘেরা পার্বত্য এলাকা চট্টগ্রাম, সিলেটের চা-বাগানসমূহের অপার সৌন্দর্য, রামু, গজনী, দুর্গাপুর, বিজয়পুর, মাধবকুণ্ড। এর কোনটিতে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র কিন্তু কোন ক্ষেত্রে পর্যটকদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে কয়েক মাইল পরিধির টোগো দ্বীপ পর্যটন খাতে প্রতি বছর বাংলাদেশি টাকায় আয় করছে ২ হাজার কোটি টাকা। আর বাংলাদেশে এ খাতে যে আয় হয়ে থাকে তা অতি নগণই বলা চলে।

আমাদের দেশের পর্যটন খাত সম্ভবনাময় হলেও এখনও বেশ সমস্যাসঙ্কুল। আমাদের সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা দুর্গম এলাকায়; বিশেষত যাতায়াত ব্যবস্থার সুবন্দোবস্ত না থাকায় এ সৈকত এখনো পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেনি। কক্সবাজারের সি-বিচে নিরাপত্তার বিষয়টি মোটেই সন্তোষজনক নয়। এখানে বেড়াতে এসে অনেকে দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে থাকেন। কক্সবাজারে সমুদ্র স্নান করতে গিয়ে অনেকেই জীবন হারান। কাজেই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া পর্যটন শিল্প বিকাশের কথা ভাবা বাতুলতা বৈ কিছু নয়। এ ছাড়াও যে সমস্ত স্থানে পর্যটন কেন্দ্রগড়ে উঠেছে সেগুলোর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। একই সঙ্গে দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থানে সময়োচিত বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে পর্যটন শিল্প বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে দিয়ে তার ভিতরেই তৈরি করতে হবে আকর্ষণী পর্যটন কেন্দ্র। ভ্রমণ যাতে সুলভ, স্বাচ্ছন্দময় ও আনন্দদায়ক হয় সে ব্যবস্থা করা গেলে স্থানীয় বা দেশীয় পর্যটক আকর্ষণ করা সহজ হবে। পর্যটন পর্যটকের জন্য রহস্যময়, রোমাঞ্চকর এবং অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ পাঠ্য পুস্তকের মতো। শুধু এর অভিজ্ঞতাটা চাক্ষুষ। মানুষের প্রতিদিনের জীবন শৃঙ্খলাবন্দী। একটু বেহিসেবি হলেই যেন সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। মানুষের মন বৈচিত্রমুখী। তীব্র পিয়াসী, সৌন্দর্য সন্ধানী। তাই ভ্রমণ ‘বিলাস’ হলেও কাম্য। আর এই বিলাসের অর্থই একটি দেশের আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস হয়ে দেশটিকে কিছুটা হলেও উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারে।

একুশ শতককে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসাবে বিশ্বব্যাপীই দেখা হচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে পর্যটনে মানুষের আগ্রহ ও অংশগ্রহণে ব্যাপকতা দেখা দেয়। বিমান চলাচল মানুষের দুর্নিবার ভ্রমণের আকাঙ্খাকে পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। দেশে দেশে সীমান্ত বিধি-নিষেধ হয়েছে সহজ, প্রতিযোগিতামূলকভাবে ভ্রমণের ব্যয় হ্রাস করা হচ্ছে। যাতায়াত সহজ আনন্দ ভ্রমণের সুযোগ প্রায় অবারিত হয়ে পড়ায় সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণের উৎসাহ উদ্দীপনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ করতো না। এখন অবকাশ যাপনে বিদেশ গমন অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। এর মাঝে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও জড়িত হচ্ছে। উন্নত দেশ ছাড়াও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মধ্যবিত্তের আয় বাড়তি থাকায় আনন্দ ভ্রমণের সুযোগ গ্রহণ করছে অনেকেই। যা পর্যটন শিল্পের জন্য সত্যিই আশাব্যঞ্জক।

উন্নত বিশ্বের পর্যটকদের কাছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব লাভ করছে। এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা প্রাচীন, আছে বিপুল ঐতিহাসিক সম্পদ ও নিদর্শন। প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে প্রকৃতি নির্ভর জীবন পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র বিন্দু। নানা বৈচিত্র্য মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, অকৃপণ জলরাশি, বন, পাহাড়ের ভূ-স্বৈর্গিক সমাহার পাশ্চাত্যের পর্যটকদের এমন আকৃষ্ট করছে। এক সময় যা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, পরবর্তীতে জাপানের একচেটিয়া তা এখন অন্যান্য অঞ্চলে সম্প্রসারিত হচ্ছে।

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো থেমে নেই। তারাও এ প্রতিযোগিতামূলক শিল্পকে হাতের মুঠোয় বাগাতে চায়। এ শিল্পকে লুফে নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, মালদ্বীপ। যে সমস্ত দেশ কঠোর রক্ষণশীল বলে পরিচিতি ছিল তারাও পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে অপেক্ষাকৃত নমনীয়ভাব প্রদর্শন করছে। যেমন-চীন, ভিয়েতনাম ও মায়ানমার। এ দেশগুলো এক সময় বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ রেখেছিল। বর্তমানে তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করে তাদের সীমান্ত দ্বারে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। এর ফলে এসব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভ্রমণ আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে। এশিয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পর্যটনের নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়ায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ছে। শিল্পে প্রতিযোগিতা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যে এগিয়ে যাবে জয়ও তার সাথে অগ্রসর হবে। পর্যটন শিল্প বিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনা বাংলাদেশের কপালে জ্বল জ্বল করছে। এখন এটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলে এ শিল্প এখানে বিকশিত হবার সুযোগ পাবে।

আমাদের দেশে পর্যটনের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগই একমাত্র উদ্যোগ। সরকার বা সরকারি উদ্যোগের সীমাবদ্ধতার কথা সব ক্ষেত্রেই আমাদের শোনা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই পর্যটনে কিছু বৈচিত্র্য ও সুযোগ সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে নিভৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানগুলোতে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলাসহ সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া দরকার।

আমাদের দেশের সমুদ্র বেষ্টিত সেন্টমার্টিনস দ্বীপ, সোনরগাঁ, সিলেটের জাফলং, মাধবকুণ্ড, হামহাম বা শেরপুরের ঝিনাইগাতি, নকলা বা গজনীকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপায়িত করা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে এ স্পষ্টগুলোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও উপযোগিতা রয়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড় এলাকার চা-বাগান, হাওর বা বিল এলাকা বা আকর্ষণীয় স্থানে পর্যটন সুবিধা নিশ্চিত করে এ শিল্পের বিকাশ সাধন করা যেতে পারে। মূলত সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ববাহী শিল্প বিকাশের অন্যতম শর্ত দেশের প্রশান্ত পরিবেশ।

দেশের পর্যটন শিল্পকে বিকশিত ও লাভজনক করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নির্বাচিত সরকারের ধারাবাহিকতা ও শান্তিপূর্ণ অনুকূল পরিবেশ। এছাড়াও দেশের সম্ভবনাময় পর্যটন স্পটগুলোকে সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধার আওতায় এনে পর্যটন বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকেও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। একই সাথে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টিও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। মূলত, বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আওতায় করণীয় সকল কিছুই করতে হবে। তবেই দেশের পর্যটন শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়া সম্ভব। অন্যথায় আমাদের পর্যটন শিল্প পশ্চাদপদই থেকে যাবে।

[email protected]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *