শুক্রবার আগস্ট ২২, ২০২৫ ০৪:২৯ অপরাহ্ন সর্বশেষ আপডেট: শুক্রবার আগস্ট ২২, ২০২৫ ০৪:২৯ অপরাহ্ন
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: এএফপি
“>
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ফাইল ছবি: এএফপি
গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেশের আপত্তি ও আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র নিন্দা সত্ত্বেও গাজা উপত্যকার পরিপূর্ণ দখল নিতে নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু করেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী।
কিন্তু সবার মনে যে প্রশ্ন জেগেছে, তা হলো, বরাবরই সমীহ জাগানিয়া ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) কি এখনো তাদের সেই শক্তিমত্তা ধরে রাখতে পেরেছে?
অনেকেই বলছেন, ভালো অবস্থায় নেই আইডিএফ। মূলত রিজার্ভ সেনাদের ওপর নির্ভর করে হামাসের ‘তথাকথিত’ আস্তানায় নেতানিয়াহুর অভিযানকে আত্মঘাতী ও খ্যাপা বলতেও ছাড়ছেন না বিশ্লেষকরা।
নতুন ও সম্প্রসারিত এই সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আইডিএফ হাজারো রিজার্ভ সেনাদের ডেকে পাঠিয়েছে।
দুই বছরের নিরবচ্ছিন্ন সামরিক অভিযান ও আগ্রাসনে ইতোমধ্যে গাজার ৮০ ভাগ জায়গা আইডিএফের দখলে আছে। বাকি থাকা অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম উত্তরাঞ্চলে কার্যত গাজার রাজধানী হিসেবে বিবেচিত ‘গাজা সিটি’। গাজার সবচেয়ে বড় এই শহরটিকে ‘হামাসের সর্বশেষ আস্তানার’ অন্যতম বলে আখ্যা দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
গাজা দখল পরিকল্পনার কেন্দ্রে ‘রিজার্ভ সেনা’
গাজা সিটির দখল নিতে ২০ হাজার রিজার্ভ সেনার নিয়োগ চুক্তি নবায়ন করেছে আইডিএফ। পাশাপাশি, আরও ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকেও আগামী সাত দিনের মধ্যে এই অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আইডিএফ।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে রিজার্ভিস্ট (রিজার্ভ সেনা) রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
“>
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে রিজার্ভিস্ট (রিজার্ভ সেনা) রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
আইডিএফের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন গতকাল বুধবার জানান, ইতোমধ্যে আইডিএফের সেনারা গাজা সিটির উপকণ্ঠে অবস্থান নিয়েছে। একে গাজা সিটি দখলের বৃহত্তর সামরিক অভিযানের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
যুদ্ধকালীন নিরাপত্তা মন্ত্রিসভায় গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়ার পর ইসরায়েলি কর্মকর্তারা হিসেব কষে বের করেন, এই অভিযানে অন্তত পাঁচ মাস সময় ও পাঁচ ডিভিশন সেনা প্রয়োজন।
তবে গত বুধবার নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীকে এই সময়সীমা কমিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে সক্রিয় সেনার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। যখন যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দেয়, তখন ‘রিজার্ভ’ সেনাদের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তাদেরকে অস্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষে তারা আবার ‘ছুটিতে’ চলে যান।
ক্লান্ত, বিষণ্ণ ও বিপর্যস্ত সেনা
তবে টানা দুই বছর ধরে শুধু হামাস নয়, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি ও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থেকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। অনেকেই শারীরিক ও মানসিক আঘাত পেয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে অনেকেই মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন।
অনেকে ছুটিতে থাকার সময়ও একাধিকবার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ডাক পেয়েছেন।
নিহত সহযোদ্ধাদের জন্য ইসরায়েলি সেনার শোক। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
“>
নিহত সহযোদ্ধাদের জন্য ইসরায়েলি সেনার শোক। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
চলতি মাসের শুরুতে আইডিএফের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা দীর্ঘসময় ধরে যুদ্ধে থেকে ক্লান্ত ও অবসাদে ভুগছে। তিনি নতুন এই অভিযানের ঘোরতর বিরোধিতা করেন। তিনি আরও মত দেন, এই অভিযানে হামাসের হাতে আটক থাকা বাকি জিম্মিদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
তবে নেতানিয়াহু তার এসব মতামত উড়িয়ে দেন। তিনি ও তার জোট সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীরা যুদ্ধ-পরিকল্পনায় সম্মতি দেন।
হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুসালেমের আওতাধীন আগাম ল্যাবসের একটি নতুন জরিপে জানা গেছে, সেনাদের মধ্যে ৪০ শতাংশই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পাচ্ছেন না। মাত্র ১৩ শতাংশ সেনা এখনো উৎসাহ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে চান।
এই জরিপে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভঙ্গুর মানসিকতার চিত্র ফুটে উঠেছে।
বেশিরভাগ সেনা মনোবলের অভাবে ভুগছেন। জরিপে আরও জানা গেছে, বেশিরভাগ সেনা চান অবিলম্বে এই যুদ্ধ শেষ হোক।
সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারকে ধর্মীয় রক্ষণশীল (আলট্রা-অর্থোডক্স) ইসরায়েলিদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিধান চালুর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ওই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ সদস্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন।
ইসরায়েলে ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিধি থেকে বাদ রাখা হয়েছে। তবে গাজার যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলছে। রক্ষণশীলদের অভিযোগ, সরকার অহেতুক এ বিষয়টি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরতে চান না রিজার্ভ সেনারা
চলমান পরিস্থিতিতে রিজার্ভ সেনাদের সংগঠন ‘সোলজার্স ফর হোস্টেজেস’ এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে। তারা আইডিএফের আর্জিকে অগ্রাহ্য করতে সেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সেনাদেরকে সংগঠনটি বলছে ‘আইডিএফের অন্যায্য আহ্বানে সাড়া দেবেন না।’
কিছু বিশ্লেষণে জানা গেছে, রিজার্ভ সেনাদের অনেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর আবারও তাদেরকে ডেকে পাঠানো হলে তারা আর ফেরেন না।
আইডিএফের রিজার্ভ সেনাদের মনোবল চাঙ্গা করতে ইহুদী ধর্মীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হচ্ছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স
“>
আইডিএফের রিজার্ভ সেনাদের মনোবল চাঙ্গা করতে ইহুদী ধর্মীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হচ্ছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স
উল্লেখ্য, ছুটিতে বা ‘রিজার্ভ’ অবস্থায় থাকা সেনাদের মধ্যে কত শতাংশ ফিরে আসেনি, সে বিষয়ে কোনো তথ্য আইডিএফ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে না।
তবে সম্প্রতি তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিআরটি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় এক লাখ রিজার্ভ সেনা ছুটি শেষে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরেনি।
রিজার্ভ সেনা আভশালম জোহার সাল গত দুই বছরে চার বার গাজার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ৩০০ দিন তিনি গাজার যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়েছেন। সর্বশেষ এক মাস আগে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফেরেন এই রিজার্ভ সেনা।
আইডিএফের ডাকে আপাতত আর সাড়া দিতে আগ্রহী নন জোহার। বিশেষত, গাজায় যেতে তিনি একেবারেই ইচ্ছুক নন।
জোহার সাল সিএনএনকে বলেন, ‘আমি বিস্মিত, কারণ আমরা এখনো এমন এক যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছি যেটা আরও অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা’।
তিনি এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান। জানান, প্রায় এক বছর আগে থেকে তার মধ্যে দ্বিধার সৃষ্টি হয়। ক্রমশ তিনি ও তার ইউনিটের অন্যান্য সেনারা উদ্বেগে ভুগতে থাকেন।
গাজা দখলের পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত জিম্মিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার শামিল। এতদিন পর্যন্ত সরকার জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা ও হামাসকে পরাজিত করার বিষয়ে কথা বলছিল। এখন তারা শুধু একটি লক্ষ্যের কথা বলছে। যেকোনো মূল্য হামাসকে ধ্বংস করতে হবে।’
এবারের আহ্বানে কতজন সেনা সাড়া দেবেন, তা স্পষ্ট নয়। বিশেষত, সেনাপ্রধান নিজেই যখন বলেছেন এই অভিযানে সেনা ও জিম্মিদের প্রাণের হুমকি সৃষ্টি করবে।
এসব উদ্বেগ কমিয়ে আনার চেষ্টা চালান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ডেফরিন। বুধবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জিম্মিদের প্রাণ রক্ষা করতে আইডিএফ গোয়েন্দা তথ্য ও অন্যান্য সক্ষমতা কাজে লাগাচ্ছে। তিনি অঙ্গীকার করেন, ‘জিম্মিদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাব। তবে সেনাদের সুরক্ষার বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।
যদি কোনো রিজার্ভ সেনা নির্দেশ অমান্য করে কাজে যোগ দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
যুদ্ধে যোগ না দিলেও শাস্তি পাবেন না রিজার্ভ সেনারা
গত দেড় বছরের বিভিন্ন সময় ধরে রিজার্ভ সেনাদের একাধিকবার গাজায় পাঠানোর পর যখন সবাই ভাবছিলেন, যুদ্ধ শেষের পথে এবং শিগগির গাজায় যুদ্ধবিরতি চালু হবে, তখন নেতানিয়াহুর নতুন এই উদ্যোগ কার্যত সেনাবাহিনীকে বিব্রত করেছে।
নতুন এই অভিযানে কেউ যেতে না চাইলে বা এড়িয়ে গেলে তাকে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আইডিএফ কর্তৃপক্ষ একেবারে আগ্রহী নয় বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনাদের মুখের এই হাসি কি আর ফিরবে না? ফাইল ছবি: সংগৃহীত
“>
ইসরায়েলি রিজার্ভ সেনাদের মুখের এই হাসি কি আর ফিরবে না? ফাইল ছবি: সংগৃহীত
আইডিএফের সাবেক চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড্যান হালুৎজ ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তিনি পূর্বাভাষ দিয়েছেন, গাজা দখলের যুদ্ধে ডাক পাওয়া রিজার্ভ সেনাদের সবাই এতে যোগ দেবে না।
এ মাসে বিমানবাহিনীর রিজার্ভ সেনাদের এক বিক্ষোভসভায় তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি তাদের কেউ কেউ বাড়িতেই থাকবে। এক বছর আগেই এই যুদ্ধ শেষ হয়েছে।’
যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ‘কোনো যুক্তি’ নেই বলে মত দেন সাবেক জেনারেল। সরাসরি রিজার্ভ সেনাদের দায়িত্ব এড়াতে না বললেও হালুৎজ মন্তব্য করেন, ‘আপনারা নিজেদের বিবেক অনুযায়ী কাজ করুন। নিজস্ব নীতিতে অটল থাকুন।’
নেতানিয়াহুর মিথ্যে আশ্বাস ও খ্যাপা অভিযান
এক বছরেরও বেশি সময় আগে নেতানিয়াহু বলেছিলেন শিগগির যুদ্ধ শেষ হবে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, দক্ষিণ গাজার রাফায় অভিযান চালানোর পর যুদ্ধ শেষ হবে।
‘কয়েক মাস নয়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই যুদ্ধের সবচেয়ে তীব্র পর্যায়ের অবসান হবে’, সে সময় বলেন তিনি।
কিন্তু ওই বক্তব্যের ১৮ মাস পর, নেতানিয়াহু বলছেন, ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধ অবসানের ‘দ্রুততম উপায়‘ গাজা দখলের এই অভিযান।
আইডিএফের রিজার্ভ সেনা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
“>
আইডিএফের রিজার্ভ সেনা। ফাইল ছবি: রয়টার্স
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মহল ও ইসরায়েলি সেনাপ্রধানের অভিযোগ, ১০ লাখ মানুষের শহর গাজা সিটিতে নেতানিয়াহুর এই অভিযান অযৌক্তিক।
এতে ইসরায়েলি জিম্মিসহ অসংখ্য ফিলিস্তিনির জীবন বিপন্ন হবে। সেনারাও নিরাপদ থাকবেন না।
পাশাপাশি, ২২ মাসের যুদ্ধে গাজার ২০ লাখ মানুষ তীব্র মানবিক সঙ্কটে ভুগছে। ইতোমধ্যে ইসরায়েলি হামলায় ৬২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি হয়েছে।
সব মিলিয়ে, অনিচ্ছুক ও ক্লান্ত রিজার্ভ সেনাদের নিয়ে নেতানিয়াহুর নতুন এই অভিযানকে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘খ্যাপা’ অভিযান বললে তেমন একটা ভুল হবে না।