খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-রাঙ্গামাটি সাম্প্রদায়িক হামলার উপর জেএসএসের প্রতিবেদন প্রকাশ – হিল ভয়েস

হিল ভয়েস

হিল ভয়েস, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রাঙ্গামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ১৮, ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার উপর এক প্রতিবেদন করেছে।

উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত ১৮-১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়ি সদরে ও দীঘিনালায় এবং ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাঙ্গামাটি সদরে বিশেষ মহলের সহযোগিতায় সেটেলার বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও জুম্মদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ও ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত করেছে। উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪ জন জুম্ম নিহত হয়েছে (সেটেলার বাঙালি কর্তৃক দীঘিনালায় একজন জুম্ম, খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন জুম্ম এবং রাঙ্গামাটি সদরে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক একজন জুম্ম)। এছাড়া এই সাম্প্রদায়িক হামলায় শতাধিক জুম্ম আহত হয়েছে, অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত ও লুণ্ঠিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মো: মামুন (৪০) নামের এক সেটেলার বাঙালি খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর এলাকা থেকে গোল্ডি চাকমা (৪৫) নামে এক ব্যক্তির মোটরবাইকটি চুরি করে দ্রুত চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাস্তার পাশের একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে ওই চোর মো: মামুন বাইক থেকে পড়ে যায় এবং গুরুতর আহত হয়। তখনই আশেপাশের বাঙালি ও জুম্ম জনতা এসে “চোর, চোর” বলে মো: মামুনকে মারধর করে। মারধরের ফলে মামুন বেহুঁচ হয়ে যায়। পরে মামুনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

মো: মামুনের মৃত্যুর পরপরই সেটেলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে প্রচার করতে থাকে যে জুম্মরাই পরিকল্পিতভাবে মামুনকে মেরে ফেলেছে। এভাবে অপপ্রচার চালিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুরে হামলার চেষ্টা করে। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি এবং ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়।

দীঘিনালা হামলা ও অগ্নিসংযোগে জুম্মদের অন্তত ৫২টি দোকান ও বাড়ি এবং ২৪টি মোটরবাইক ও অটোরিক্সা ভস্মীভূত হয়। এ হামলায় কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসময় সেনাবাহিনীকে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এ হামলায় মাইনী ব্রিজ এলাকায় দীঘিনালা সদরের উদোলবাগানের হান্দারা চাকমার ছেলে ধন রঞ্জন চাকমা (৫২) নামে এক জুম্ম গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ২০ জুম্ম ছাত্র-যুবক আহত হয়। ছাত্রদের কারো কারো পেটে, হাটুতে, পায়ে গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়। তাদের মধ্যে স্বনির্ভর এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন নিহত হয়।

রাঙ্গামাটি হামলায় এক জুম্ম যুবক নিহত এবং প্রায় শতাধিক জুম্ম আহত হয়। তন্মধ্যে হাসপাতালে আহত ২৭ জন জুম্ম, রাজবন বিহার হাসপাতালে ২৫ ও ঘরে ঘরে ২৮ জন জুম্ম চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে গুরুতর জখম হওয়ায় ২ জনকে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। মৈত্রী বিহারে ভাঙচুর ও লুটপাটসহ জুম্মদের ২৪টি ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এতে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০শে সেপ্টেম্বর আইএসপিআরের দেয়া বিবৃতিতে “খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে” বলে বলা হয়েছে। আইএসপিআরের এই বক্তব্য অনেকটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগাম প্রচারণার সামিল, যা দাঙ্গাকারীদের দাঙ্গা সংঘটনে উস্কে দেয়ার ষড়যন্ত্র বলে বিবেচনা করা হয়। আইএসপিআরের মতো একটি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এভাবে কখনোই ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগাম প্রচারণা চালাতে পারে না। এটা অনেকটা মানুষের মনে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টির সামিল বলে গণ্য করা যেতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশেষ মহলের পৃষ্টপোষকতায় এবারের সাম্প্রদায়িক হামলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, জুম্মদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা, সর্বোপরি জুম্মদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করা।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য সমস্যার সমাধানের সূত্র নিহিত রয়েছে। জনসংহতি সমিতির নিম্নোক্ত তিনটি দাবি জানিয়েছে-

১। ১৯-২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২। নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের তরফ থেকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান করা।

৩। খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা, রাঙ্গামাটি সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *