কারা হেফাজতে তিন বম নাগরিকের মৃত্যু ও নিরপরাধ বম নাগরিকদের মুক্তির দাবিতে বিচারবিভাগীয় তদন্ত

Hill Voice on Facebook

কারা হেফাজতে তিন বম নাগরিকের মৃত্যু ও নিরপরাধ বম নাগরিকদের মুক্তির দাবিতে বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি ১৫৫ নাগরিকের

হিল ভয়েস, ৩ আগস্ট ২০২৫, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম কারা হেফাজতে বম জাতিগোষ্ঠীর তিন নাগরিকের মৃত্যু ও আটককৃত সকল নিরপরাধ বম নাগরিকদের মুক্তির দাবিসহ বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন গতকাল (২ আগস্ট) দেশের ১৫৫ বিশিষ্ট নাগরিক।

এছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সন্ত্রাস দমনের’ নামে বান্দরবানে নির্বিচারে সাধারণ আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, বিশেষত বম জাতিগোষ্ঠীর নারী-শিশু ও সাধারণ নাগরিকদের বিনা বিচারে আটক ও বছরের পর বছর কারাবন্দি রাখার কথা জানিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম কারা হেফাজতে গত ১৭ জুলাই ২০২৫ তারিখ বম জতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে ভান লাল রুয়াল বম (৩৫) এবং এর আগে একই কারাগারে গত ৩১ মে ২০২৫ তারিখ লাল সাংময় বম (৫৫) ও গত ১৫ মে ২০২৫ তারিখ লাল ত্লেং কিম বমের (২৯) কারা হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই লাল ত্লেং কিম বম মারা যান। তার পরিবারের অভিযোগ, কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্য সন্দেহে লাল ত্লেং কিমকে ব্যাংক ডাকাতিসহ একাধিক মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাবন্দি রাখা হয়েছিল। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেও যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, লাল সাংময়ের পরিবারের অভিযোগ, মিথ্যে মামলায় ২ বছর ধরে বিনা বিচারে কারাভোগ করেন ক্যান্সার আক্রান্ত এই ব্যক্তি। তার শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি হলে প্রায় দুই মাস চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। লাল ত্লেং কিমের মৃত্যুর সময়েই কারাসূত্রে জানা যায়, লাল সাংময় মৃত্যুশয্যায় আছেন। সাংময়ের শারীরিক অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি ঘটলে তার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে, দায় এড়ানোর লক্ষ্যে গত ২৯ মে তড়িঘড়ি করে তাকে জামিন দেয়া হয়। কারাগারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ৩১ মে চমেক থেকে ছাড়া পেয়ে সেদিনই নিজ গ্রামে ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন লালসাংময় বম।

গত ১৭ জুলাই ২০২৫ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ভান লাল রুয়াল বম (৩৫) বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন। চমেক ও চট্টগ্রাম কারাগারের তথ্যমতে, লাল ত্লেং কিমের মতোই হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ভান লাল রুয়াল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। কারা কর্তৃপক্ষ আরও জানান, ১৬ জুলাই রাত ১২টার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারাগারেই কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরিস্থিতি খারাপ দেখলে রাত ১টার পর তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবারগুলোর অভিযোগ তারা কেউই কেএনএফ সংশ্লিষ্ট বা অপরাধী ছিলেন না। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, এর ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত কোনো চার্জশিট দেয়নি পুলিশ। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একজন অপরাধীরও জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল যৌথ বাহিনীর গণগ্রেপ্তারের শিকার শিউলি বম চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী আছেন। বম জাতিগোষ্ঠীর এই নারী থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। বান্দরবানের নিম্ন আদালতে তিনি জামিন পাননি। সর্বশেষ গত ২৮ জুলাই, উচ্চ আদালতে শিউলিসহ ১১ জন নারীর জামিন আবেদনের শুনানি হলেও জামিন মেলেনি। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে ৪ জন নিরপরাধ নারীর জামিন মঞ্জুর হলেও, পরবর্তীতে সরকার পক্ষের বিরোধীতায় তা আটকে যায়। “শুধুমাত্র সন্দেহবশত অপরাধী হিসেবে বছরের পর বছর রাষ্ট্রের নাগরিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না” বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

২০২৪ সালে বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতির জের ধরে যৌথ অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে বম জাতিগোষ্ঠীর ওপর ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শুরু হয়েছে, যা জাতিগত নিধনের শামিল। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে ধরপাকড়, নির্যাতন, গুমের অভিযোগ ও পরিবারের সাথে শিশুদেরকেও অভুক্ত রাখাসহ একাধিক মিথ্যা মামলার শিকার হন নিরাপরাধ নারী, শিশু, শিক্ষার্থী ও বয়োজ্যেষ্ঠরাও।

অবশেষে কারাবন্দী অবস্থায় ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে’র শিকার হলেন লাল ত্লেং কিম বম, লালসাংময় বম ও ভান লাল রুয়াল বম। কিছু “কেএনএফ সদস্যদের কর্মকাণ্ড ও অপরাধ দমনের” নামে নির্বিচারে গ্রামবাসীকে আটক ও একাধিক মিথ্যা মামলায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলতে পারে না। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা ও নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি,’ বলে উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিৃবতিতে পাঁচটি দাবি জানানো হয়েছে। সেগুলো হলো:

১) চট্টগ্রাম কারাগারে লাল ত্লেং কিম বম, লালসাংময় বম ও ভান লাল রুয়াল বমের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের জবাবদিহিতা ও আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনতে হবে।

২) অবিলম্বে নিরপরাধ সকল বম নাগরিকের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে ও ক্ষতিগ্রস্তদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ক্ষতিপুরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।

৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও বম জাতিগোষ্ঠীর মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা, হাটবাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, জুম চাষ ও ব্যবসায়িক কাজের উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।

৪) সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে ব্যাংক ডাকাতি ঘটনার সাথে কেএনএফসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের শনাক্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। কেএনএফ ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে জাতিগত নিধন অভিযান চিরতরে বন্ধ করতে হবে।

৫) বম জাতিগোষ্ঠীকে ‘কালেক্টিভ পানিশমেন্ট’ প্রদানের কৌশল প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্বিচারে কারাবন্দী আদিবাসী বম বাসিন্দাদের মুক্তির পাশাপাশি পাহাড় ও সমতলের সকল আদিবাসীর সমান অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।


হিল ভয়েস, ৩ আগস্ট ২০২৫, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম কারা হেফাজতে বম জাতিগোষ্ঠীর তিন নাগরিকের মৃত্যু ও আটককৃত সকল নিরপরাধ …

(Feed generated with FetchRSS)

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *