Samakal | Rss Feed
আমি শিক্ষার্থী হলে এনসিপিতে যোগ দিতাম না
মুক্তমঞ্চ
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাহমিদুল হক 2025-08-07
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সমকালের পক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিইউয়র্কের বার্ড কলেজের শিক্ষক ফাহমিদুল হক।
সমকাল: শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা পথ দেখাল, তাদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হলো এবং স্বৈরাচারী এক পরাক্রমশালী শাসকের পতন ঘটল, যে কারণে আমরা স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেলাম। কিন্তু খোদ তাদেরই অনেকের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিরুদ্ধে তহবিল সংগ্রহে অগ্রহণযোগ্য উপায়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তারা এক বছরের মধ্যে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ল– এটা হতাশাজনক বটে। এখানে আপনারও অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। ব্যাপারটি কীভাবে দেখছেন?
সামিনা লুৎফা: আমার কাছে মনে হয়, সমাজে দুর্নীতির একটা স্বাভাবিকীকরণের প্রবল চল রয়েছে। এর কারণ হলো, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে না। ইচ্ছা করেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে বানিয়ে রাখা হয়েছে। আপনি ১০ জনের লাইনের ১০ নম্বর ব্যক্তি। আর আপনি জানেন, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনো কাজ হবে না। সুতরাং আপনাকে যে কোনোভাবে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে যেতে হবে। এ জন্য আপনি টাকা দেবেন, মানুষকে ধাক্কা দেবেন, তারপর বাসে উঠবেন। এই যে দুর্নীতির প্রবণতা, সেটি স্বাভাবিকীকরণ করা হয়েছে। সমাজের মধ্যে যদি বেশির ভাগ মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, আর ক্ষমতার আশপাশে যাচ্ছে এমন ব্যক্তিরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এই ১০-১৫-২০টা ছেলেমেয়ে বা উপদেষ্টারা কী করতে পারবেন?
সমকাল: আপনি একজন সৎ ও স্বচ্ছ মানুষ। কিন্তু লোভনীয় সুযোগ এলে সামলাতে পারবেন না?
সামিনা লুৎফা: তাদের বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম। তাদের কারা চালায়, এ ব্যাপারে আমি জানি না।
সমকাল: নাহিদ ইসলাম তো আপনার ছাত্র।
সামিনা লুৎফা: নাহিদ আমার ছাত্র, কিন্তু সে আমার কথায় চলে না। তাদের সঙ্গে অত যোগাযোগ আমার কখনও হয়নি। আমরা শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব রেখেছিলাম, সেখানে তাদের রেখেছিলাম। প্রেশার গ্রুপ হিসেবে, শ্যাডো গভর্নমেন্ট হিসেবে, যাতে তারা জবাবদিহির মধ্যে রাখতে পারে। একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রক্ষা করা। ৪ আগস্ট আমরা যে দাবিগুলো তুলেছিলাম, সেটা যদি হতো তাহলে এত দ্রুত অনৈক্য তৈরি হতো না। কারণ ছাত্রনেতারা তিনজন ক্ষমতায় যাওয়ার ফলে বাকিরা বঞ্চিত মনে করছে। অথচ তারাও তো গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার। সরকারে যোগ দেওয়ার চেয়ে তারা যদি পুরো দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে পারত, তাহলে তরুণদের মধ্যে দেশ বদলের উদ্দীপনা অটুট থাকত। কিন্তু ৫ আগস্টের পর যা কিছু হলো, তাতে তরুণরা এতই হতাশ হয়ে গেল যে, নিজেরাই সে অবস্থান থেকে সরে গেল। এক দল তরুণ ক্যারিয়ারে ফিরে গেছে, এক দল হাল ছেড়ে দিয়েছে।
সমকাল: আপনি হলে কী করতেন?
সামিনা লুৎফা: আমার যদি বয়স ত্রিশের কম হতো, তাহলে আমি কি এনসিপিতে যেতাম? যদি তারা আমাকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইত, তাহলে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্ন আসত সেটি হলো, আসলে তারা কী চায়? এক বছর হয়ে গেছে, এখনও আমরা এই প্রশ্নের উত্তর জানি না। আমার বয়স যদি ৩০ বছরের কম হতো, যদি শিক্ষার্থী থাকতাম, আমি এনসিপিতে যোগ দিতাম না। কারণ আমি তো জানি না, তারা কী চায়।
সমকাল: কী কী বিষয় জানতে চাইতেন?
সামিনা লুৎফা: নারীর ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী; আদিবাসীদের নিয়ে তাদের অবস্থান কী; লিঙ্গভিত্তিক বৈচিত্র্যের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী; সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ব্যাপারে তারা কী ভাবছে; বাজারের ব্যাপারে তাদের কী অবস্থান; কৃষক ও মজুরের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী? এগুলো আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তাদের ম্যানিফেস্টো পরিষ্কার নয়। তারা শুধু বলে– মধ্যপন্থা আর মুজিববাদ মুর্দাবাদ। এগুলো খুবই অস্পষ্ট কথাবার্তা। হয়তো এই অস্পষ্টতা রাখলে পরে সবাইকে খুশি রাখা যায়। আমার কাছে মনে হয়, এই অস্পষ্টতার কারণে মানুষ অখুশি হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হয়, সেসব তরুণই তাদের আশপাশে রয়েছে, যারা কিছু একটা পেতে চায়। আর যারা কিছু না কিছু করতে চেয়েছিল; পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল, তারা ওদের ছেড়ে গেছে।
সমকাল: এ পথে যাওয়ার কারণে তারা কিছু পাচ্ছে, আবার অনেককে হারিয়েছে। পদযাত্রার ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
সামিনা লুৎফা: দেশব্যাপী তারা যে পদযাত্রা করেছে, এটা খুব ভালো। আমরা তাদের এটি ডিসেম্বরে করতে বলেছিলাম। তখনও যারা, অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবাররা তাদের সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছিল, তাদের কাছে যেতে শিক্ষার্থীরা এক বছর লাগিয়ে দিল। এক জুলাই থেকে আরেক জুলাইয়ে এসে তারা শহীদ পরিবারে যাচ্ছে। এটা যে করা যেত না, তা আমার অস্বাভাবিক লাগে।
সমকাল: আপনি কি দেখছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ একটা নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? সামাজিক যে সংহতি ছিল, তা নষ্ট হচ্ছে বা নষ্ট করা হচ্ছে? আপনি কি মনে করেন, নির্বাচিত সরকার এলে এটি স্বাভাবিক জায়গায় ফিরে আসবে?
সামিনা লুৎফা: না। আমি এটা মনে করি না।
সমকাল: তাহলে তো একটা হতাশার চিত্রই ফুটে উঠছে।
সামিনা লুৎফা: আমার মনে হয় না, ঠিকঠাক নির্বাচন হলে পরিবর্তন আসবে। আমার মনে হয়, আমাদের ট্রুথ কমিশন করা দরকার ছিল। আমাদের সমাজের মধ্যেই তো তারা রয়ে গেছে। যারা ভয়াবহভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত, তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই বহাল তবিয়তে বিদেশে রাজা-উজির মারছে। সমাজে যে বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে, তার প্রধান কারণ হলো ন্যায়বিচার না পাওয়া। এত লোক প্রাণ দেওয়ার পরও তো আমি ন্যায়বিচার পাইনি। ট্রুথ ও রিকনসিলিয়েশন কমিশন দরকার ছিল, যাতে এই কালেকটিভ ট্রমা ডিল করতে পারি। আমরা কালেকটিভ ট্রমা ডিল করার পথেও নেই। ফলে সমাজে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা, দূরে থাকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া বিশ্বাস ও আস্থার অভাবও প্রবল। আর দেখবেন বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড। আপনি বাদী, আপনি বিচারকারী এবং শাস্তি দানকারী। এটা তো রাষ্ট্রে ঘটতে পারে না। রাজনৈতিকভাবে একটা খুবই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখানো, যা কোনো না কোনোভাবে কারও স্বার্থ হাসিল করে। সুতরাং যারা এক বছর ধরে বাংলাদেশকে নানাভাবে অস্থিতিশীল করে তুলছে, তাদের আমরা চিনি। কিছু একটা হলেই বুলডোজার, ভাঙো, হাতুড়ি আনো– এগুলো সঠিক প্রক্রিয়া নয়। শত শত মামলা হচ্ছে। গোপালগঞ্জের ঘটনায় ইতোমধ্যে ১৫ হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
সমকাল: আপনি তো সেখানে গিয়েছিলেন।
সামিনা লুৎফা: হ্যাঁ, সেখানে একটা ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। দেশের ভেতরে, একটা জেলার ভেতরে এভাবে নির্বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায়? এনসিপির মঞ্চ ভেঙে তাদের ব্যানার নিয়ে যাওয়া হয়েছে; এটা ভিডিওতে আমরা দেখেছি। যেখানে ৪০-৫০ জনের একটা গ্রুপ। তার মধ্যে ৮-১০ জন মঞ্চে উঠেছে। খুব দ্রুত তারা ওখান থেকে নেমে গেছে। যে মূহূর্তে এনসিপির কয়েকজন তাদের ধাওয়া দিয়েছে, তখনই তারা পালিয়ে গেছে। তাদের পেছনে অপেক্ষমাণ জনতা– দুশর বেশি হবে না। এর মানে, আমরা ধারণা করি যে জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে আওয়ামী লীগের লোকজন এসেছিল। কিন্তু পরে আমরা যেটা শুনি, সমাবেশ শেষ হওয়ার পরপর যখন এনসিপি নেতারা আক্রমণের শিকার হয়, তখন পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি হবে– কেউ বলেনি। সেখানে তিন-চারটা উপজেলা মিলে ১৫ হাজার মামলা হয়েছে বা ১০ হাজারের মতো।
সমকাল: একজন দর্শনার্থীর কাছে শুনেছি, হামলাকারীদের গোপালগঞ্জবাসী বলা চলে। আওয়ামী লীগ বলার সুযোগ নেই।
সামিনা লুৎফা: এটা বলা কঠিন। কারণ আমরা তো আসলে জানি না। কে আওয়ামী লীগ, কে আওয়ামী লীগ নয়; সেটা বলা সম্ভব নয়। এটা এক ধরনের তাদের ইমোশনের ব্যাপারও। হয়তো আওয়ামী লীগ ঘটনায় প্ররোচনা দিয়েছে। কিন্তু এটাও সত্যি, সাত-আট দিন ধরে ওই প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছিল। তা পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনে জানানো হয়েছিল। কিছুই হবে না! পুলিশের এত আত্মবিশ্বাস! যদি ওই দিন এনসিপির কারও কিছু হতো, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি কী দাঁড়াত? এত দায়িত্বশীল প্রশাসন! আগে থেকে যদি সেনাবাহিনী সেখানে মোতায়েন করা থাকত, তাহলে জনতা এতটা আক্রোশ না-ও দেখাতে পারত। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সেনাবাহিনীকে এখনও ভয় পায়। শুধু পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না– সেটা তো তাদের জানা থাকার কথা। পরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রয়োজনও হতো না। এটা শুরুতেই ব্যবস্থা করা যেত। আমার মনে হয়েছে, শুরু থেকেই বিভিন্ন বিষয় উপেক্ষা করে এই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এনসিপি যাওয়ার আগেই তো আমরা শুনেছি, বিভিন্ন রিল বানিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। এই যে দুই পক্ষের সংঘাতময় ও বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা, এগুলোর সংস্কৃতি থেকে বেরোতে না পারলে আমরা আবারও পুরোনো জায়গায় আটকা পড়ব।
সমকাল: এনসিপির পদযাত্রা যতটা সুন্দর ছিল, গোপালগঞ্জের ঘটনায় সেটা ততটা কালিমালিপ্ত হয়ে গেল।
সামিনা লুৎফা: তা তো বটেই। এই বাড়াবাড়ি হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। আমরা মনে করি, তাদের গুলি করে তাজা প্রাণহানির কোনো যুক্তিই ছিল না। তার আগেই ঘটনার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যেত।
সমকাল: কেউ কেউ বলেন, ইরানে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেখানে রেজা শাহ পাহলভির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু সেখানে ক্ষমতায় চলে গেছেন ডানপন্থিরা। আর বামপন্থি, লিবারেল গোষ্ঠীগুলোকে ডানপন্থিরা ক্ষমতায় গিয়ে বিভিন্নভাবে শাস্তি দিয়েছে। ইরান দীর্ঘদিনের একটা ডানপন্থি প্রশাসনের অধীনে চলে গেল, যার জন্য দেশটি ভুগছে। অতিডানপন্থিদের আমরা এ জন্যই সমালোচনা করি। কারণ তারা শুধু গোষ্ঠীগত বা ধর্মীয় হলে ধর্মীয় সীমানায় আবদ্ধ থেকে অন্যদের ওপর তা চাপিয়ে দেয়। আমাদের দেশেও জুলাই অভ্যুত্থানের পর ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে বা তাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন একটা আশঙ্কা রয়েছে যে, ডান-বাম সবার সম্মিলিত আন্দোলনের ফসল পরিশেষে ডানপন্থিদের ফসলে রূপ নেবে। সার্বিকভাবে এই ডানপন্থার উত্থানকে আপনি কীভাবে দেখেন? আর সামনের দিনে কী পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে?
সামিনা লুৎফা: সামনের দিনগুলো আমাদের ওপর নির্ভর করছে। আমরা যদি উদার গণতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলো একত্র হতে না পারি, তাহলে ডানপন্থিরা ছেড়ে দেবে না। তারা সেটি কাজে লাগাবে। ইতোমধ্যে তারা কাজে লাগাচ্ছে। এই যে ৫ শতাংশের বেশি নারীদের মনোনয়ন আমরা আদায় করতে পারলাম না; এর কারণ হচ্ছে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করিনি। যৌথভাবে কাজ করিনি; আমরা সংগঠিত হতে পারিনি। বামপন্থি দরকার নেই; আমার কথা হলো, উদার গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্নরাও সঙ্গে বসুক। এটাও সত্য, বড় ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনের পর নানা রকম অস্থিরতা আসে। এটি তো পৃথিবীর সব দেশেই এসেছে। এর উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে শ্রীলঙ্কাও রয়েছে। এত বড় অভ্যুত্থান, এত বড় অর্থনীতি ধসে যাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, সেখানে বৃহদাকার একটি উদার গণতান্ত্রিক গোষ্ঠীর মধ্যে জোট হয়েছে, যেখানকার নেতৃত্বে বামপন্থিরা রয়েছে। বায়ান্নের ভাষা সংগ্রাম থেকেও যদি দেখি, আন্দোলন-সংগ্রামে যে চিন্তাগত বা দার্শনিক জায়গাটি রয়েছে, এটা তো সব সময় বামপন্থিরাই তৈরি করতে পেরেছে। এমনকি গণঅভ্যুত্থানের শেষের দিকে এসে, যে শিক্ষকরা বলেছেন যে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে; তাদের কেউই তো উগ্র ডানপন্থার নয়। সবাই উদার গণতান্ত্রিক চিন্তার মানুষ। উদার গণতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যদি জোট গড়ে না ওঠে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ডানপন্থা এই সুযোগ গ্রহণ করবে। সুতরাং আমরা যদি বসে বসে ভাবি যে, এই সরকার কেন কিছু করছে না, তাহলে কিছু হবে না। আমরা যদি মনে করি, ইউনূস সরকার মানবাধিকারের সবকিছু করে দেবে, তাহলে আমরা পুরোপুরিভাবে একটা বোকার স্বর্গে বাস করছি। আমাদের সংগঠিত হয়ে চাপ দিতে হবে। অন্যথায় কেউ কিছু করবে না।
সমকাল: ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সময় আছে ছয় মাস। তারপর নির্বাচনের পর অন্তত দুই বছরের চিত্র আপনি কীভাবে দেখেন?
সামিনা লুৎফা: খুব সুবিধার দেখছি না। এখন যা দেখছি, তাতে বলতে পারি, যদি আমরা এই অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্ত হয়ে একটি পরিবেশ তৈরি করতে না পারি, তাহলে খুবই অশান্তির অবস্থা তৈরি হবে। আমরা জানি, অশান্তি তৈরি করার একটা বিরাট শক্তি রয়েছে। তার মানে এই নয়, তাদের হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দিতে হবে। এগুলোর মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে না। সমাধান করতে হবে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন প্রসেসে। নির্দোষ ব্যক্তিরা যাতে সাজা না পায়; দোষীরা যেন একমাত্র শাস্তি পায়। সেই জায়গায় পৌঁছাতে হলে যে প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা থাকা দরকার, সেটি আমরা এক বছরে পাইনি। আমরা দেখেছি, কেউ কেউ বাণিজ্য করে নাম ঢুকিয়ে দিচ্ছে। নাম মুছে ফেলার জন্য টাকা নেবে। এই যে প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা ঢুকে গেছি, সে কারণে বিচার হয় না এবং প্রতিশোধস্পৃহা মানুষের মধ্যে এত প্রবল হয়ে উঠেছে। এই সমস্যা যদি আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে না পারি, তাহলে সমাজে অস্থিতিশীলতা রয়ে যাবে। সুতরাং আমাদের দরকার কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
সমকাল: সেটা কীভাবে?
সামিনা লুৎফা: যে কোনো কিছুর ক্রাইটেরিয়া তৈরি করতে হবে। আপনি শিক্ষক হতে চান, তাহলে সুনির্দিষ্ট বিষয় আপনার লাগবে। এর বাইরে আমরা নেব না। কয়েক বছর যদি এগুলো জোরালো অনুসরণ করা যায়, তাহলে হয়তো কিছু পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন হয়, তাহলে মনে হয় না কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবে। নির্বাচিত সরকারও চাপের মুখে নড়বড়ে হয়ে পড়বে। নির্বাচিত সরকার ঠিক রাখার জন্যই আসলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। সে জন্য আমাদের খুব সজাগ থাকতে হবে। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়নি; সেটা শুরু হয়েছে।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।
সামিনা লুৎফা: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।