ইউক্রেনে কেমন বিজয় চান পুতিন, কেন ডনবাস গুরুত্বপূর্ণ

Google Alert – সামরিক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিয়েভবিরোধী অবস্থান নিয়ে কথা বলার সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে কোনও উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর পুতিনের সঙ্গে তার প্রথম আলাপ হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারি। ওই সময় পুতিন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার আলোচনার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করা।

এরপর ১৮ মার্চ তারা আবার প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলেন। ক্রেমলিন জানায়, দুই নেতা ইউক্রেন সঙ্কটের সমাধানে দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

পুতিনের উল্লাস প্রকাশ্য না হলেও মস্কোর আনন্দ আড়াল করা কঠিন।

ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ফোনালাপের দুই সপ্তাহ পর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। আমরা অবশ্যই একে স্বাগত জানাই।”

দ্বিতীয় ফোনালাপের পর ক্রেমলিন ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল এই কারণে যে তিনি শত্রুতার অবসানে সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কৃতজ্ঞ না হওয়ার কারণও নেই। মাত্র দুই মাসের মধ্যে ট্রাম্প রাশিয়াকে এমন প্রতীকী ও বাস্তব সাফল্য এনে দিয়েছেন, যা মস্কো কল্পনাও করেনি।

ওভাল অফিসে ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্কের পর ট্রাম্প সাময়িকভাবে কিয়েভকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা স্থগিত করেন।

ওয়াশিংটন রাশিয়ার নেতাদের যুদ্ধাপরাধ তদন্তে গঠিত একটি দল থেকেও সরে দাঁড়ায়। ট্রাম্প ও তার শীর্ষ কর্মকর্তারা রাশিয়ার প্রচারিত ভ্রান্ত তথ্যও বারবার পুনরাবৃত্তি করেন এবং যুদ্ধের জন্য কিয়েভকেই দায়ী করতে থাকেন।

রাশিয়ার নেতৃত্ব জানে, ট্রাম্পের এই উষ্ণতা স্থায়ী নাও হতে পারে। তিনি আবেগপ্রবণ এবং মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে অস্থির। তার প্রথম মেয়াদের অভিজ্ঞতাই সতর্কবার্তা হিসেবে আছে।

তখন ক্রেমলিন আশা করেছিল যে সম্পর্ক উন্নত হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং হোয়াইট হাউস ইউক্রেনকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করে।

তাই এবার ক্রেমলিন নিশ্চিতভাবে জানে, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের সব দাবিই নিঃশর্তে মেনে নেবে, এমনটা ভাবা অবাস্তব।

তবুও মস্কো যতটা সম্ভব ট্রাম্প থেকে সুবিধা নিতে প্রস্তুত।

ক্রেমলিন আশা করছে, পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে একান্ত বৈঠক হবে, যেখানে তারা ইউক্রেন যুদ্ধ সাময়িকভাবে থামাতে একটি চুক্তি করবেন। এটাই ট্রাম্প চান। এর বিনিময়ে ইউক্রেনকে দুর্বল করে দেওয়ার মতো নানা শর্ত চাপিয়ে দিতে চাইবে রাশিয়া।

পুতিন এমন এক চুক্তি চান, যা কিয়েভের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডে নানা সীমাবদ্ধতা আরোপ করবে এবং ইউক্রেনীয় রাজনীতিতে মস্কোর স্থায়ী প্রভাব নিশ্চিত করবে। তবে অন্তত পশ্চিমা সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে পারলেও তিনি সন্তুষ্ট হবেন।

ক্রেমলিন মনে করে, এই সহায়তা বন্ধ হলে মস্কোই ইউক্রেনকে পরাজিত করবে। এমনকি ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও পুতিন খুশি হবেন। কারণ এতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন স্থায়ীভাবে প্রত্যাহারের অজুহাত পাবেন।

পুতিন জানেন, ইউক্রেন নিয়ে ট্রাম্পকে পুরোপুরি তার পাশে না আনলেও অন্তত যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের অন্য দিকগুলোতে উন্নতি সম্ভব হতে পারে, যা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবে। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হলে পুতিন তার আগের কৌশলেই থাকবেন।

রুশ অর্থনীতি দুর্বল হলেও স্থিতিশীল। ইউক্রেনের তুলনায় তাদের বিশাল জনবল সুবিধা রয়েছে। পুতিন আশা করছেন, ওয়াশিংটন নীরবে তাকে ইউক্রেন জয়ে সাহায্য করবে। সাহায্য না পেলেও তিনি লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত।

সবচেয়ে বড় সম্পদ

২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প জেতার পর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্রেমলিন তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করে। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার চ্যানেল ব্যবহার করে। একই সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে পুরনো যোগাযোগও পুনরায় সক্রিয় করে।

বিশেষ করে রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের প্রধান কিরিল দিমিত্রিয়েভ, ট্রাম্পের জামাতা জ্যারড কুশনার ও পরিবারের আরও সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ স্টিভ উইটকফের কাছে পৌঁছান।

উইটকফ তখন মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত ছিলেন। এখন মস্কোর সঙ্গেও কূটনীতি তত্ত্বাবধান করছেন। এই সংযোগের ফলেই বন্দি বিনিময় সম্ভব হয় এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রিয়াদে একটি আলোচিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সেখানে উপস্থিত ছিলেন দিমিত্রিয়েভ, উইটকফ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও ক্রেমলিন উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ। বৈঠকে যুদ্ধের অবসান ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই যোগাযোগের মাধ্যমেই ট্রাম্প ও পুতিনের দুইবার ফোনালাপ হয়। এই আলাপগুলো ট্রাম্পের মনোভাবকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ট্রাম্প কখনোই জেলেনস্কির ভক্ত ছিলেন না। কিন্তু ১২ ফেব্রুয়ারির পুতিনের সঙ্গে আলাপের পর থেকেই তিনি রাশিয়ার বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন।

ট্রাম্প জেলেনস্কিকে ‘স্বৈরাচারী’ বলা শুরু করেন এবং ইউক্রেনের দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, পুতিনও ট্রাম্পের প্রচারিত দাবি সমর্থন করতে থাকেন যে, ২০২০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ‘চুরি’ না হলে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রয়োজন হতো না। সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা হিসেবে পুতিন ট্রাম্পের আত্মমুগ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে ক্রেমলিনের দৃষ্টিভঙ্গি তার মাধ্যমে প্রচার করাতে সক্ষম হন।

তবে পুতিনের কৌশল কেবল ট্রাম্পের দুর্বলতা কাজে লাগানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। রাশিয়া ট্রাম্পের বৈশ্বিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক, এমন প্রচারও চলতে থাকে। রাশিয়া ইরান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় সাহায্য করার ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা সামরিক বাজেট অর্ধেক কমানোর ট্রাম্পের ধারণাকে সমর্থন করেছে এবং এমনকি চীনকেও এতে যুক্ত করতে সাহায্যের আভাস দিয়েছে।

রুবিও ও ভান্স পর্যন্ত বলেছেন, হয়তো ‘রিভার্স নিক্সন’ কৌশল নেওয়া সম্ভব।

অর্থাৎ চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। যেমন ৫০ বছর আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সন করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করতে। কিন্তু বাস্তবে এটা নিছক বিভ্রম।

ক্রেমলিন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলবে না। বিশেষত যখন আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিই আবার বদলে যেতে পারে। তবুও মস্কো রুবিও, ভান্স ও ট্রাম্পকে আশ্বস্ত করেছে, যেন মনে হয়, ওয়াশিংটন যদি কিছুটা ছাড় দেয় তবে রাশিয়া হয়ত চীনের ঘনিষ্ঠতা কিছুটা কমাতে পারে।

সবশেষে এটা স্পষ্ট যে, পুতিন ট্রাম্পের আত্মকেন্দ্রিকতা কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, তা বুঝে গেছেন।

সর্বশেষে মস্কো ইঙ্গিত দিয়েছে, বর্তমান সংঘাত শেষ হলে দুই দেশের মধ্যে বহু ব্যবসায়িক চুক্তি হতে পারে। রিয়াদে দিমিত্রিয়েভ একটি উপস্থাপনা দেন। সেখানে তিনি ভুয়া দাবি করেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে।

প্রকাশ্যে না বলা হলেও অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত ছিল, ট্রাম্পের আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠরা বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু হলে উপকৃত হতে পারেন। বিশেষত দিমিত্রিয়েভ তাদের ও সৌদি ব্যবসায়িক অংশীদারদের ভালোভাবেই চেনেন।

এই প্রেক্ষাপটে ক্রেমলিন ইউক্রেন যুদ্ধকে এক মহৎ অংশীদারত্বের পথে একটি অপ্রিয় বাধা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কিয়েভের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দাবিতে ট্রাম্পের বিরক্তিকে উসকে দিয়ে তারা তাকে বোঝাতে চেয়েছে, আলোচনার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় জেলেনস্কি।

পুতিন আরও দাবি করেছেন, জেলেনস্কির গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নেই এবং ইউক্রেনকে নতুন নির্বাচন করতে হবে যেকোনো চুক্তির আগে। এই বক্তব্য ট্রাম্প সানন্দে গ্রহণ করেছেন।

কিন্তু জেলেনস্কি শান্তি আলোচনায় অনিচ্ছুক। কারণ যুদ্ধ তার দেশের অস্তিত্বের লড়াই এবং তিনি ক্রেমলিনকে গভীরভাবে অবিশ্বাস করেন। পুতিন নিজেকে নমনীয় দেখালেও রুশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ দাবিগুলোতে অটল থাকতে।

গত জুনে উত্থাপিত সেই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, রাশিয়ার দাবি করা সব ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ মস্কোর হাতে দেওয়া, সেই অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া, ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তর করা, সামরিক বাহিনী ছোট করা, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি বাতিল করা এবং ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রুশভাষী জনগণ ও রুশ অর্থোডক্স চার্চের জন্য বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করা। এগুলো কার্যকর হলে ইউক্রেনের ভেতরকার রাজনীতিতেও মস্কোর প্রভাব স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

ক্রেমলিন জানে, ট্রাম্প এখনই হয়তো সব দাবি মানবেন না। তবুও ওয়াশিংটন যেভাবে ধীরে ধীরে মস্কোর দিকে ঝুঁকছে, তাতে আশা করছে ভবিষ্যতে ট্রাম্পকে পুরোপুরি তাদের শর্তে আনা সম্ভব হবে। এর সম্ভাবনা বাড়বে যদি পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে একান্ত বৈঠক নিশ্চিত করতে পারেন, যেখানে ইউক্রেনপন্থী কোনও মধ্যস্থতাকারী থাকবে না।

২০১৮ সালে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ে রুশ নেতাকে বেশি বিশ্বাস করেন। তাই ক্রেমলিন মনে করে, এবারও ট্রাম্প পুতিনের শর্ত মেনে নিলে তাকে থামানোর মতো আর কেউ থাকবে না। আমলাতান্ত্রিক কাঠামো তিনি ভেঙে ফেলেছেন এবং এখন কংগ্রেসও তার অনুগতদের নিয়ন্ত্রণে।

আপাত স্বস্তি

ট্রাম্প অবশ্য নিজের কার্ড গোপন রাখেন এবং প্রায়ই মত বদলান। তিনি হয়ত পুতিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেওয়া বা দেশটিকে পুরোপুরি মুছে ফেলার পক্ষে নন। যদিও একসময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন, একদিন ইউক্রেন রাশিয়ার অংশ হতে পারে। আপাতত তিনি শুধু তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি চান।

কিন্তু ক্রেমলিন মনে করে, ট্রাম্পের এই যুদ্ধবিরতির ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে এমন এক চুক্তি করা সম্ভব, যা মূলত রাশিয়ার স্বার্থরক্ষাকারী। এতে ইউক্রেনের পশ্চিমা সামরিক ও নিরাপত্তা জোটগুলো ভেঙে যাবে। ক্রেমলিনের স্বপ্নের চিত্র হলো, ন্যাটো রাষ্ট্রগুলো প্রতিশ্রুতি দেবে, তারা কিয়েভকে আর অস্ত্র বা গোয়েন্দা তথ্য দেবে না।

মস্কো জানে, পশ্চিমা সহযোগিতাই ইউক্রেনকে প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় উন্নত করেছে এবং রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করছে। এই অংশীদারিত্বই পুতিনের পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় হুমকি। তাই ট্রাম্প এই শর্ত মেনে নিলে পুতিন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন।

১৩ মার্চ সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে বক্তব্যে পুতিনও প্রথমেই এই শর্তগুলো সামনে আনেন, ইউক্রেনের সেনা মোতায়েন বন্ধ করার দাবিসহ। যুক্তরাষ্ট্র এগুলো চাপিয়ে দিলে মস্কো যুদ্ধবিরতির সুযোগে পুনরায় অস্ত্র মজুত করবে এবং চাইলে ট্রাম্পের মেয়াদ শেষে আরও দুর্বল ইউক্রেনকে আবারও আক্রমণ করতে পারবে।

ট্রাম্প এমন শর্ত মেনে নিলেও হয়তো তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। হোয়াইট হাউস ইউরোপীয় দেশগুলোকে জোর করে ইউক্রেনের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করাতে পারবে না। কিন্তু ক্রেমলিন আশাবাদী যে, তিনি তাদের প্রভাবিত করতে পারবেন।

ট্রাম্প কিয়েভকে ছেড়ে দিতে ইউরোপকে চাপ দিলে অনেক দেশ হয়তো নিজেদের নিরাপত্তা চুক্তি রক্ষার স্বার্থে রাজি হয়ে যাবে। এমনকি তারা অস্বীকার করলেও ট্রাম্প তাদেরই দোষারোপ করতে পারেন যুদ্ধবিরতি ভেস্তে দেওয়ার জন্য। এরপর তিনি স্থায়ীভাবে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ করতে পারেন। এইটুকুই ক্রেমলিনের জন্য বিশাল সাফল্য হবে।

ইউক্রেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখনও ব্যাপকভাবে বাইরের সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। আর এর প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র।

চুক্তি হোক বা না হোক

ক্রেমলিন আশা করছে, ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের আলোচনায় কিছু না কিছু লাভ হবেই। তবে যদি সবকিছু ব্যর্থও হয়, তবুও রাশিয়া আত্মবিশ্বাসী। ট্রাম্প জেতার আগেই তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিল, আজও আছে।

ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার জনশক্তি সুবিধা বিশাল এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। উদার সাইন-আপ বোনাস মানুষকে দলে টানছে। অনেকে মনে করছেন যুদ্ধ শেষের পথে, তাই টাকা আয় করতে ঝুঁকছেন। রাশিয়া আরও এক দফা আংশিক সেনা মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত।

গত এক বছরে সরকার বড় নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে কাজ করে সামরিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মীদের তালিকা করেছে, যাতে সহজে তাদের ডাকা যায়। আবার যারা অর্থনীতিকে সচল রাখতে অপরিহার্য, তাদেরও আলাদা তালিকায় রাখা হয়েছে, যেন যুদ্ধের জন্য না নেওয়া হয়।

যুদ্ধ চললে এবং নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলে রুশ অর্থনীতি অবশ্যই সমস্যায় পড়বে। তবুও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় দক্ষ কর্মকর্তাদের হাতে, যারা বড় বিপর্যয় ঠেকাতে পারবে। ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে রাশিয়ার বাজেট ব্যয় রেকর্ড ৯৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার বেশিরভাগই সামরিক খাতে।

এর ফলে মন্দা ঠেকানো গেছে। আর ২১ শতাংশ সুদের হার মুদ্রাস্ফীতি লাগাম টেনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস, যদি রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি সম্পদ যুদ্ধে না ঢালা হয়, তবে অর্থনীতি ধীরে ধীরে শীতল হবে। প্রবৃদ্ধি কমবে, তবে নিয়ন্ত্রিতভাবে। আর এতে মুদ্রাস্ফীতি নামবে। বড় কোনও আর্থিক ধস বা বিপর্যয় ঘটবে না।

তবে এসব মানেই নয় যে রাশিয়া নিশ্চিতভাবে ইউক্রেনকে হারাবে। যুদ্ধ অনিশ্চিত। গত তিন বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, ইউক্রেন ও ন্যাটোর সহযোগিতা কারও কল্পনার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। যদি ইউরোপ সহায়তা চালিয়ে যায় এবং কিয়েভ জনবল সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে, তবে রাশিয়ার অগ্রযাত্রা থেমে যেতে পারে।

আর যদি মানবক্ষয় বাড়ে, অস্ত্র মজুত কমে যায় এবং অর্থনীতি স্থবির হয়, তবে পুতিন হয়তো অর্জিত অবস্থান ধরে রাখতে চাইবেন। তখন তিনি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে পারেন বর্তমান নিয়ন্ত্রণ রেখা ধরে রেখেই। এতে ইউক্রেন সব ভূখণ্ড ফিরে না পেলেও স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে, ভবিষ্যতে আগ্রাসন ঠেকানোর সক্ষমতাসহ।

আলাস্কায় শুক্রবার বৈঠকে বসেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৈঠক থেকে কোনও চুক্তি বা যুদ্ধবিরতি হয়নি। কিন্তু ট্রাম্প বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। 

ট্রাম্প চাইছেন ২০২২ সালের পূর্ণমাত্রার আক্রমণের পর থেকে চলতে থাকা বিধ্বংসী যুদ্ধের ইতি টানতে। ইউক্রেনকে ঘিরে যেকোনো শান্তি চুক্তিতে ভূমি-সংক্রান্ত সমঝোতার বিষয়টি থাকবে। ইউক্রেনে দখলকৃত জায়গা ছাড়তে চাইছেন না পুতিন। এনিয়ে চলছে বচসা। বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় পাঁচভাগের একভাগ ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে।

মস্কোতে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের কাছে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ইউক্রেনকে ডনবাস অঞ্চলের অবশিষ্ট অংশ, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক ছেড়ে দিতে হবে।

কিন্তু এই সপ্তাহে দনেৎস্কের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গেছে। রুশ সেনারা দোব্রোপিলিয়ার উত্তর-পূর্বে অগ্রগতি অর্জন করেছে। ফলে যে এলাকা নিয়ে উইটকফ ক্রেমলিনের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তার নিয়ন্ত্রণ বদলেছে। 

রাশিয়ার হাতে ফেরত দেওয়ার মতো বেশি কিছু নেই। তারা সীমান্তবর্তী সুমি ও খারকিভের ছোট কিছু এলাকা দখল করেছে, যেগুলোকে ক্রেমলিন “বাফার জোন” বলছে। কিন্তু এগুলো খুবই ক্ষুদ্র এবং মূলত ইউক্রেনের অংশ, রাশিয়ার নয়।

অবশ্য রাশিয়ার সংবিধানও দাবি জিইয়ে রেখেছে যে, ইউক্রেন ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ। এজন্য তারা দখলকৃত চারটি অঞ্চলকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে সংযোজন করেছে।

বর্তমানে রাশিয়া দনেৎস্কের বেশিরভাগ ও লুহানস্কের প্রায় পুরোটা দখলে রেখেছে। তবে খেরসনের দুই-তৃতীয়াংশ ও জাপোরিঝিয়ার সমান অংশ তাদের হাতে। খেরসনের একাংশ ২০২২ সালের শেষের দিকে ইউক্রেন মুক্ত করে নেয়।

পুতিন কি ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা খেরসন ও জাপোরিঝিয়ার অংশ ছেড়ে দিতে রাজি হবেন? সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ইউক্রেনের পক্ষে এসব এলাকা ছেড়ে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এতে বিশাল এলাকা, এমনকি প্রাণচঞ্চল জাপোরিঝিয়া শহরও রাশিয়ার হাতে চলে যাবে।

পুতিনের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ দনেৎস্ক ও লুহানস্ক

পূর্ব ইউক্রেনের দনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে গঠিত দনবাস। এই অঞ্চলটি নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। 

দনবাস দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনের ভারি শিল্পের কেন্দ্র। এখানে কয়লা, ইস্পাত ও মেশিন নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠেছে। অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে রাখা মানে মস্কোর হাতে কোকিং কয়লা ও ইস্পাত শিল্পে প্রভাব খাটানোর সুযোগ পাওয়া। যুদ্ধ চলাকালে কিয়েভ এই শিল্পগুলো সচল রাখতে সংগ্রাম করেছে। যেমন: ইউক্রেনের একমাত্র কোকিং কয়লার খনি পোক্রভস্ক বারবার বন্ধ হওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে। ডনবাসের শিল্পভিত্তি অর্থনৈতিকভাবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কৌশলগত দিক থেকেও ইউক্রেনকে দুর্বল করে দেয়।

দনবাস হলো ক্রিমিয়ার বাইরে রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তভাবে সুরক্ষিত সামরিক ফ্রন্ট। খেরসন থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর রাশিয়া এখানে নতুন করে সৈন্য মোতায়েন করে। কারণ দনেৎস্ক ও লুহানস্ক হাতে থাকলে রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চল থেকে সরবরাহ লাইন ছোট হয়ে যায়। একই সঙ্গে এটি রুশ ভূখণ্ডকে রক্ষা করার জন্য একটি প্রতিরক্ষামূলক ঢাল তৈরি করে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস ও দ্য ইকোনমিস্ট ডনবাসকে বারবার যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বর্ণনা করেছে, যেখানে সংঘাতের পরিণতি নির্ধারিত হয়।

২০১৪ সাল থেকে ক্রেমলিনের প্রধান প্রচার ছিল দনেৎস্ক ও লুহানস্কের রুশভাষী জনগণকে ‘রক্ষা করা’ এবং কিয়েভকে মিনস্ক চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য করা। ২০২২ সালে ‘জনগণের প্রজাতন্ত্র’গুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং পরে দনেৎস্ক ও লুহানস্ককে রাশিয়ার অংশ হিসেবে দাবি করা হয়। এতে পুতিন যুদ্ধকে ‘রুশ ভূমি রক্ষার লড়াই’ হিসাবে উপস্থাপন করেন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া কূটনীতির আলোচনায় শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, পুতিনের কাছে দনেৎস্ক ও লুহানস্কের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই যেকোনো শান্তি চুক্তির প্রধান শর্ত। কারণ এই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়া মানে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও রাজনীতি ভেঙে পড়া। এই বাস্তবতা দেখায় যে দনবাস রাশিয়ার কাছে একই সঙ্গে দরকষাকষির অস্ত্র ও যুদ্ধজয়ের লক্ষ্য।

কয়লার বাইরেও দনবাস আরও বড় সম্পদ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত। রয়টার্সসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ২০২২ সাল থেকে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে জ্বালানি ও গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল রয়েছে, যা ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিয়েভকে এই সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলে তার খরচ বাড়ে এবং রপ্তানি আয় কমে যায়। বিপরীতে এই সম্পদ দখলে রাখা মস্কোর জন্য সহায়ক। কারণ এটি নিষেধাজ্ঞার চাপে থাকা রুশ অর্থনীতিকে সচল রাখছে।

দনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখলে রাখলে রাশিয়া রোস্তভ-অন-ডন থেকে রেল ও সড়কপথে সহজে সরবরাহ চালাতে পারে। এর মাধ্যমে দখলকৃত পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনকে সংযুক্ত রাখা হয়। একই সঙ্গে আজভ সাগরের উপকূল এবং আরও দক্ষিণাঞ্চলে অভিযান পরিচালনা সহজ হয়। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস ও দ্য ইকোনমিস্ট বিশ্লেষকরা একে রাশিয়ার বিস্তৃত অবস্থানের মূলভিত্তি বলেছেন, যা ক্রিমিয়ার স্থল করিডরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

পুতিনের জন্য দনেৎস্ক ও লুহানস্ক হলো সামরিক শক্তির গভীরতা, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক বয়ানের সমন্বিত কেন্দ্র। তাই যুদ্ধবিরতির আলাপে পুতিন দনবাস ভূখণ্ড ইস্যুতে কোনও ছাড় দিতে রাজি নয়।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *