একটি দুর্ঘটনা: যার দায় ‘কারও নয়’

Bangla Tribune

মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ৬ দিন পেরিয়ে গেলেও ঘটনার জন্য দায়ী করা যায়নি কাউকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল বলছেন, ‘নিছক দুর্ঘটনার’ আবার দায় কীসের। আরেক দল প্রশ্ন তুলছেন, সড়ক, রেল, নদীপথে এ ধরনের যেকোনও দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু আইনি ব‍্যবস্থা, দায়ী ব‍্যক্তিদের চিহ্নিত করা, পরবর্তীকালে যেন এমন কিছু এড়ানো যায়—সেজন‍্য নানা কথা বলা হলেও এবার এর ব‍্যত‍্যয় ঘটেছে। এমনকি, অভিভাবকও তার সন্তান হত‍্যার ‘বিচার চান’ এমন কোনও স্পষ্ট উচ্চারণ করেননি।

যদিও নগর পরিকল্পনাবিদরা একত্রিত হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, মাইলস্টোন নির্মাণকারী, রাজউক, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন– কেউই এই দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। তবে এসব কর্তৃপক্ষের কেউই তাদের দায়ের বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে রাজি নয়। এমনকি মাইলস্টোন স্কুল ভবনটি ‘ফ্লাইং জোনের ভেতরে’—এটা সত্য না অসত্য তাও কেউ বলতে রাজি নন। সিভিল অ্যাভিয়েশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক কর্মকর্তারা এসব এলাকার বেশ কিছু ভবন জোনের মধ‍্যে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বললেও তারা স্টেটমেন্ট আকারে সেটি বলতে রাজি হননি।

উল্লেখ্য, ২১ জুলাই দুপুরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান প্রতিষ্ঠানটির হায়দার আলী নামে দোতলা ভবনে আছড়ে পড়ে। এতে সঙ্গে সঙ্গে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় ভবনটিতে থাকা প্রাইমারি ও মাধ্যমিকের  শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক, স্টাফ ও অভিভাবকরা উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনায় শনিবার (২৬ জুলাই) রাত ১০টা পর্যন্ত ৩৩ জন মারা গেছেন এবং বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৪৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হালনাগাদ তথ্যে এ কথা বলা হয়।

যেকোনও ঘটনার পেছনে দায় কার খোঁজা হয়ে থাকে। এই ঘটনার পরে প্রথম যে বাক্যটি জনমনে প্রশ্ন আকারে হাজির হয়, তা হলো— ফ্লাইং অ্যাপ্রোচ জোনে কীভাবে এই স্কুল ভবনটি নির্মিত হলো। ফ্লাইং অ্যাপ্রোচ জোন হলো বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি একটি এলাকা, যেখানে উড়োজাহাজের ওঠা-নামার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। বিমান টেকঅফ এবং অবতরণ করার সময়ে যেন একটি পরিষ্কার, বাধামুক্ত পথ পায়— সেজন‍্য এটা কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই জোনের মধ‍্যে উঁচু ভবন, টাওয়ার, গাছ বা বাধা দিতে পারে, এমন কিছু নির্মাণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত বা নিষিদ্ধ। তাহলে কীভাবে এখানে এই স্কুল ভবন নির্মিত হলো। আর কাদের অনুমোদন দিতে হয় স্কুল ভবন নির্মাণে।

ঘটনার শোক কাটিয়ে প্রথম প্রতিবাদ করে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বিআইপি। সেখানে সংগঠনটির সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘অ্যাপ্রোচ এরিয়া থেকে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা সরিয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও প্রাণহানি হবে। যেসব ভবনের অনুমোদন নেই বা অনুমোদন ব্যত্যয় হয়েছে, তা ভেঙে ফেলা উচিত। এ বিষয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনের সাবেক এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘জোনের ভেতরের এ ধরনের ভবনের তালিকা করা আছে। এবং সেখানে অনেক মানুষ একত্রিত হয় এমন স্থাপনাও আছে। তবে তিনি নাম প্রকাশ করে স্টেটমেন্ট আকারে কিছু বলবেন না বলে জানান। তবে নিয়ম বলছে, সিভিল অ্যাভিয়েশনের এনওসি ছাড়া এই স্কুল ভবন নির্মাণ সম্ভব ছিল না।

কীভাবে এরকম সংবেদনশীল জায়গায় বিদ্যালয় করার অনুমোদন পেয়েছিল জানতে চাইলে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক অধিদফতর ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এটা নিয়ে কাজ করছি। আপনারা জানতে পারবেন।’ তিনি সে সময় দায়িত্বে ছিলেন না বলেও জানান।
স্কুল ভবনের সামনে আছড়ে পড়ে বিমানটি, ছবি: নাসিরুল ইসলাম
পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ‘মাইলস্টোন নির্মাণকারী, রাজউক, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন– কেউ এ দায় এড়াতে পারে না।’  তিনি বলেন, ‘মাইলস্টোন ও বিমানবন্দরের রানওয়ে স্ট্রেট রানওয়ে। উঠুক বা নামুক তাকে ওই কলেজের ওপর দিয়েই যেতে হচ্ছে। এখানে যে কলেজটা হলো, নিশ্চয়ই ঢাকার একটা পরিকল্পনা আছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কোথাও না কোথাও থেকে অনুমোদন নিতে হয়েছে। অনুমোদন দেওয়ার কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে রাজউক। কিন্তু এক্ষেত্রে সিভিল অ্যাভিয়েশনের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়েছে। এই কর্তৃপক্ষগুলো কীভাবে কাজ করে তা আমাদের অজানা নেই।  প্রশ্ন হলো, সিভিল অ্যাভিয়েশন যে অনাপত্তিপত্রটি দিলো, সেটা কী দেখে দিলো?’

এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘১৯৯৫ সালের ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) অনুযায়ী মাইলস্টোন এলাকার জায়গাটি ছিল জলাশয়। সেটি ভরাট করারও অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো, রাজউক কেন ভরাট করতে দিলো?’

রাজউক কি সেই দায় নিয়ে কথা বলছে? রাজউকের বিল্ডিং ইন্সপেক্টর সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী সব ধরনের ভবনের অনুমোদন নিতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জমির মালিকানা, অগ্নিনিরাপত্তা, স্যানিটেশন, পরিবেশগত ছাড়পত্রসহ আরও বিশেষ কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণে নিতে হয়। কিন্তু ওখানে অনুমোদনের বিষয়ে কী হয়েছে, সেটা দেখে বলতে হবে।’
দুর্ঘটনার পর থেকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে প্রতিদিন ভিড় করছে মানুষ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজউক না। সিটি করপোরেশনের দায় আছে ট্র্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে। উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জোবায়ের হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্কুল করার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন থেকে কোনও অনুমোদন নেওয়া হয় না। তবে ট্রেড লাইসেন্স সিটি করপোরেশন দিয়ে থাকে। মাইলস্টোন স্কুলটি কোনও ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে কিনা এ বিষয়ে জানা নেই।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা মনে করেন— এই এলাকায় এ ধরনের একটি ভবন নির্মাণ হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন জোরেশোরে না ওঠার কারণ হচ্ছে, প্রশ্ন তোলার কারও ক্ষমতা নেই। তিনি বলেন, ‘একটা লঞ্চ ডুবলে আমরা মালিক ডাকি, বিচারের দাবিতে মিছিল করি। কিন্তু এ ঘটনাটিকে কী করে নিছক দুর্ঘটনা ধরে নিয়ে সবাই চুপ করে গেলাম। কেন বললাম না এই বিল্ডিং এখানে কেন? কেউ বলছি না, ফ্লাইং জোনে স্কুল অনুমোদন কে দিলো, আর কে বানালো। এই দুর্ঘটনার কথা বাদই দিলাম, রোজ শিশুরা যত সময় এখানে স্কুল করে—কতবার তীব্র শব্দে তাদের কেঁপে উঠতে হয়, সেই হিসাব আমরা কেউ করিনি কেন?’

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *