Google Alert – সামরিক
ছবির উৎস, Family handout
খাবারের খোঁজে বের হওয়া এক কিশোর, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের শিবিরে থাকা আট বছরের এক মেয়ে, আর কয়েক মাস অপুষ্টিতে ভোগা এক ব্যক্তি, এরা সবাই গত সপ্তাহে গাজায় মারা গেছেন।
বৃহস্পতিবার, হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে গত ২৪ ঘণ্টায় দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।
ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় “বড় আকারের দুর্ভিক্ষ” ছড়িয়ে পড়ছে বলে সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে।
ইসরায়েলি সরকারের এক মুখপাত্র এ দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, খাবারের ঘাটতির জন্য হামাস দায়ী এবং তারা ত্রাণ লুট করছে।
এদিকে, গাজার মানবিক পরিস্থিতি দ্রুত ভেঙে পড়ছে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গাজার অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে।
এ অবস্থায় বিবিসি গাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে যারা গত সপ্তাহে তাদের প্রিয়জন হারিয়েছেন।
ছবির উৎস, Getty Images
আবদুল্লাহ জেনদেইয়া, বয়স ১৯
১৯ বছরের আবদুল্লাহ ওমর জেনদেইয়া গত ২০শে জুলাই রোববার খাবারের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নিহত হন, জানিয়েছেন তার বোন নাদরিন।
তারা মধ্য গাজার আল সাবরা এলাকায় তাদের মায়ের একটি ভাঙাচোরা বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
“সেদিন সে খাবার আনার জন্য খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলো,” বললেন নাদরিন।
“আমি তাকে বলেছিলাম, ‘ঘরে সামান্য যে ডাল আছে, সেটাই খেয়ে নাও’। কিন্তু সে মানেনি।”
বিকেল ৪টায় আবদুল্লাহ বাড়ি থেকে বের হয় এবং পরিবারের জন্য কয়েক কেজি ময়দার বস্তা আনতে সে উত্তরের পথে পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটে।
মূলত সেখানেই সপ্তাহে একবার ত্রাণের ট্রাক আসে। তার সঙ্গে ছিল দুই ভাই এবং কিছু আত্মীয়।
রাত ১১টার দিকে এক ভাই মাহমুদ নাদরিনকে ফোন করে জানায়, তারা যখন ত্রাণের ট্রাকের কাছে অপেক্ষা করছিল, তখন হঠাৎ ইসরায়েলি সেনারা তাদের ওপর গুলি চালায়।
ওরা তখন ছিল নেতজারিম করিডর এলাকায় যা মূলত একটি সামরিক এলাকা, যেটি গাজার উত্তর ও দক্ষিণ অংশকে আলাদা করে রেখেছে।
মাহমুদ জানায়, আবদুল্লাহ মারা গেছে এবং তারা আহত হয়েছে।
“সে ছিল সবার আনন্দের উৎস, হৃদয়বান এবং একই সঙ্গে মজার মানুষ,” নাদরিন বলেন।
ছবির উৎস, Getty Images
কথা বলার সময় নাদরিন তাদের ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা মনে করেন যখন তিনি আর আবদুল্লাহ গাজার সমুদ্র সৈকতে বিকেলে হাঁটতে যেতেন।
“সে ফুটবল আর খেলাধুলা খুব পছন্দ করত।”
নাদরিন বলেন, আবদুল্লাহ স্থানীয় মুদি দোকানদারদের সঙ্গে কাজ করত, তাদের জন্য ফল ও সবজি বহন করত এবং তার স্বপ্ন ছিল “যুদ্ধ শেষ হলে নতুন ব্যবসা শুরু করার”।
এই ঘটনার বিষয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, তারা হামাসের সামরিক সক্ষমতা ভেঙে দেওয়ার জন্য কাজ করছে এবং বেসামরিক ক্ষতি কমাতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে।
তারা আরও বলেছে, “আপনি যদি ঘটনার জায়গার সঠিক ঠিকানা দিতে পারেন, তাহলে আমরা আমরা ভালো করে সাহায্য করতে পারব।”
হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা বলেছে, ওই দিন গাজাজুড়ে ইসরায়েলি গোলাগুলিতে মোট ৯৩ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও অনেকে, মূলত ত্রাণ বিতরণের পয়েন্টগুলোর কাছে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
উত্তর গাজার একটি নির্দিষ্ট ঘটনার কথা বলতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, সৈন্যরা ভিড়ের দিকে সতর্কতামূলক গুলি ছোড়ে “তাৎক্ষণিক হুমকি দূর করার জন্য”, তবে নিহতের সংখ্যা নিয়ে তারা দ্বিমত পোষণ করেছে।
ছবির উৎস, Family handout
সেলা মাহমুদ, বয়স ৮
সেলা মাহমুদের বয়স আট বছর। মঙ্গলবার ভোরে মেয়েটি নিহত হয় বলে জানান তার মা আলা শেহাদা।
মা, বড় দুই বোন (যাদের বয়স ১৪ ও ১৩ বছর) এবং এক ছোট ভাইয়ের (বয়স ছয়) সঙ্গে উত্তর গাজার আল-শাতি এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের জন্য একটি শরণার্থী শিবিরে থাকতো ছোট্ট এই মেয়েটি।
সোমবার সন্ধ্যায় আলা বলেন, বাকি তিন সন্তানকে রেখে তিনি ও তার ১৩ বছরের মেয়ে খাবারের জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরের জিকিম সাহায্যকেন্দ্রের দিকে রওনা হয়েছিলেন।
কিন্তু রাত প্রায় পৌনে ২টায় তিনি দূরে গোলাগুলির শব্দ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যান। তার মনে হতে থাকে খারাপ কিছু ঘটবে।
“আমার মনে একটা ঘা লাগে। মা হিসেবে আমার মনটা বলতে থাকে, আমার সন্তানেরাও এই হামলার শিকার হবে।”
অপরিচিত কিছু মানুষের সাহায্যে আলা ক্যাম্পে থাকা তার বড় মেয়েকে ফোন করতে সক্ষম হন তিনি, যে নিশ্চিত করে জানায় যে তারা হামলার শিকার হয়েছে এবং সেলা মারা গেছে।
“আমার হৃদয় ভেঙে গেছে,” বলেন আলা।
বাকি দুই শিশু বেঁচে আছে, কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে এবং তারা গাজার আল-শিফা হাসপাতালে আছে, তিনি জানান।
আলা বলেন, সেলা শেষ কয়েক দিনে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিল এবং সে সমুদ্রের ধারে সময় কাটাতে খুব ভালোবাসত।
তার মায়ের কাছে শেষ কথা ছিল, “পেট না ভরে যাওয়া পর্যন্ত পুরো এক বাটি ডাল খেতে চাই আমি”।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, ঘটনার সঠিক অবস্থান না জানাতে পারলে তারা এই ঘটনায় মন্তব্য করতে পারবে না।
তারা দাবি করেছে, “বেসামরিক ক্ষতি কমানোর জন্য সম্ভাব্য সব সতর্কতা নেওয়া হয়।”
ছবির উৎস, Family handout
আহমেদ আলহাসানত, বয়স ৪১
৪১ বছর বয়সী আহমেদ আলহাসানত গত ২২শে জুলাই মঙ্গলবার মারা গেছেন।
তার ভাই ইয়াহিয়া আলহাসানত বলেন, “অপুষ্টি তাকে মেরে ফেলেছে – দিন দিন সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল।”
গত মার্চ মাসে ইসরায়েল গাজায় সাহায্য প্রবেশে অবরোধ দেওয়ার পর থেকেই তার ভাই অসুস্থ হতে শুরু করে বলে জানান ইয়াহিয়া।
মে মাস থেকে ইসরায়েল কিছু সাহায্য গাজায় প্রবেশ করতে দিয়েছে, কিন্তু সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে- এটা মোটেও যথেষ্ট নয়।
আহমেদ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন এবং তিন মাস ধরে তিনি পর্যাপ্ত খাবার বা পানীয় পাননি।
ইয়াহিয়া বলেন, তিনি শুধু সামান্য রুটি আর মাঝে মাঝে ক্যান বা কৌটার খাবারের ওপর নির্ভর করতেন। ফলে তার ওজন ৮০ কেজি থেকে কমতে কমতে ৩৫ কেজি হয়ে যায় এবং তার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটে।
“তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, কখনো কখনো আমরা বুঝতেই পারতাম না,” ইয়াহিয়া বলেন।
আহমেদের চাচাতো ভাই রিফাত আলহাসানত বলেন, তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ডাক্তাররা বলেছিল “তার ওষুধ না, খাবার দরকার”।
“তাই আমরা তাকে আবার বাড়ি নিয়ে আসি।”
ইয়াহিয়া বলেন, আহমেদ, যিনি আগে টেলিভিশনের স্যাটেলাইট ডিশ বসানোর কাজ করতেন এবং ফুটবলের ভক্ত ছিলেন, “গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ শহরের নিজের বাড়িতে শান্তিপূর্ণভাবে মারা গেছেন”।
“তার ব্যক্তিত্ব ছিল শক্তিশালী এবং তিনি ছিলেন সবচেয়ে দয়ালু মানুষদের একজন,” ইয়াহিয়া যুক্ত করেন।
ছবির উৎস, Family handout
মোহাম্মদ কুল্লাব, বয়স ২৯
মোহাম্মদ কুল্লাব। ২৯ বছর বয়সী এই তরুণ গত ২২শে জুলাই এক বিমান হামলায় নিহত হন, জানান তার ভগ্নিপতি আমার রাগাইদা।
মি. রাগাইদা বলেন, পশ্চিম খান ইউনিসের আল-কাদিসিয়া এলাকায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য তৈরি একটি ক্যাম্প এলাকায় বিকেল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে যখন বিমান হামলা হয়, তখন নিজের তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কুল্লাব।
“সে তখন তাঁবুতে একা ছিল। আমরা শুনেছিলাম, বোমা হামলার কয়েক ঘণ্টা পর কিছু মানুষ তার বোনকে ফোন করে তার মৃত্যুর খবর জানায়।”
আমার আরও বলেন, কুল্লাবের মৃত্যুর আগের দিন তার সঙ্গে কথা হয়েছিলো। ত্রাণের খোঁজে বের হলে তাদের হঠাৎ দেখা হয়।
“সে আমাকে বলেছিল- ‘একা যেও না, আমি চেষ্টা করব তোমার জন্য কিছু ময়দা আনতে’। পরের দিনই সে মারা গেলো।”
আমার বলেন, কুল্লাব তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল একটি বোন এবং একটি ছোট ভাই রেখে গেছে।
“কুল্লাব ছিল ভদ্র, প্রাণবন্ত একজন তরুণ। সে কোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নিজেকে জড়াত না এবং আশেপাশের সবাই তাকে ভালোবাসত,” তিনি বলেন।
এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিএফ আবদুল্লাহর জন্য দেওয়া বক্তব্যের মতোই একই রকম জবাব দেয়, যেখানে বলা হয় তারা “নাগরিক ক্ষতি কমাতে যথাযথ সতর্কতা নেয়” এবং তারা বলেছে, ঘটনাস্থলের অবস্থান জানা না গেলে এ বিষয়ে আর কিছু বলা সম্ভব নয়।
ছবির উৎস, Family handout
মোহানাদ কাফিনা, বয়স ২২
রোববার, ২০শে জুলাই ভোর। গাজা সিটির শেখ রাদওয়ান এলাকার বাসিন্দা মোহানাদ কাফিনা তার চাচা নাসিমের সঙ্গে খাবারের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু মোহানাদ আর ফিরে আসেননি।
মোহানাদ সকালে নাসিমকে বলেছিলেন, “তার খুব মিষ্টি চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
কথা বলার সময় তারা দেখতে পান, একটি খালি ত্রাণবাহী ট্রাক পুনরায় মালামাল আনতে যাচ্ছে।
তাই তারা ঠিক করেন, জিকিমের ত্রাণকেন্দ্রে গিয়ে অপেক্ষা করবেন ট্রাকটি ফেরার জন্য, যাতে ট্রাক ফিরে এলে তারা কিছু খাবার পান।
কিন্তু নাসিম জানান, তারা যখন পৌঁছান তখন সেখানে ভিড় ছিল এবং ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালাচ্ছিল। ওই সময় তারা দুজন আলাদা হয়ে যান।
নাসিম বাসায় ফিরে ভেবেছিলেন মোহানাদ সেখানে থাকবেন, কিন্তু তিনি ছিলেন না।
তারা স্থানীয় হাসপাতালে খুঁজতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত শেখ রাদওয়ানের একটি ক্লিনিকে আরও অনেক অজ্ঞাত লাশের সঙ্গে মোহানাদের মরদেহ পাওয়া যায়।
নাসিম জানান, তার ভাগ্নের মাথায় গুলি করা হয়েছিল।
“সে একা মারা গেছে, ক্ষুধার্ত আর সাহায্যের আশায় মরিয়া হয়ে, যেমন এখন সব গাজাবাসী আছে,” নাসিম বলেন।
তিনি জানান, মোহানাদ তার কাছে ছেলের মতো ছিল। তারা “সব জায়গায় একসঙ্গে যেতেন, কখনো কোনো কিছু গোপন রাখতেন না”।
“মোহানাদের স্মৃতি পৃথিবীর সব কলম দিয়ে লিখেও শেষ করা যাবে না। এমন একটি দিনও যায়নি যেদিন আমাদের কোনো স্মৃতি তৈরি হয়নি। আমি ভেঙে পড়েছি।”
নাসিম জানান, মোহনাদ প্রযুক্তি, সফটওয়্যার আর ইন্টারনেট নিয়ে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন এবং একদিন ভালো জীবন পাওয়ার জন্য বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
আইডিএফ এই ঘটনার বিষয়ে বলেছে, ঘটনাস্থলের সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় ঘটেছে তা না পাওয়া পর্যন্ত তারা মন্তব্য করতে পারবে না।
তাদের দাবি, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে এবং বেসামরিক ক্ষতি কমাতে “যথাসম্ভব পদক্ষেপ” নেয়।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে আরও কাজ করেছেন আমিরা দাক্রৌরি।