Bangla Tribune
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী যদি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেই দিনক্ষণ বেশি দূরে নয়। বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ ধরলে ছয় মাসের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের পক্ষে থেকে আশার বাণী শোনালেও বাস্তবে তা সন্তোষজনক নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনও অবনতিই দেখা যাচ্ছে। এখনও মব ভায়োল্যান্স, নির্যাতন, প্রকাশ্যে হত্যা, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা সামনে আসছে। তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কবে ঘুরে দাঁড়াবে? জাতীয় নির্বাচনের আগে কি স্বাভাবিক হবে? এমন নানা প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে। এ সময় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন তারা।
এদিকে গণঅভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্রসহ সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নির্বাচনের আগে এসব অবৈধ অস্ত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা হবে বলে সম্প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
তবে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা নিয়ে স্বয়ং পুলিশবাহিনীর কেউ কেউ একমত প্রকাশ করেছেন। বাহিনীর সবোর্চ্চ মহল থেকে বলা হচ্ছে, পুলিশ ফোর্সের মোরাল বুস্টআপ তারা এখনও করতে পারেননি। যার ফলে অনেক অপরাধই চোখের সামনে সংঘটিত হলেও কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এসব অপরাধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকেও সোচ্চার হতে দেখা গেছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন ঘটনার পর মব ভায়োল্যান্সের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানিয়েছে। তবে এতকিছুর পরও হামলা, মামলা, নির্যাতন মব ভায়েল্যান্সের মাধ্যমে প্রকাশ্যে হত্যার মতো ঘটনা থামছে না। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যায় গাজীপুরে পুলিশের সামনে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ১০ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে লোকজনের সামনে লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ (৩৯) নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা যেমন জনমনে দাগ কেটেছে, দেশে বিদেশে আলোচনার-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
অপরাধ সূচক থেকে যা জানা যাচ্ছে
গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত আছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির মতে, খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটপাট, অরাজকতা চলছেই। পুলিশ এখনও নির্লিপ্ত, দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ এবং পেশাদারত্বেরও ঘাটতি রয়েছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি’র নিজ কার্যালয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা জানানো হয়।
এছাড়া পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে খুন হন ২৯৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০। পরের মাসে খুনের সংখ্যা আরও বেড়ে হয় ৩১৬। এছাড়া এপ্রিলে ৩৩৬ জন, মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন। তবে গত জুন মাসে চলতি বছরের সর্বোচ্চ খুনের ঘটনা ঘটে। এ মাসে সারা দেশে মোট ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ বছর প্রতি মাসেই খুনের ঘটনা বাড়ছে। খুনের ঘটনা বেশি ঘটছে ঢাকা মেট্রোপলিটন, ঢাকা রেঞ্জ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জে। অনেক খুনের পেছনে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের মতো ঘটনা কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে।
খুনের পাশাপাশি সারা দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪টি ডাকাতি হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। এছাড়া এ ছয় মাসে ১১ হাজার ৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে। এছাড়া সারা দেশে বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশের বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের বড় বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে। দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত আছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজাদ আলী গতকাল রাজারবাগে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বিগত বছরে বিশেষ করে মেট্রোপলিটন পুলিশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একসময় যে ভঙ্গুর অবস্থায় চলে গিয়েছিল পুলিশ সেখান থেকে এখন অনেকটাই পেশাদারত্বে ফিরে এসেছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। পুলিশ পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসন্ন নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে একটি দৃষ্টান্তে পরিণত করবে।’
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ’সামনে দিন যত যাবে পরিস্থিতি তত খারাপের দিকে যাবে। নির্বাচনকে কেন্দ্রে করে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে বলে আমরা আশংকা করছি। মূল সমস্যা হলো সবাই ক্ষমতার পালা বদলে ব্যস্ত। ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্কারে সরকারের কাজগুলো তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতাটাই মূল কারণ, যেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এছাড়া পুলিশবাহিনী এখনও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখনও পুলিশ পুরোদমে ঘুরে দাড়াঁতে পারেনি। এ সময়টাকে অপরাধীরা সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছে। যার ফলে এসব নৈরাজ্য চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের যে প্রশিক্ষণ থাকার কথা, সেটি নেই। অস্থিতিশীল পরিবেশ মোকাবিলা করার জন্য পুলিশের দক্ষতা, নৈপুণ্যের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলছে পারছে না। রাজনৈতিক দলগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ন্যূনতম সহযোগিতা করছে না। তাদের এ বিষয়ে কোনও মনোযোগও নেই। রাজনৈতিক সহায়তা না পাওয়ার কারণেও বাহিনীর মধ্যে আস্থার সংকট দেখা যাচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ’সামগ্রিকভাবে যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই পুলিশকে সেই মর্যাদার জায়গায় নেওয়া সম্ভব। যেখান থেকে পুলিশ জনগণকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। সে জন্য পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। এটা নির্ভর করছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের সদিচ্ছার ওপর।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের ভেতর এক ধরনের অনাস্থা কাজ করছে। কারণ বেশ কিছু পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। প্রতিটা হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। আমার ধারণা, এর মধ্যে দিয়ে পুলিশ আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের অংশগ্রহণ আমরা লক্ষ্য করছি। রাজনীতিতে দুর্নীতিবাজদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, তারাই আবার মেইন স্ট্রিমে অবস্থান করছে। এখন যেটি দেখা যাচ্ছে-অস্থিতিশীল অবস্থা, চাঁদাবাজি, লুটপাট, নির্যাতন- এর একটা বড় অংশ করছে রাজনৈতিক সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। এগুলো থেকে ফিরে আসতে হবে।’