Google Alert – সামরিক
ছবির উৎস, AFP via Getty Images
প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের একটি সংস্থা বলেছে, গাজার মানুষ দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত। গাজা উপত্যকার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ‘ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর’ মুখোমুখি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা।
খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নজরদারির দায়িত্ব পালন করা জাতিসংঘের সংস্থা দ্য ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি বলছে, গাজায় খাদ্য নিরাপত্তা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে।
গাজা শহর এবং এর আশেপাশের এলাকা দুর্ভিক্ষের কবলে বলে নিশ্চিত করেছে সংস্থাটি।
সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ দেইর আল-বালাহ এবং খান ইউনিস এলাকাও ‘বিপর্যয়কর পরিস্থিতির’ শিকার হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
আইপিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার দুর্ভিক্ষ ‘সম্পূর্ণরূপে মানুষের তৈরি এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, আইপিসি নিজে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে না যে দুর্ভিক্ষ হচ্ছে কি না, তবে তারা এমন বিশ্লেষণ দেয় যা সরকার, সংস্থা ও সংস্থাগুলোকে দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বিবৃতি বা ঘোষণা জারি করতে সহায়তা করে।
এদিকে, ইসরায়েল দাবি করেছে যে, আইপিসির প্রতিবেদন ‘মিথ্যা ও পক্ষপাতদুষ্ট’।
তারা বলেছে, তারা আইপিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনের ফলাফল, বিশেষ করে গাজা শহরে দুর্ভিক্ষের দাবি “দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান” করে।
ত্রাণ বিতরণের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলের সামরিক সংস্থা কো-অর্ডিনেশন অব গভর্নমেন্ট অ্যাকটিভিটিস বা কোগ্যাট বলেছে, আইপিসির “প্রতিবেদনটি মিথ্যা এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসের দেওয়া আংশিক, পক্ষপাতদুষ্ট ও ভাসাভাসা তথ্যের ওপর নির্ভর করে তৈরি”।
এটি আইপিসির মূল্যায়নকে একতরফা বলেও অভিহিত করেছে এবং দাবি করেছে সংস্থাটি “গাজায় গৃহীত ব্যাপক মানবিক প্রচেষ্টাকে” উপেক্ষা করছে।
ছবির উৎস, Reuters
এই দুর্ভিক্ষ ‘সম্পূর্ণরূপে মানুষের তৈরি’
আইপিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার দুর্ভিক্ষ ‘সম্পূর্ণরূপে মানুষের তৈরি’ এবং এটি ‘প্রতিহত করে অবস্থা পাল্টানো’ যেতে পারে।
“বিতর্ক এবং দ্বিধাগ্রস্ততার সময় পার হয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষ উপস্থিত। এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে,” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
আইপিসি হলো জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সাহায্য গোষ্ঠী ও বিভিন্ন দেশের সরকারের একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ। কোথাও দুর্ভিক্ষ ঘটছে কিনা তা নির্ধারণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংস্থাটিকে ব্যবহার করে।
তাদের ৫৯-পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে “কারও মনে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে একটি তাৎক্ষণিক, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন”।
“আর কোনো বিলম্ব হলে, এমনকি কয়েকদিন দেরি হলেও, দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুর হার সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে,” এটি যোগ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
আইপিসি নিশ্চিত করেছে যে গাজা এলাকা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মানদণ্ডে পঞ্চম পর্যায়ে রয়েছে।
এর অর্থ কী তা বোঝাতে আইপিসি তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে–– এই পর্যায়ে পৌঁছানোর মানে হলো “পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশলগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রয়োগ করার পরেও যখন পরিবারগুলোয় খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদার চরম অভাব থাকে; ক্ষুধা, মৃত্যু, দারিদ্র্য ও তীব্র অপুষ্টির মাত্রা স্পষ্ট হয়।”
ছবির উৎস, Anadolu via Getty Images
আইপিসির প্রতিবেদনে সংগঠনের দুর্ভিক্ষ পর্যালোচনা কমিটি বা এফআরসি’র উপসংহার রয়েছে।
এর সদস্যরা বলেছেন––গাজা উপত্যকার তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টি পরিস্থিতির বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করার জন্য পঞ্চমবারের মতো এই কমিটিকে ডাকা হয়। এর আগে কখনো এফআরসিকে একই সংকটে এতবার ফিরে যেতে হয়নি।
তারা বলছে, দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে দুরবস্থা কেবল টিকেই ছিল না বরং আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে।
গাজা উপত্যকাজুড়ে ব্যাপক মানবিক দুর্ভোগ বিদ্যমান এবং খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়া বেসামরিক নাগরিকদের হত্যাও অব্যাহত রয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেছে।
কমিটি বলছে, অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান হার থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষগুলো মারা যেতে শুরু করেছে।
“যে মাত্রার সংকট তৈরি হয়েছে এর জন্য একটি টেকসই, বিস্তৃত, বহু-ক্ষেত্রীয় প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন। এখনই সিদ্ধান্তমূলকভাবে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে বিপর্যয় এড়ানো কঠিন হবে,” বলেছে এফআরসি।
তারা জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের যুদ্ধবিরতি অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগেরও অনুরোধ করেছে।
জাতিসংঘের চার সংস্থার যৌথ বিবৃতি
জাতিসংঘের চারটি সংস্থা গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং ‘ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যু রোধে নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর’ আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বা ডব্লিউএফপি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচও এই যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গাজার হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে “দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে” ২৭১ জন মারা গেছে – যার মধ্যে ১১২ জন শিশুও রয়েছে।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বলছে, “যেকোনো মূল্যে দুর্ভিক্ষ বন্ধ করতে হবে”।
এছাড়া “গাজা শহরে তীব্র সামরিক আক্রমণের হুমকি এবং সংঘাতের যে কোনো বৃদ্ধি” বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে বলেও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
যৌথ বিবৃতিতে এই সংস্থাগুলো বলেছে যে গাজায় শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বিপর্যয়কর গতিতে ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং জুলাই মাসে ১২ হাজারেরও বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে বলে শনাক্ত করা হয়।
“এই শিশুদের মধ্যে প্রায় চারজনের মধ্যে একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছিল যার স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় ধরনের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে”- বলেছে সংস্থাগুলো।
ছবির উৎস, AFP via Getty Images
গাজায় দুর্ভিক্ষ ‘মানবতারই ব্যর্থতা’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আইপিসি’র প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, “যখন মনে হচ্ছে গাজার জীবন্ত নরক বর্ণনা করার জন্য আর কোনো শব্দ অবশিষ্ট নেই, ঠিক তখনই একটি নতুন শব্দ যোগ হয়েছে––দুর্ভিক্ষ।”
গুতেরেস বলেছেন যে এটি “কোনো রহস্য নয়”, বরং “একটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, একটি নৈতিক আর্জি এবং মানবতার ব্যর্থতা”।
“দুর্ভিক্ষ কেবল খাদ্য সম্পর্কে নয়; এটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার ইচ্ছাকৃত পতন,” গুতেরেস বলেন।
জাতিসংঘ প্রধান আরও বলেছেন যে ইসরায়েলের “আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে দ্ব্যর্থহীন বাধ্যবাধকতা রয়েছে – যার মধ্যে রয়েছে জনগণের খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব”।
“আমরা এই পরিস্থিতিকে দায়মুক্তি দিয়ে চলতে দিতে পারি না। আর কোনো অজুহাত নেই। পদক্ষেপ নেওয়ার সময় আগামীকাল নয়, এখনই। আমাদের অবিলম্বে একটি যুদ্ধবিরতি, সমস্ত জিম্মিদের অবিলম্বে মুক্তি এবং (গাজায়) পূর্ণ, নিরবচ্ছিন্ন মানবিক প্রবেশাধিকার প্রয়োজন”- তিনি যুক্ত করেন।