Google Alert – সেনাবাহিনী
ছবির উৎস, Samir Mallik
বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি একজন কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর আজও জেলা সদর ও গুইমারা উপজেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ আজ সোমবার তিন পার্বত্য জেলায় ‘অনির্দিষ্টকালের অবরোধ’ কর্মসূচি পালন শুরু করেছে। একই সাথে তারা তিন জেলায় সব পর্যটন সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে।
তবে আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের সৎকারের সুবিধার্থে ঢাকা-খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি সড়কে দুপুর ১২টা থেকে অবরোধ শিথিল করা হয়েছে।
একই সাথে খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসন যেসব জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিলো, তাও অব্যাহত আছে।
জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর টহল ও অবস্থান জোরদার করা হয়েছে। নতুন করে আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
তবে খাগড়াছড়ির পাশাপাশি অপর দুই পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালনের কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। ওই দুই জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, শনিবার খাগড়াছড়ি সদরে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর রোববার গুইমারায় ব্যাপক সহিংসতার সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসময় সেনাবাহিনীর ১৩ জন সদস্য আহত হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত রাতে জানিয়েছিলো।
ছবির উৎস, Samir Mallik
সদর ও গুইমারার সর্বশেষ পরিস্থিতি
প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছাড়াও জেলায় কর্মরত সাংবাদিক, স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙ্গালি উভয় পক্ষের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলা সদর ও গুইমারাসহ বিভিন্ন জায়গায় সেনা সদস্যরাসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান করছে।
আজ সকাল থেকে সদরে অল্প কিছু অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। তবে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। শহরের মোড়ে মোড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। অনেক ক্ষেত্রে রাস্তায় আসা লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেও দেখা গেছে তাদের।
গুইমারা বাজারেও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখেছেন সংবাদ কর্মীরা। সদর থেকে গুইমারা আজ যেসব সাংবাদিক গিয়েছেন, তাদের কয়েকজন জানিয়েছেন যে, গুইমারায় আজ সাপ্তাহিক বাজার বসার কথা থাকলেও তা দেখা যায়নি। বাজারে মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেছেন, জেলার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে জেলা প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সবাই একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
“নতুন করে আর কোনো অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার খবর আমরা পাইনি। আমরা সবাই একযোগে এসব বিষয়ে কাজ করছি। আশা করি সব ঠিক হয়ে আসবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
গুইমারার স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, বাজারে ও অন্য সড়কে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির পাশাপাশি তারা আকাশে ড্রোন দেখতে পেয়েছেন।
“একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। কেউ বের হচ্ছে না। অনেকে আহত হয়ে পড়ে আছে, যাদের ভয়ে সদর হাসপাতালের দিকে নেওয়া যাচ্ছে না। অনেকে খাবার সংকটে পড়েছেন। কারণ বহু দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে,” গুইমারা থেকে বলছিলেন মারমা জনগোষ্ঠীর একজন। তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
ছবির উৎস, Nuruchsafa Manik
গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক চৌধুরী অবশ্য বলছেন, এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক আছে বলেই তারা মনে করছেন।
“এখানে আজ কোনো পিকেটিং নাই। আর্মি, বিজিবি, পুলিশসহ আমরা সবাই সতর্ক অবস্থায় আছি। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আশা করি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক মো: আব্দুল মজিদ ও মারমা ঐক্য পরিষদের খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি মংখই মারমাও বলেছেন, খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি আজ অনেকটা শান্ত।
“পরিবেশ শান্ত কিন্তু থমথমে হয়ে আছে। সদরে অল্প কিছু যানবাহন চোখে পড়েছে। সেনাসদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় আছেন। গুইমারার দিক থেকেও আমরা নতুন করে কোনো সহিংসতার খবর পাইনি,” বলছিলেন মি. মজিদ।
মংখই মারমা বলছেন, গুইমারায় গতকাল আহতদের অনেককে চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে আনা হয়েছে। “সেখানে আর নতুন করে কিছু ঘটেনি,” বলছিলেন তিনি।
জেলায় গত দুদিনের সহিংসতায় পাহাড়ি ও বাঙ্গালিরা পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছিলো। গুইমারায় পাহাড়িরা তাদের দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলার জন্য স্থানীয় বাঙ্গালিদেরই দায়ী করেছিলো।
আবার বাঙ্গালি সংগঠনগুলোর নেতারা বাঙ্গালিদের স্থাপনায় হামলা ও লুটপাটের জন্য পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে দায়ী করে আসছে।
ছবির উৎস, Nuruchsafa Manik
আন্দোলনকারী সংগঠন জুম্ম ছাত্র জনতা গুইমারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় তদন্ত এবং ১৪৪ ধারা বাতিলসহ আট দফা দাবিতে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। তবে তারা শান্তিপূর্ণভাবে এই কর্মসূচি পালনের জন্য আহবান জানিয়েছে।
এদিকে গুইমারায় সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩ জনের মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সেটি ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিলো, “বিগত কয়েকদিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট যে, ইউপিডিএফ এবং তার অঙ্গসংগঠন সমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার মহিলা এবং স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে”।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “একই সাথে পার্বত্যাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠনের লক্ষ্যে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে”।
জবাবে জুম্ম ছাত্র জনতা সামাজিক মাধ্যমে তাদের পেইজে দেয়া বিবৃতিতে বলেছে, “খাগড়াছড়ি ও গুইমারার ২৭-২৮ সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলী সম্পর্কে সেনাবাহিনীর দেওয়া বিবৃতিতে বহু তথ্য আড়াল করা হয়েছে এবং বাস্তবতাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে”।
তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, ” ২৩ সেপ্টেম্বরের ধর্ষণ ঘটনার পর স্থানীয় জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছিল। চয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করা হলেও তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ছিল না এবং ভুক্তভোগীর পরিবারসহ সাধারণ মানুষ বারবার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছে”।
এতে বলা হয় , ” সেনাবাহিনী দাবি করছে যে, তারা সংযম ও মানবিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। অথচ বাস্তবে ঘরবাড়ি তল্লাশি, সাধারণ মানুষকে মারধর, নির্বিচারে আটক এবং দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের অসংখ্য প্রমাণ স্থানীয়রা সরাসরি উপস্থাপন করেছে”।