ইতিহাসের কঠিন মুহূর্তে মানবতার পরীক্ষা

দেশ রূপান্তর

পৃথিবীর মানচিত্রে ফিলিস্তিন নামের এক ভূখণ্ড আছে, কিন্তু রাষ্ট্র নেই। জাতিসংঘের দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তেই কেটে গেছে সাত দশক, তবুও পূর্ণ স্বীকৃতি অধরা। অথচ ১৫০টিরও বেশি দেশ ইতিমধ্যেই বলেছে ফিলিস্তিন একটি রাষ্ট্র। তাহলে দেরি কীসের? ন্যায় ও মানবতার প্রশ্নে আর কতকাল আমরা দ্বিধায় থাকব? ফিলিস্তিন প্রশ্ন আজ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, গোটা বিশ্বের নৈতিকতার মাপকাঠি। যুদ্ধ, অবরোধ, দখলদারিত্ব ও অধিকারহীনতার মধ্যে একটি জাতি তাদের ন্যায্য রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের জন্য লড়াই করছে। এ লড়াইকে অবজ্ঞা করা মানে, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করা। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের দাবি জটিল হয়ে ওঠে। ক্রমে দখল, যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির কারণে লাখো মানুষ শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নেয়। ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণার পরপরই সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, চীনসহ বহু দেশ সেই ঘোষণাকে সমর্থন জানায়। কিন্তু পূর্ণ স্বীকৃতির পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইসরায়েল-আমেরিকা জোট।

২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে “হড়হ-সবসনবৎ ড়নংবৎাবৎ ংঃধঃব” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৩৮টি দেশ পক্ষে, মাত্র ৯টি বিপক্ষে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো রাজনীতি ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য হওয়ার পথ আটকে দেয়। বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন রূপ নিয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে প্রায় ১৫৬ থেকে ১৫৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বের চার ভাগের তিন ভাগেরও বেশি দেশ আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলো ধীরে ধীরে এই কাতারে যোগ দিচ্ছে। ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও মাল্টাসহ অন্তত ১৫টি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও এ বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মতো কিছু প্রভাবশালী দেশ এখনো পিছিয়ে আছে। তাদের অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটকৌশলের পরিচায়ক যেখানে মানবাধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ।

রাষ্ট্র স্বীকৃতি মূলত প্রতীকী হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপক। প্রথমত, কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হয়। স্বীকৃতি পেলে দূতাবাস স্থাপন, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা সহজ হয়। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক আইনে পথ খোলে। যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা ভূমি দখলের অভিযোগ আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপনের সুযোগ তৈরি হয়। তৃতীয়ত, ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়ে। যত বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে, ততই ইসরায়েল কূটনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়বে। মানবিক সহায়তা জোরদার হয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ফিলিস্তিন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা গ্রহণে আরও অধিক সক্ষম হয়। অবশ্য বাস্তব মাঠপর্যায়ে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বা শাসনক্ষমতা রাতারাতি বদলায় না। কিন্তু প্রতীকী এই স্বীকৃতি ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।

ফিলিস্তিনের পূর্ণ রাষ্ট্র স্বীকৃতির পথে প্রধান বাধা হলো যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র বারবার এ সিদ্ধান্ত আটকে দিয়েছে। ইসরায়েলের নিরাপত্তার অজুহাতে আসলে তারা দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনকে অবরুদ্ধ রেখেছে। জার্মানি ও ইতালি শর্ত দিয়েছে ফিলিস্তিনে হামাসের প্রভাব কমানো এবং সব জিম্মি মুক্তি না হলে, তারা স্বীকৃতি দেবে না। এ ধরনের শর্ত আরোপ প্রকৃতপক্ষে মানবতার দাবি নয়, বরং রাজনৈতিক অজুহাত মাত্র।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই দ্বিচারিতা স্পষ্ট। যখন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাই সোচ্চার হয়, তখন ফিলিস্তিন প্রশ্নে তাদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়। মানবাধিকারের মানদণ্ড কি তবে ভূ-রাজনীতির ওপর নির্ভর করবে? বিশ্বের সামনে প্রশ্ন একটাই আমরা কি মানবতার পক্ষে দাঁড়াব, নাকি রাজনীতির খেলায় পরাজিত হব? সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র পাওয়া কোনো পুরস্কার বা দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়; বরং এটি ফিলিস্তিনিদের জন্মগত ও ন্যায্য অধিকার। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির মতো তারাও আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার রাখে। তিনি স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘এই অধিকার দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করা হচ্ছে, অথচ আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের মূল দর্শনেই এর স্বীকৃতি নিহিত। তাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু মানবিক দায়বদ্ধতা পূরণ করবে না, এটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের পথকেও আরও সুদৃঢ় করবে।’ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে আগামী দিনের করণীয়গুলো এখনই সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে। প্রথমত, আরও বেশি দেশকে স্বীকৃতির শৃঙ্খলে যুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জার্মানির মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্র যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে, তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রায় পূর্ণতা পাবে। দ্বিতীয়ত, স্বীকৃতি কেবল প্রতীকী ঘোষণা হয়ে থাকলে চলবে না; এটি বাস্তব পদক্ষেপে রূপ নিতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক আদালতের ভূমিকাও বাড়াতে হবে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিরূপণে ফিলিস্তিনকে কার্যকর আইনি ক্ষমতা প্রদান জরুরি। সর্বশেষ, দুটি রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ন্যায্য সীমান্ত নির্ধারণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছাড়া এ দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের কোনো সমাধান সম্ভব নয়। ফিলিস্তিন স্বীকৃতি কেবল কূটনীতির অংশ নয়; এটি মানবতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার অনিবার্য পদক্ষেপ। প্রশ্ন একটাই আমরা কি শক্তির রাজনীতির কাছে হার মানব, নাকি মানবতার স্বার্থে ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবিকে সমর্থন করব? ইতিহাসের এই কঠিন মুহূর্তে মানবতার পরীক্ষায় আমাদের অবস্থানই ঠিক করে দেবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কোন চোখে দেখবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক

jasim6809786@gmail. com

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *