Google Alert – সামরিক
জাতিসংঘের সদরদপ্তর, নিউ ইয়র্কে এখন সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০ তম অধিবেশন চলমান। আর এ উদ্দেশ্যে বিশ্ব নেতারা সেখানে একত্রিত হচ্ছেন। বরাবরের মতোই, সাধারণ পরিষদের সভাগুলোতে গাজা ও ইউক্রেন সংকটের মতো বর্তমান ও তাৎক্ষণিক শিরোনাম দিয়েই আলোচনার বিষয়বস্তু সাজানো হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, ‘প্রকৃত সংকট’ বা সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলো এসেছে সেসব ঘটনা থেকেই যা এধরণের জমায়েতে আলোচনায় হয়নি। আগের অধিবেশনগুলোতেও বড় বড় বৈশ্বিক সংকটগুলো আগে থেকে কেউই আঁচ করতে পারেনি। যেমন ২০১৩ সালে আইসিসের প্রভাব, ২০২৩ সালে হামাসের হামলা বা ২০১৯ এর কোভিড মহামারি—এ উদাহরণগুলো দেখায়, ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলো প্রায়ই আলোচনার বাইরেই থেকেযায়।
বর্তমান বিশ্বে যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোর নিরবচ্ছিন্ন গতি সামনে বড় কিছু ঘটার পূর্বাভাসই দিচ্ছে। আমরা যদি সামনে তাকাই, তাহলে যেসব ঘটনা ঘটছে সেসবকে বড় পরিবর্তনের প্রারম্ভিক ইঙ্গিত ধরা যায়।
বর্তমান সংকটের কোনো সহজ সমাধান নেই
গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর মানবিক বিপর্যয় বেড়েছে, যা সমাধানের কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি এবং হামাসকে নিরস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তারা এ সংকটের বাস্তব সমাধান করতে পারবে না। বরং এসব প্রতীকী পদক্ষেপ ইসরায়েলের পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও হামাসের কঠোর মনোভাবের কারণে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।
ইউক্রেনেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে বারবার পরিবর্তন এসেছে, যেমন—যুদ্ধবিরতির আহ্বান, সামরিক সহায়তা বন্ধ ও পুনরায় শুরু, নিষেধাজ্ঞার হুমকি কার্যকর না হওয়া। গত আগস্টে ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে পুতিনের লক্ষ্য যে ‘জমি দখল’, সেটিও পরিষ্কার হয়েছে। তিনি নিশ্চিত করতে চান যে, হোক যুদ্ধ বা কূটনীতি—যেকোনো মাধ্যমেই ইউক্রেনকে দুর্বল করা। কিন্তু ইউক্রেন এসব শর্ত মানবে না, ফলে কূটনৈতিক সমাধান অনিশ্চিত।
সুতরাং, জাতিসংঘের সভাগুলোতে সর্বাধিক আলোচিত এ দুই সংকটের আদতে কোনো সহজ সমাধান বাস্তব পরিবর্তনের পথ নেই। এমনকি আজ পর্যন্ত পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কোনো ঐকমত্যও নেই। অবস্থাদৃষ্টে ২০২৬ সালেও এ পরিস্থিতি চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে একটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত পর শহরের আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়। ছবি: গ্লেব গারানিচ / রয়টার্স
বৈশ্বিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও দ্বৈত বাস্তবতা:
একদিকে জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবসম্মত কোনো সমাধান দিতে পারছে না, অন্যদিকে বেইজিংয়ে সিআরআইএনকে (চীন-রাশিয়া-ইরান-উত্তর কোরিয়া) জোটের সম্মেলন। এতে বিশ্বের নেতৃত্বে একটি নতুন জোট উত্থানের বার্তা স্পষ্ট হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়াকে সহায়তায় ইরানের ড্রোন, উত্তর কোরিয়ার সেনা এবং চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা শুধুমাত্র প্রতীকী নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ২০২৭ সালের মধ্যে তাইওয়ান আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বর্তমানে শি জিনপিং সাইবার হামলা, প্রচার, অর্থনৈতিক চাপের মতো ‘গ্রে জোন’ কৌশল ব্যবহার করলেও সরাসরি যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে। যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তবে গ্লোবাল গার্ডিয়ানের মতে, তাইওয়ান আক্রমণের সম্ভাবনা এখন ৩৫ শতাংশ। ইউক্রেন সংকট ও নতুন এ জোটের সক্রিয়তা দেখিয়ে দিচ্ছে, বিশ্ব এখন আরও অনিশ্চিত ও সংঘাতপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।
২০২৬: এক মোড় ঘোরানো বছর
বেইজিং সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দেওয়া। এখন প্রশ্ন—ওয়াশিংটন পাল্টা কী বার্তা দিতে চাইবে? অবশ্য সম্মেলনের ছবি দেখে এটাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অভিহিত করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মন্তব্য করেন, ‘তারা চাচ্ছিল আমি যেন তা দেখি।’
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বছর ২০২৬, যা হতে পারে বিশ্বে স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের সূচনা, অথবা বিশৃঙ্খলা ও সংঘাতের নতুন অধ্যায়। যদি সীমান্ত পেরিয়ে আগ্রাসনের খরচ কমে যায়, তাহলে সিআরআইএনকে (চীন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া) জোট আরো সাহসী হবে। আর যদি খরচ বাড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক জোটগুলো (ন্যাটো, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন) শক্তিশালী হয়, তাহলে স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বাড়বে।
এর সঙ্গেই আবার যুক্তরাষ্ট্র-চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতিযোগিতা যুক্ত হয়েছে। যা ঠান্ডা যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব। সব মিলিয়ে, ২০২৬ হতে পারে এ প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর।
বিশ্বে ঐক্য নাকি বিশৃঙ্খলা আসবে?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মোটাদাগে ইউক্রেন সংকটকে পূর্ব ইউক্রেনের একটি উত্তরাধিকার সমস্যা হিসেবে দেখেন। আবার তার কিছু উপদেষ্টা এটিকে আমেরিকার স্বার্থের বাইরে বলে মনে করেন, এবং তারা তাইওয়ান সংকটের প্রতিরোধে মনোযোগ দেওয়ার পক্ষে। এ দৃষ্টিভঙ্গি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি বৈশ্বিক প্রভাবকে উপেক্ষা করে।
সিআরআইএনকে (চীন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া) জোট তাদের ভবিষ্যৎ স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ইউক্রেনকে দেখছে। সে অনুযায়ীই তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে। একইকারণে, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মার্কিন মিত্ররা ইউক্রেনকে সমর্থন করছে। কেননা রাশিয়ার পরাজয় শি জিনপিংয়ের আগ্রাসী মনোভাবকে ঠেকাতে সাহায্য করবে। এজন্য আগামী বছরে কৌশল নির্ধারণের জন্য ত্রি-মাত্রিক চিন্তা দরকার। পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন জোটকে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়িয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন এবং যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। একইভাবে, গাজা যুদ্ধের অবসান এবং আঞ্চলিক সংহতির পথে ফিরে যাওয়াও জরুরি। এতে করে ইরানের প্রভাব সীমিত থাকবে।
কিন্তু, যদি এ দুটি সংঘাত চলতেই থাকে, তাহলে বৈশ্বিক শৃঙ্খলা আরও দুর্বল হবে, আর সিআরআইএনকে জোট বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তৃত করবে।
এখন, এটাই সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যা নিউ ইয়র্কে সাধারণ পরিষদের আলোচনায় খুব কমই আসবে। অথচ এটি বিশ্ব নিরাপত্তা ও আমেরিকার অবস্থানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।