এ কোন বাংলাদেশ

Google Alert – বাংলাদেশ

গত ক’দিনের ঘটনা দেখে দেখে ব্যথায় কষ্টে কঁকিয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে এটা আমাদের চিরচেনা বাংলাদেশ নয়। মুক্তিযুদ্ধের আলোয় আলোকিত শ্যামল কোমল কোনো মানবিক জনপদ নয়। তেরশত নদীর এই পাললিক ভূমি যেন গা হিমকরা কোনো বীভৎস মৃত্যুপুরী। চারদিকে শুধু রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের উৎকট বিভীষিকা। ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত আর্ত আহত মানুষের গোঙানি। হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে এই ভয়াবহতার চাপ সামলাতে। যেন নিজের মানুষের প্রাণ ও রক্তের নেশায়, এই লালন, হাসন, আব্বাসউদ্দীনের দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলারা। মনে হচ্ছে ইসরাইল আক্রান্ত গাজায় বাস করছি।

মাথার উপর ঘনঘন চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার। সমবেত জনতার উপর ছোড়া হচ্ছে বুলেট। রাজপথে, অলি-গলিতে, মাঠে-ময়দানে যেখানেই আন্দোলনকারীরা, সেখানেই পুলিশ নির্বিচারে চালাচ্ছে গুলি। স্নাইপাররা টার্গেট করে করে হত্যা করছে মানুষ। রক্তে ভাসছে দেশ। ঢাকাসহ সবখানেই পড়ছে লাশ। কারফিউ সর্বত্র। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন। সরকারি বাখওয়াজী ছাড়া আর কিছুই শোনা বা জানার উপায় নেই। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ বিস্মিত, স্তম্ভিত। দেশের ভবিষ্যৎকে রাস্তায় ঠেলে দিয়ে লাশ বানানো হচ্ছে। আমাদের সন্তানদের বুক ঝাঁজরা করছে বুলেট। এক শ্রেণির দালাল মিডিয়া আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারী, বিএনপি, জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছে। যেন এই ট্যাগ লাগালে হত্যাকাণ্ড জায়েজ হয়ে যায়। তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিক্রিয়ার ওপর সবার মনোযোগ আদায় করতে চাচ্ছে। আর ভুলিয়ে দিতে চাচ্ছে ক্রিয়ার প্রসঙ্গ। ফলে পর্দায় শুধু জ্বালাও-পোড়াওয়ের কাহিনি। মানুষ খুনের কোনো কথাই নেই। যেন মানুষ হত্যা খুবই মামুলি ব্যাপার।

জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে বেশুমার। এই ক্ষতির ধকল একদিন কাটিয়ে ওঠা যাবে। যাদের হত্যা করা হচ্ছে তাদের কি আর কোনোভাবে আমরা ফিরে পাব? দেশের মানুষ তিনি যেই হোন, তাকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা গর্হিত পাপ। কিন্তু কথা হলো কেন এমন হলো? বিষয়ের শুরু কোত্থেকে? ২০১৮ সালে ‘বিরক্ত হয়ে’ কোটা প্রথা বাতিল করে নির্বাহী বিভাগ। হঠাৎ করে কোটা চলে যায় হাইকোর্টে। হাইকোর্ট সরকারি প্রজ্ঞাপন বাতিল করে আবার প্রবর্তন করে কোটা প্রথা। যেখানে মেধার স্থান মাত্র ৪৪ শতাংশ। সংগত কারণেই রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা।

মনে রাখা জরুরি, ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু কোটা বাতিল চায়নি। তারা চেয়েছিল যুক্তিসংগত সংস্কার। তাদের আন্দোলন চলছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে। তখনই তাদের সঙ্গে কথা বলার বদলে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই ছেলেমেয়েদের প্রতি দেখানো হয় অশোভন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। তাদের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় রাজাকারের সিল। প্রধানমন্ত্রীর ড্যাম্পকেয়ার কথাবার্তাও আন্দোলনকে প্রশমনের বিপরীতে ছাত্রছাত্রীদের ব্যথিত করে তোলে। সরকারের দু-একজন মন্ত্রীর আচরণ, উচ্চারণও ছিল দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দিয়ে ঠাসা। এর মধ্যে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, এই আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ঘোষণার পরপরই ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পোষ্য গুন্ডাপান্ডারা শিক্ষাঙ্গনগুলোতে হামলার পর হামলা পরিচালনা করে। শুরু করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করার কর্মকাণ্ড। পাশাপাশি মারমুখী অবস্থানে নামে সরকারের অনুগত বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ। এবার যেন আগুনে ঘি পড়ল। আন্দোলন আর শান্তিপূর্ণ অহিংস থাকল না। একদিকে হামলা, অন্যদিকে চলল প্রতিরোধ। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি, জামায়াত, সমমনা দল ও গণতন্ত্র মঞ্চসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল এই আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাও দেশের মানুষকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানায়। সে কারণে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পুরো আন্দোলনটা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। পরিস্থিতি দাঁড়াল, একদিকে সরকারের সশস্ত্র অনুগত লস্কর বাহিনী, অন্যদিকে নিরস্ত্র-বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। মাঝখান থেকে ঝরে গেল শত শত তরতাজা তরুণের প্রাণ। বিনষ্ট হলো অনেক জাতীয় সম্পত্তি। -শেষ পর্যন্ত আদালত দিয়ে সরকার তার নথ খসালো বটে, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দুই.

একই ভুল করেছিল পাকিস্তান সরকার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে এ দেশের মানুষের আত্মার দাবি ছিল তা অনুধাবনে অপারগ হয় তারা। গোঁয়ার্তুমি, দম্ভ, অহমিকা ও ঔদ্ধত্য দিয়ে পিষে ফেলতে চেয়েছিল সবকিছু। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ঝরে গেল কতগুলো নিষ্পাপ নিরপরাধ প্রাণ। আর এর ফলে ধ্বংস হয়ে গেল নুরুল আমিনের রাজনৈতিক জীবন। চিরকালের জন্য কবরে ঠাঁই নিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের দাবিদার মুসলিম লীগ। অন্তর থেকে ভেঙে গেল জিন্নাহর সাধের পাকিস্তান। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মোকাবিলায়ও একই ভুল করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা।

১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান কারণ ছিল গণতন্ত্রহীনতা, বৈষম্য, নির্যাতন এবং আইয়ুব খানের হামবড়া অহংকার। ছাত্রনেতা আসাদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল আইয়ুব খানের তখ্ত তাউস। তিনি নিক্ষিপ্ত হন ইতিহাসের ডাস্টবিনে।

যে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আর যুদ্ধ শেষে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পরিণত হলো স্বৈরাচারে। ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হলো। ১০ লাখ মানুষ মারা গেল দুর্ভিক্ষে। কোনো কিছুর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হলো সব রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র। ঘটে গেল ১৫ আগস্টের ঘটনা। শঠতা, ধূর্ততা, প্রতারণা, অনুগত বাহিনী ও রাজনীতিবিদদের কেনাবেচা করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ। কিন্তু পরিণামে ফুঁসে উঠে জনগণ। ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান তাকে উৎখাত করে ক্ষমতা থেকে। আর নূর হোসেন হয়ে ওঠেন গণ-অভ্যুত্থানের মানব পোস্টার।

তিন.

ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে, সরকারসহ সবার কাছেই জাতি দায়িত্বশীল, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ আচরণ প্রত্যাশা করে। আশা করে নিখাদ দেশপ্রেমিকের অবস্থান। সব ধরনের অহমিকা, ক্রোধ ও ঘৃণাবিদ্বেষকে সংবরণ করে বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য পরিষ্কার চোখ মেলে তাকান। দেখুন কী ভয়ানক সর্বনাশ হয়ে গেছে। গোরস্থানে গোরস্থানে আমাদের সন্তানদের লাশ। ঘরে ঘরে সন্তানহারা পিতামাতা, ভাইবোনদের বক্ষফাটা আহাজারি। হাজার হাজার আহত মানুষের কাতরানিতে ভারী হয়ে গেছে বাতাস। এইরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও কি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে শুভবুদ্ধি, শ্রেয়বোধ, মানবতা, দেশপ্রেম, কর্তব্যজ্ঞান জেগে উঠবে না? নাকি সেই অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যাওয়া চেনা কৌশল, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষে’ এর ঘাড়ে গছিয়ে, নিজেরা সাধু সেজে কেষ্টা বেটাকেই চোর সাব্যস্ত করে কেল্লা ফতে করবেন? আবারও বিরোধীদলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দিতে থাকবেন মামলার পর মামলা? শুরু করবেন গ্রেফতার বাণিজ্য। এতে সরকারের গায়ের ঝাল হয়তো কিছুটা কমবে। কিন্তু উপসংহারে প্রাপ্তির কোঠায় থাকবে কেবলই গ্লানি। আত্মপ্রতারণার পাপ। তাহলে রাজধর্মের কী হবে? যে রাজধর্মের কথা গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ি। মোদি রাজধর্ম মানেননি। সেজন্যই এখনো গুজরাটের রক্ত তাকে প্রেতাত্মার মতো তাড়া করে ফেরে। আমাদের শাসকরা কি সেই রাজধর্ম মানবেন? এ মাটি কিন্তু বাংলার মাটি।

হাইস্কুলের ছাত্র হয়েও ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধেও দেশের জন্য যৎকিঞ্চিৎ কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ’৯০-এর ঘটনা তো এই সেদিনের।-তো, অভিজ্ঞতা থেকে হলফ করে বলতে পারি (মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া) এ রকম ভয়ংকর অবস্থা আমি আর কোনোদিন দেখিনি। আমার কেবলই মনে হচ্ছে এই রক্তস্রোত, এই অশ্রুধারা বৃথা যেতে পারে না। বৃথা যায়নি কোথাও। এর ভেতর দিয়েই হয়তো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে বিদ্বেষ, বিভেদ, ঘৃণা, জিঘাংসা, গণতন্ত্রহীনতা, নীতি-নৈতিকতাহীনতা, আইনের শাসনহীনতার বিষমুক্ত, প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনের উজ্জীবিত-সঞ্জীবিত এক নতুন বাংলাদেশের। যারা ন্যায়ের পক্ষে, কল্যাণের পক্ষে, যারা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সিনাটান করে দাঁড়ায়, তাদের জন্যই তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমিয় বাণী-

‘সত্য পথের তীর্থ-পথিক ভয় নাই, নাহি ভয়,

শান্তি যাদের লক্ষ, তাদের নাই নাই পরাজয়।

অশান্তিকামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝে মাঝে,

অবশেষে চির-লাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে।’

২১-এর রক্ত চিরকালের জন্য জেগে আছে শহীদ মিনারে। ’৬৯-কে অমর করেছে আসাদ। ’৯০ মানেই তো নূর হোসেন। আর ২০২৪-এর আবু সাঈদ ইতোমধ্যেই তো হয়ে উঠেছেন লাঞ্ছিত-অপমানিত মানবতার প্রাণের পতাকা। হাজার বছরের ইতিহাসে গুলির সামনে বুক বাড়িয়ে দেওয়া দুঃসাহসী আবু সাঈদের মতো কাউকে তো আর পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের সামান্য একজন কবিতাকর্মী হিসাবে সবাইকে বলব, আর কোনো হত্যা নয়, গণহত্যা নয়, রক্ত নয়। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা দেশে আর একফোঁটা রক্তও কেউ ঝরাবেন না। বাংলাদেশ এত রক্ত সহ্য করতে পারছে না। সবাই স্থির হোন। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা পরিহার করুন। দেশ মানে শুধু মাটি, নদী, গাছপালা, খাল-বিল নয়, দেশ মানে দেশের মানুষ। সেই মানুষ আজ বিপন্ন। আসুন, সেই মানুষের পক্ষে দাঁড়ান, দেশটাকে বাঁচান।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক

নোট: লেখাটি ২০২৪ সালের ২২ জুলাই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *