ইউরোপের হুমকি, রাশিয়া-চীনের বিরোধিতা ও

Bangla News

সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি (ই-থ্রি) ইরানের বিরুদ্ধে ‘স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম’ সক্রিয় করার হুমকি দিয়েছে। এর জবাবে ইরানও পাল্টা পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছে।

রাশিয়া ও চীন এই হুমকিকে বেআইনি ও বিপজ্জনক হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে, ফলে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে পশ্চিম এশিয়া ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

ইরানের বিরুদ্ধে ই-থ্রি’র হুমকি


ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিবকে লেখা এক চিঠিতে জানিয়েছে, পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আগস্টের শেষ নাগাদ যদি কোনো কূটনৈতিক সমাধান না পাওয়া যায়, তবে তারা ইরানের ওপর জাতিসংঘ অনুমোদিত নিষেধাজ্ঞা তথা ‘স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম’ সক্রিয় করার জন্য প্রস্তুত।


জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে লেখা চিঠিটি গত বুধবার (১৩ আগস্ট) প্রকাশিত হয়। এতে ইউরোপীয় ত্রয়ী ঘোষণা করেছে যে, ইরান যেন কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য তারা নিজেদের হাতে থাকা সব ধরনের কূটনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।  


এ বিষয়ে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেন, আমরা স্পষ্ট করে দিয়েছি যে, ইরান যদি আগস্ট ২০২৫-এর শেষ নাগাদ কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে রাজি না হয় অথবা বর্ধিত সময়ের সুযোগ কাজে না লাগায়, তবে ই-থ্রি (ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি) স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম সক্রিয় করতে প্রস্তুত।  


‘স্ন্যাপব্যাক’ সক্রিয় করার প্রেক্ষাপট  


২০১৫ সালে ছয় বিশ্ব শক্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করেছিল ইরান। এই চুক্তির আনুষ্ঠানিক নাম জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানির পাশাপাশি চীন ও রাশিয়া সই করেছিল। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য এই চুক্তি করা হয়েছিল, যাতে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে।  


চুক্তি করার বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে একতরফা বের হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে চুক্তিটি একপ্রকার বাতিল হয়ে যায়। ইউরোপীয়রাও আজ পর্যন্ত নিজেদের অঙ্গীকার পূরণ করেনি।


তারা ব্যর্থতার দায় স্বীকার ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বদলে এখন ইরানকে স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া সক্রিয় করার হুমকি দিচ্ছে। ইউরোপীয় ত্রয়ী তাদের যৌথ চিঠিতে অভিযোগ করেছে যে, ইরান চুক্তি ভঙ্গ করে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ৪০ গুণ বেশি ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে।


ই-থ্রি’র দাবি, জেসিপিওএ’র স্বাক্ষরকারী হিসেবে তারা জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবের অধীনে স্পষ্ট ও বৈধভাবেই স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম সক্রিয় করতে পারবেন, যা ইরানের ওপর পুনরায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিষিদ্ধ করবে এবং জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করবে।


তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাকচি সম্প্রতি ইউরোপের হুমকির প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ইউরোপীয়দের ব্রাসেলস চুক্তির কোনো ধারা, বিশেষ করে স্ন্যাপব্যাক ব্যবহারের যোগ্যতা নেই। আমাদের ও ইউরোপের মধ্যে এটি একটি আইনগত চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে আমাদের হাতে বিভিন্ন উপায় আছে এবং আমরা চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করছি। যদি শেষ পর্যন্ত তারা এটি চালু করে, আমাদেরও প্রতিক্রিয়ার উপায় আছে, যা উপযুক্ত সময়ে ঘোষণা করা হবে।  

 




২০১৫ সালে পরমাণু সমঝোতা স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ, ইইউ পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ফেদেরিকা মোগেরিনিসহ ৫+১ গ্রুপের প্রতিনিধিরা 


স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম কী?


জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানির সই করা ২০১৫ সালের পরমাণু সমঝোতায় (জেসিপিওএ) একটি বিশেষ ধারা রাখা হয়, যাকে বলা হয় ‘স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম’। এর মাধ্যমে কোনো স্বাক্ষরকারী দেশ যদি মনে করে যে ইরান সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করছে, তবে তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করতে পারে।  


এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ব্যবহার করে অন্য কোনো দেশ এটি আটকে রাখতে পারবে না; নির্দিষ্ট সময় শেষে নিষেধাজ্ঞাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল (SnapBack) হবে। অর্থাৎ, স্ন্যাপব্যাক হলো এক ধরনের ‘স্বয়ংক্রিয় নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল প্রক্রিয়া’, যা পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ব্যবহার করতে চায়।


স্ন্যাপব্যাককে বেআইনি আখ্যা রাশিয়া ও চীনের 


রাশিয়া ও চীন উভয়েই ইউরোপীয় দেশগুলোর স্ন্যাপব্যাক প্রক্রিয়া সক্রিয় করার হুমকির তীব্র বিরোধিতা করেছে। জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিখাইল উলিয়ানভ স্পষ্টভাবে বলেছেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি নিজেরাই দীর্ঘদিন ধরে জেসিপিওএ ও জাতিসংঘের ২২৩১ নম্বর প্রস্তাব লঙ্ঘন করেছে। তাই আইনগতভাবে তাদের স্ন্যাপব্যাক সক্রিয় করার কোনো অধিকার নেই।  


তিনি ইউরোপীয় উদ্যোগকে ইরানের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং সতর্ক করেন যে, আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতি অনুযায়ী কোনো পক্ষ নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে সেই একই চুক্তির অধীনে অধিকার দাবি করতে পারে না। অর্থাৎ, ইউরোপীয় ত্রয়ীর এই পদক্ষেপ হবে বেআইনি ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।


অন্যদিকে, চীন জাতিসংঘে একটি ব্যাখ্যামূলক নোট পেশ করে জানায়, জেসিপিওএ বাস্তবায়নের বর্তমান জটিলতার জন্য ইরান নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো দায়ী, যারা চুক্তি মানতে ব্যর্থ হয়েছে। বেইজিং সতর্ক করেছে যে স্ন্যাপব্যাক সক্রিয় করার প্রচেষ্টা ‘অপ্রত্যাশিত ও বিপর্যয়কর’ পরিণতি বয়ে আনতে পারে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর সব কূটনৈতিক অগ্রগতি ধ্বংস করতে পারে। একইসঙ্গে চীন ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু শক্তি ব্যবহারের অধিকারকে পুনর্ব্যক্ত করে এবং সব পক্ষকে সংলাপ, পারস্পরিক সম্মান ও বাস্তবসম্মত সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়।  


জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিখাইল উলিয়ানভ


ইরানের প্রতিক্রিয়া


গত জুন মাসে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলার পর তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়। এপ্রিল মাস শুরু হওয়া আলোচনার ষষ্ঠ দফা শুরুর দুদিন আগে এই বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়।  


অনেক ইরানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ওই হামলা ছিল ‘আলোচনার টেবিল উড়িয়ে দেওয়ার শামিল’। এ কারণেই পুনরায় আলোচনায় বসা বা কোনো সম্ভাব্য সমঝোতায় পৌঁছানো নিয়ে ইরানের আর কোনো আস্থা নেই। যুক্তি হচ্ছে—যদি আবারও ইরান-আমেরিকা কিংবা ইরান-ইউরোপীয় ত্রয়ীর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়, কী নিশ্চয়তা আছে যে, তারা আবার মাঝপথে হামলা করবে না কিংবা কোনো সম্ভাব্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করবে না? 


কেননা ইরান ইতোমধ্যেই উভয় পক্ষের সঙ্গেই এমন অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। তাই আলোচনা পুনরায় শুরু করার শর্ত হিসেবে ইরান মার্কিন-ইসরায়েলি আগ্রাসণের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করে এবং ‘আলোচনার সময় কোনো হামলা হবে না’ তার নিশ্চয়তা চেয়েছে।  


ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকায়ি বলেন, আমরা কখনো তাদের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করিনি। তবে তাদের স্পষ্ট করতে হবে—তারা কি গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চায়, নাকি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করতে চায় যা ইহুদিবাদী স্বার্থ রক্ষা করে।  


ইউরোপের তিন দেশ কর্তৃক জাতিসংঘে পাঠানো তথাকথিত ‘স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম’ সম্পর্কিত চিঠির প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন- ইউরোপের এ ধরনের টুল ব্যবহারের কোনো অধিকার নেই এবং এ ধরনের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বেআইনি।


বাকায়ি অভিযোগ করেন, ওই তিন ইউরোপীয় দেশ নিজেরাই পরমাণু চুক্তির আওতায় তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। একইসঙ্গে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল কর্তৃক ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে চালানো হামলারও কোনো নিন্দা জানায়নি। তারা তাদের অবস্থানের যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি।  


ইরানের একটি পরমাণুকেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ চলছে


ইরান কী করতে পারে?


ইউরোপীয়রা যদি যুক্তরাষ্ট্রের মন রক্ষার্থে অযৌক্তিকভাবে স্ন্যাপব্যাক সক্রিয় করে, ইরান নিশ্চুপ থাকবে না। এর একটি পদক্ষেপ হতে পারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বৃদ্ধি। অন্য সম্ভাব্য পদক্ষেপ হলো- এনপিটি থেকে বেরিয়ে আসা এবং পরমাণু নীতি পরিবর্তন।  


ইরানের সংসদ সদস্য আহমাদ নাদেরি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “ইউরোপীয়রা চাপ বাড়ালে ইরান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, উদাহরণস্বরূপ এনপিটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আমাদের হাতে বহু কার্ড আছে।  


ইরানের সংসদের আরেক সদস্য কামরান গাজানফারি বলেছেন, যদি ‘স্ন্যাপব্যাক’ সক্রিয় হয় তাহলে ইরানকে অবশ্যই এনপিটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যাতে প্রমাণ হয় যে, আমাদের হাতে শক্তি আছে। এতে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য এক অনিশ্চিত ও অস্পষ্ট বিষয়ে পরিণত হবে। “


ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও করণীয়


ইরানি রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম’ সক্রিয় হলে ইরান কঠোর পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন পেতে পারে। এর ফলে ইরানের পারমাণবিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা শিবির (আমেরিকা-ইউরোপ) ও ইরান-রাশিয়া-চীন জোটের মধ্যে বিরোধ আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।  


এমন টানাপোড়েন কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও একটি বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই বর্তমান সংকট নিরসনে সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি, যা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে এবং টেকসই শান্তির পথ সুগম করতে সক্ষম হবে।  


আরএইচ 

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *