Google Alert – সেনা
১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে জুলাই আন্দোলন দমনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর সহযোগী, বল প্রয়োগে উসকানি এবং কুষ্টিয়ায় আন্দোলন দমনে ফোনের পর ছয়জনকে হত্যার অভিযোগে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দাখিল করা ৩৯ পৃষ্ঠার অভিযোগের সঙ্গে রয়েছে এক হাজার ৬৭৯ পৃষ্ঠার নথিপত্র।
রয়েছে তিনটি অডিও ও ছয়টি ভিডিও ডকুমেন্ট। আর এ মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে হাসানুল হক ইনুকে।
বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দাখিল করা এই আটটি অভিযোগে হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের বিএনপি-জামায়াত, সন্ত্রাসী, সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দিয়ে এবং তাদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের উসকানি, ১৪ দলীয় জোট সরকারের অংশীদার জাসদের সভাপতি হিসেবে তার ঊর্ধ্বতন অবস্থান থেকে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি ও সহায়তা এবং কুষ্টিয়ায় পুলিশ সুপারকে ফোন করে আন্দোলন দমনের নির্দেশনার পর ৬ জনকে হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে।
বিদেশি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার
হাসানুল হক ইনু ঊর্ধ্বতন অবস্থানে থেকে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই একটি বিদেশি গণমাধ্যমে আন্দোলন দমনে এবং আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত, সন্ত্রাসী, সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দেন এবং তাদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগের উসকানি দেন।
১৪ দলের সভায় হাজির থেকে উসকানি
আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এবং জাসদ প্রধান আসামি হাসানুল হক ইনুর উপস্থিতিতে ১৪ দলীয় জোটের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন করে কারফিউ জারির মাধ্যমে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে দমনের জন্য সর্বোচ্চ বল প্রয়োগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য ‘শ্যুট অ্যাট সাইট’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে তা বাস্তবায়নের জন্য দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন করে নিরীহ-নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তা সরকার কার্যকর করে।
এই নির্দেশের সাথে আসামি হাসানুল হক ইনু ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট সরকারের অংশীদার জাসদের সভাপতি হিসেবে তার ঊর্ধ্বতন অবস্থান থেকে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ও বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন, প্ররোচনা দিয়েছেন, উসকানি দিয়েছেন এবং সহায়তা করেছেন।
কুষ্টিয়ার এসপিকে ফোন
২০ জুলাই দুপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে তার নিজ জেলা কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারকে ফোন দিয়ে আন্দোলনকারীদের ছবি দেখে তালিকা প্রণয়ন ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন এবং আগের নির্যাতনকে অনুমোদন করেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী কুষ্টিয়া জেলার পুলিশ সুপারের অধীনস্ত পুলিশ বাহিনী এবং ১৪ দলীয় জোটের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী ৫ আগস্ট পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম, বার্মিজ গলিতে সুরুজ আলী বাবু, হরিপুরগামী রাস্তায় আড়ংয়ের সামনে শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, মো. উসামা, তুলা পট্টির গলিতে ব্যবসায়ী বাবলু ফরাজী ও ফায়ার সার্ভিসের বিপরীত দিকে রাস্তার ওপর চাকরিজীবী ইউসুফ শেখ নিহত হন এবং রাইসুল হকসহ অসংখ্য নিরীহ-নিরস্ত্র আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা আহত হয়, অনেককে আটক করে নির্যাতন করা হয়।
আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপ
হাসানুল হক ইনু সার্বক্ষণিক শেখ হাসিনায় সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলন দমনে ‘লেথাল উইপন’ ব্যবহার করে আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে আন্দোলনকারীদের ঘেরাও করে ছত্রীসেনা নামিয়ে হেলিকপ্টায় ব্যবহার করে তাদের গুলি করে হত্যা, বোম্বিং করে হত্যা, আটক ও নির্যাতনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি দেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি ২০ জুলাই দুপুরে আন্দোলন দমনে লেথাল উইপন ব্যবহার, আন্দোলনকারীদের ঘেরাও করে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বোম্বিং করে ও ছত্রীসেনা নামিয়ে হত্যাসহ আন্দোলন দমনে গুলিবর্ষণসহ শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ অনুমোদন করেন এবং তা কার্যকর করার জন্য শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে ওই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ষড়যন্ত্র, সহায়তা ও সম্পৃক্ত ছিলেন।
গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার
২৭ জুলাই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু একটি টিভি চ্যানেলে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আন্দোলনকারীদের বিএনপি-জামায়াত, সন্ত্রাসী, জঙ্গি ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। সেই সাথে সরকারের জারি করা কারফিউ এবং লেথাল উইপন ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ড সংঘটনসহ নির্যাতন-নিপীড়নকে কৌশলে সমর্থন করেন।
হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বৈধতা
২৯ জুলাই শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সভায় জোটের অন্যতম শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে উপস্থিত থেকে আন্দোলনকে দমন ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দেন। আসামি হাসানুল হক ইনু একটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের মাধ্যমে বাস্তবায়নের নির্দেশ, প্ররোচনা ও উসকানি দেন। এবং সহায়তা করার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের সশস্ত্র ক্যাডার কর্তৃক পরিচালিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনকে বৈধতা দেন।
সার্বক্ষণিক শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা
হাসানুল হক ইনু সার্বক্ষণিক শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলন দমনে কারফিউ স্থায়ী করে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা, লেথাল উইপনের ব্যবহার করে আন্দোলন দমনে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে জঙ্গি তকমা দিয়ে গুলি করে হত্যা, আটক ও নির্যাতনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি এবং নির্দেশ দিতে থাকেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি ৪ আগস্ট আন্দোলন দমনে কারফিউ জারি করে গুলি বর্ষণসহ শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ অনুমোদন করেন এবং তা কার্যকর কয়ায় জন্য শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে ওই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে যড়যন্ত্র, সহায়তা ও সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তার অধীনস্ত তার নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন।
কুষ্টিয়ায় ৬ জনকে হত্যা
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কুষ্টিয়া জেলার সর্বস্তরের জনতার সঙ্গে নিরীহ-নিরস্ত্র শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম, সুরুজ আলী বাবু, শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, মো. উসামা, ব্যবসায়ী বাবলু ফরাজী ও চাকরিজীবী ইউসুফ শেখ রাস্তায় নেমে আসেন। তারা সকাল দশটার দিকে কুষ্টিয়ার হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা হাসপাতাল মোড়ে জড়ো হয়ে সেখান থেকে চৌড়হাস থেকে মজমপুরের দিকে শান্তিপূর্ণভাবে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুগত অধস্তন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সংসদ সদস্য মো. মাহবুব উল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা এবং নির্দেশের প্রেক্ষিতে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সদর উদ্দিন খান, কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আসগর আলী এবং কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান আতাদের নির্দেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসী অজয় সুরেখা, মানব চাকী, আতিকুর রহমান অনিক, শেখ হাফিজ চ্যালেঞ্জ, রাশিদুল ইসলাম বিপ্লব, তৈয়ব বাদশা, তাইজাল আলী খান, স্বপন কুমার গং পুলিশের ছত্র ছায়ায় (কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে একত্রে) নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর শহরের বিভিন্ন স্থানে গুলি চালাতে থাকে। তাদের এই গুলিবর্ষণের ফলে দুপুর দেড়টা থেকে চারটার মধ্যে বক চত্বর থেকে অনুমান ৫০ গজ উত্তরে শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম, বার্মিজ গলিতে সুরুজ আলী বাবু, হরিপুরগামী রাস্তায় আড়ংয়ের সামনে শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মুত্তাকিন, মো. উসামা, তুলা পট্টির গলিতে ব্যবসায়ী বাবলু ফরাজী ও ফায়ার সার্ভিসের বিপরীত দিকে রাস্তার ওপর চাকরিজীবী ইউসুফ শেখ শহীদ হন।
এসব অভিযোগ দাখিলের পর ২৯ সেপ্টেম্বর এই মামলায় হাসানুল হক ইনুকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে সারা দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কুষ্টিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। হাসানুল হক ইনু দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে যেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের উসকানি-আদেশ দিয়েছেন।
তিনি গত সরকারের প্রভাবশালী একটি শরিক রাজনৈতিক দল জাসদের প্রধান। সেই সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৪ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে নিপীড়ন চালানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেসব বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, মতামত দিয়েছেন, ফ্যাসিলিটেট করেছেন।
ইএস/এমজেএফ