কালুরঘাট দ্বিতীয় সেতু এখন স্বপ্ন নয় সত্যি, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আজ 

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

এক কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি কর্ণফুলী নদীতে কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতুর কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।  

তবে প্রথমবারের মতো এই ভিত্তিপ্রস্তরের স্মারক ফলকে নাম থাকছে না উদ্বোধনকারীর।যেকোনো ভিত্তিপ্রস্তরের স্মারক ফলকে উদ্বোধনকারীর নাম উল্লেখ করা যেন প্রচলিত নিয়ম। প্রচলিত সেই নিয়মের পরিবর্তন হয়েছে এবার। চট্টগ্রামে এই প্রথম কোনও স্মারক ফলকে উদ্বোধনকারীর নাম রাখা হয়নি।

আজ বুধবার (১৪ মে) চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা।

দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি কালুরঘাট সেতু নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী উৎফুল্ল। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর দিন বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সকাল ৯টায় কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে বোয়ালখালীর সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ ও বোয়ালখালী কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে একটি আনন্দ মিছিল বের করা হবে।

মিছিলটি সেতুর পশ্চিম প্রাপ্ত থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হবে।

আনন্দ মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য বোয়ালখালীর সর্বস্তরের নাগরিক সমাজের পক্ষে সৈয়দ জাকির হোসাইন, সাংবাদিক মনজুর মোরশেদ ও বোয়ালখালী কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষে আহ্বায়ক আবদুল মোমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক মুস্তফা নঈম বোয়ালখালীর সর্বসাধারণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, ‘ বুধবার কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তার নির্দেশনায় স্মারক ফলকে উদ্বোধনকারী হিসেবে তার নাম রাখা হয়নি। এটি ভিত্তিপ্রস্তরের স্মারক ফলকের ইতিহাসে ব্যতিক্রম। এর আগে এমনটি হয়নি। উদ্বোধনকারীর নাম রাখা ছিল প্রচলিত নিয়ম। প্রথমবার কোনও নতুন প্রকল্পের স্মারক ফলকে নাম উল্লেখ করা হয়নি। আমদের ওভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সব প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা।’

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, নতুন কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুর অনুষ্ঠান হবে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ চত্বরে। অনুষ্ঠান আয়োজন চলবে বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত।

রেলওয়ে জানিয়েছে, বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাটে একটি সেতু রয়েছে। এটি ১৯৩১ সালে নির্মাণ করেছিল ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ৬৩৮ মিটার দীর্ঘ সেতুটি ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় সংস্কার করেছিল রেলওয়ে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পর ২০২৩ সালে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি আরেক দফা সংস্কার করা হয়। এরপরও অবস্থা জরাজীর্ণ। ভারী যানবাহন চলতে দেওয়া হচ্ছে না। এসব যানবাহন চলছে ফেরি দিয়ে। এ ছাড়া সেতুটি একমুখী। একদিক থেকে যানবাহন এলে অপর প্রান্তের যানবাহনগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হয়। এসব কারণে যাত্রী ও চালকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফলে নতুন সেতুর উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে রেলওয়ে। ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নতুন সেতুর কাজ শুরু হয়ে ২০৩০ সালে সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরুর কথা আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকৌশলী আবুল কালাম চৌধুরীকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, সেতু নির্মাণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে সহজ শর্তে ৮১ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশি নয় হাজার ৫৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসাবে)। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ৭২ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএস) তহবিল থেকে নয় কোটি এক লাখ ৮০ হাজার ডলার দেওয়া হবে।

সেতুর প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান রেল সেতুর ৭০ মিটার উজানে নতুন সেতু নির্মিত হবে। দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অপর পাশে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন চলবে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ছয় কিলোমিটার।

সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে প্রতিদিন ২০ জোড়া ট্রেন এবং দিনে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। এর মাধ্যমে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি উপকৃত হবেন। সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কোটি মানুষ কালুরঘাটে নতুন সেতুর অপেক্ষায় আছেন।

রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংস্কারকাজ শেষে প্রায় ১৫ মাস পর গত ২৭ অক্টোবর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের পুরাতন কালুরঘাট সেতু। বহু বছরের পুরোনো হওয়ায় সেতুটি দিয়ে ৮ ফুট উচ্চতার বেশি গাড়ি চলাচল করতে দেওয়া হয় না। সংস্কারকাজের জন্য ২০২৩ সালের ১ আগস্ট সেতু দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে ৪৩ কোটি টাকার সংস্কারকাজের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ছয় মাস। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর্থিক সংকট, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক কারণে সংস্কারকাজ বিলম্ব হয় বলে দাবি করে রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু দিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এবং পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়ার একটি অংশের মানুষ চট্টগ্রাম নগরে আসা-যাওয়া করে থাকেন।

এরই মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ করে রেলওয়ে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ৯৩ বছরের পুরোনো এই সেতু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংস্কারকাজ শুরুর তিন মাসের মধ্যে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হয়। ২০২৩ সালের নভেম্বরে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়। আর ১ ডিসেম্বর থেকে এই লাইনে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। মাঝেমধ্যে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় এবং সংস্কারের প্রয়োজন পড়ায় দুর্ভোগের সৃষ্টি হওয়ার কারণে নতুন একটি সেতুর দাবি জানিয়ে আসছিল স্থানীয়রা। অবশেষে তাদের দাবি পূরণ হতে চলছে।

আর এইচ/

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *