কাসেম বাসির: ইরানের সবচেয়ে নির্ভুল

Google Alert – সামরিক

২০২৫ সালের জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরায়েল যখন প্রথমবারের মতো সরাসরি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখোমুখি হয়, তখন আলোচনায় উঠে আসে একটি নতুন নাম—‘কাসেম বাসির’। এটি শুধু একটি ক্ষেপণাস্ত্র নয়, বরং ইরানের আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা শিল্পের মাইলফলক।


কাসেম বাসিরের ভূমিকা


১২ দিনের যুদ্ধ শুরুর মাসখানেক আগে ‘কাসেম বাসির’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় ইরান। ওই সময় ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমির আজিজ নাসিরজাদে বলেছিলেন, “এই ক্ষেপণাস্ত্র নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে বহু লক্ষ্যবস্তুর মাঝ থেকেও খুঁজে নিতে সক্ষম এবং এক মিটারও হেরফের ছাড়াই আঘাত হানতে পারে। এটি জিপিএস নেভিগেশনের ওপরও নির্ভরশীল নয়। ”


১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের জবাবে ইরান প্রতিদিন গড়ে ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। তবে, একদিন ইরান কেবল একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে—সেটি প্রতিরোধ করা যায়নি এবং সরাসরি লক্ষ্যে আঘাত করে। যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্যসূত্রে বলা হয়, সেটিই ছিল ‘কাসেম বাসির’। এই ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় দখলকৃত হাইফা শহর কেঁপে ওঠে। এতে প্রমাণিত হয় যে, ইসরায়েল তাদের আকাশ রক্ষা করতে ব্যর্থ। এমনকি এক-দেড় বিলিয়ন ডলারের মার্কিন ‘থাড’ (THAAD) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে পারেনি। ইরানের দাবি, এই ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের থাড ও প্যাট্রিয়ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে লক্ষ্যবস্তুতে সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।


উন্মোচন ও কৌশলগত গুরুত্ব


২০২৫ সালের ৪ মে মধ্যমপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘কাসেম বাসির’ উন্মোচন করা হয়। তবে, এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচনের আগে পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৭ এপ্রিল। ইরানি টিভিতে ওইদিন পরীক্ষা সম্পর্কিত একটি ফুটেজ সম্প্রচার করা হয়। এতে কাসেম বাসিরের উৎক্ষেপণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর ওপর এর সুনির্দিষ্ট প্রভাব দেখানো হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্রটির নামকরণ করা হয়েছে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর আল-কুদস ফোর্সের কমান্ডার শহীদ কাসেম সোলাইমানির নামে, যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালে ইরাকে হত্যা করেছিল।


ক্ষেপণাস্ত্রটি উন্মোচনের পর ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ নাসিরজাদেহ জাতীয় টেলিভিশনে বলেন, “কাসেম বাসির ইরানের সবচেয়ে নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র, যা আমরা যুদ্ধে এখনও ব্যবহার করিনি। তবে প্রয়োজনে এটি হবে আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ”


বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুদ্ধের আগে কাসেম বাসির উন্মোচন ইরানের একটি পরিকল্পিত মনস্তাত্ত্বিক কৌশল। তেহরান বোঝাতে চেয়েছে, যদি সংঘাত দীর্ঘায়িত হয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তাদের হাতে এমন অস্ত্র রয়েছে যা শত্রুর সবচেয়ে সংবেদনশীল ঘাঁটি ও কৌশলগত অবকাঠামো ধ্বংস করতে সক্ষম।


প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য 


কাসেম বাসির একটি কঠিন-জ্বালানিচালিত সবচেয়ে নির্ভুল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। অর্থাৎ এতে তরল জ্বালানির মতো জটিল প্রস্তুতি বা আলাদা জ্বালানি ভরার প্রয়োজন নেই। এই কারণে এটি অল্প সময়ে উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত করা যায়, কমসংখ্যক জনবল লাগে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েনের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।


ইলেকট্রনিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্রটি উন্নত নেভিগেশন এবং থার্মাল ইমেজিং সিস্টেম দিয়ে সজ্জিত। এর পাল্লা ১২০০ থেকে ১৪০০ কিলোমিটার।


এই ক্ষেপণাস্ত্রের নেভিগেশন সিস্টেম ডিজাইন করার সময়, ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহাকাশ বিশেষজ্ঞরা জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করেননি, যার ফলে ইলেকট্রনিক যুদ্ধ মোকাবেলায় প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। এছাড়াও, ক্ষেপণাস্ত্রটি শত্রুপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি মধ্য দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।


‘কাসেম বাসির’ গুরুতর ইলেকট্রনিক জ্যামিং পরিস্থিতিতেও সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধ মোকাবেলায় এই ক্ষেপণাস্ত্রের উচ্চ ক্ষমতা রয়েছে।



‘শহীদ হাজ কাসেম’ ক্ষেপণাস্ত্র


‘শহীদ হাজ কাসেম’ থেকে ‘কাসেম বাসির’


কাসেম বাসির ক্ষেপণাস্ত্রের পূর্বসূরি হলো ‘শহীদ হাজ কাসেম’ ক্ষেপণাস্ত্র। এটি একটি দুই-পর্যায়ের কৌশলগত কঠিন জ্বালানির আধা-ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা ২০২০ সালের আগস্টে উন্মোচিত হয়েছিল এবং শহীদ ইরানি কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির নামে নামকরণ করা হয়েছিল।


এই ক্ষেপণাস্ত্রটির মোট ভর প্রায় ৭ টন, যার মধ্যে ৫০০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি ওয়ারহেড বহন করে। ক্ষেপণাস্ত্রটির দৈর্ঘ্য ১১ মিটার। এর বায়ুমণ্ডলীয় প্রবেশ গতি ম্যাক ১১ এবং প্রভাব গতি ম্যাক ৫, যা এটিকে হাইপারসনিক ডোমেইনে স্থাপন করে।


হাজ কাসেমের রিপোর্ট করা পাল্লা ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এটি উন্মোচনের সময় বলা হয়েছিল যে, ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লা বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করা হয়েছে।


ভবিষ্যতের যুদ্ধে ব্যবহার


প্রশ্ন আসে আগামীতে যদি ইসরায়েল আবার আগ্রাসী হয়, তবে ইরান কি এই শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করবে? অনুসন্ধান বলছে, ইরানি সামরিক বাহিনীর হাতে ইতোমধ্যেই এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তারা যখন খুশি, তখনই এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।


ইরানের খাতামুল-আম্বিয়া (সা.) সামরিক ঘাঁটির সাইবার ও নতুন হুমকি মোকাবিলাবিষয়ক কমান্ডার মুস্তাফা ইযাদি বলেন, “আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র শিল্পে বহু ক্ষমতা আছে, যার মধ্যে কেবল কিছু এখন পর্যন্ত চালু হয়েছে। এ সক্ষমতাগুলোই শত্রুর ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছিল। ”


তিনি আরও বলেন, “একটি ক্ষেপণাস্ত্রই যদি দখলদার ভূখণ্ডে লক্ষ্যভেদ করে, তবে তা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অনন্য সামরিক সামর্থ্যের প্রমাণ। ”


কাসেম বাসিরের সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু


যদি ভবিষ্যতে ইসরায়েলি বাহিনী নতুন করে আগ্রাসন শুরু করে, তবে কাসেম বাসির ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরান নিচের কৌশলগত লক্ষ্যগুলোতে আঘাত হানতে পারবে:


১. হাইফার বিদ্যুৎকেন্দ্র

২. হাইফার কৌশলগত ‘বাজান’ শোধনাগার

৩. হাইফার বিশেষ ট্রেন স্টেশন ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

৪. হাইফার গ্যাস শোধনাগার

৫. তেল-আবিবের উপকণ্ঠ রামাত গান ও বেত ইয়াম (যেখানে সাম্প্রতিক যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল)

৬. তেল-আবিবে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়

৭. বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

৮. ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভূগর্ভস্থ অপারেশন সেন্টার

৯. তেল-আবিব ও নেগেভ মরুভূমির সামরিক ও পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র

১০. দিমোনা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।


কৌশলগত প্রভাব


কাসেম বাসিরের উপস্থাপন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দাবিকৃত ব্যবহারের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিবেশ ও সামরিক কৌশলে একটি বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।


১. ইসরায়েলকে চাপ দেওয়া: তেলআবিবের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলো ১২০০–১৪০০ কিমি রেঞ্জের মধ্যে পড়ায় এটি সরাসরি ইসরায়েলকে লক্ষ্যবস্তুতে রাখে।


২. মার্কিন ঘাঁটিতে হুমকি: উপসাগরীয় দেশগুলোতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিগুলোও এই রেঞ্জের আওতায়, যা যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে নিরুৎসাহিত করে।


৩. প্রতিরোধ শক্তিগুলোকে সমর্থন: ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধ শক্তি লেবাননের হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ যদি ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রযুক্তি পায়, তবে আঞ্চলিক ভারসাম্য আরও বদলে যেতে পারে।


‘কাসেম বাসির’ একদিকে যেমন শত্রুর জটিল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেওয়ার দাবি করছে, অন্যদিকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে তুলেছে।


১২ দিনের যুদ্ধে এর ব্যাপক ব্যবহার না হলেও, এর একটি ক্ষেপণাস্ত্রই  যথেষ্ট ছিল প্রতিপক্ষের ঘুম কেড়ে নেয়ার জন্য। সে কারণে ইরানের সামরিক অভিধানে ‘কাসেম বাসির’ এখন কেবল একটি অস্ত্র নয়, বরং ‘সবচেয়ে নির্ভুল আঘাতের প্রতিশ্রুতি’—যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।


এমজেএফ

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *