গাদ্দাফির পরিণতি ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

Google Alert – সশস্ত্র

গাদ্দাফির পরিণতি ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি: সময়ের আলো

বাস্তবতা অনেকেই তখন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক একমত যে, গাদ্দাফির অপরাধ কেবলই তার স্বৈরশাসন নয়, বরং তার অপরাধ ছিল ডলারের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো। আজ লিবিয়ায় গণতন্ত্র নেই, নেই স্থিতিশীলতা কিংবা উন্নয়ন। আছে বহু পক্ষের সংঘর্ষ, বিদেশি হস্তক্ষেপ, মানব পাচার, সশস্ত্র গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য। যে মানবাধিকারের কথা বলে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে যারা জনগণকে মুক্ত করতে এসেছিল তারাই লিবিয়ার সাধারণ জনগণের ওপর ২৬ হাজার বোমা ফেলেছে। সমগ্র লিবিয়াকে পরিণত করেছে একটি ধ্বংসস্তূপে।

২০১১ সালের ২০ অক্টোবর, লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত হন। এ ঘটনার মাত্র দুদিন আগে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন লিবিয়ায় একটি অঘোষিত সংক্ষিপ্ত সফরে গিয়েছিলেন, বিপ্লবীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে। গাদ্দাফির মৃত্যুর পর হিলারি সিবিএস নিউজকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, We came, We saw, He died জুলিয়াস সিজারের বিখ্যাত উক্তি ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ এর একটি বিকৃত প্রতিধ্বনি। এই সাধারণ একটি বাক্যে লিবিয়ার ঘটনার পেছনের জটিলতা এবং পশ্চিমা শক্তির ভূমিকা স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

গাদ্দাফির মৃত্যু নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। লিবিয়ার বিপ্লবীদেরই একাংশ অভিযোগ করে, ফরাসি গোয়েন্দা এজেন্টই তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এমনকি বিপ্লবীদের কোয়ালিশনের সাবেক প্রেসিডেন্টও এই দাবিকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু গাদ্দাফির পতনের আসল কারণ কী ছিল? মানবাধিকার রক্ষার উচ্চারিত স্লোগান, না কি অন্য কোনো গভীর লক্ষ্য? আজ, এক দশক পর, বাংলাদেশও এক রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার প্রশ্নে পশ্চিমাদের টেনে আনতে চাইছে। ঠিক এই প্রেক্ষাপটে ফিরে দেখা দরকার, গাদ্দাফির পতনের পেছনের প্রকৃত চালিকাশক্তি ছিল?

প্রচলিত উত্তর হলো-তিনি ছিলেন এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক, যিনি নিজের জনগণের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছেন। তার শেষ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বেইত বেইত, দার দার, জাঙ্গা জাঙ্গা’ (বাড়ি বাড়ি, ঘর ঘর, অলিগলি) যেখানে তার বিরোধীদের হত্যা করা হবে। এই ভীতিকর চিত্র তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে পশ্চিমা মিডিয়াকে সাহায্য করেছিল।

ন্যাটো, বিশেষ করে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র, লিবিয়ার নিরীহ জনগণের জীবন রক্ষার নামে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। অফিসিয়াল ন্যারেটিভ বলছে, তারা এক উন্মাদ, নিপীড়ক, খুনি শাসকের হাত থেকে বিশ্বকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু আসলেই কি তাই?

যদি প্রশ্ন করা হয়, নব্বই দশকে ইরাকে অবরোধে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী? লেবাননকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল কারা? ফিলিস্তিনে দশকের পর দশক ধরে গণহত্যা চালাচ্ছে কারা? উত্তর একটাই-পশ্চিমা শক্তি। এ প্রশ্ন স্বভাবতই উঠে আসে, যেখানে পশ্চিমা শক্তি বহু দেশে বারবার হস্তক্ষেপ করেছে তথাকথিত মানবাধিকারের নামে, সেখানে লিবিয়ায় তাদের আগ্রহের প্রকৃত উৎস কি কেবল মানবিক বিবেচনা ছিল? ১৯৯৬ সালে গাদ্দাফি একটি বিপ্লবী ধারণা নিয়ে আসেন, স্বর্ণদিনার। 

২০০০ সালে তিনি এই পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেন এবং ২০১১ সালে মৃত্যুর আগে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। এই স্বর্ণদিনার ছিল আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য একটি স্বাধীন মুদ্রাব্যবস্থা, যেখানে তেল বা অন্য কোনো পণ্য বিক্রি করে ডলার বা ইউরোর বদলে স্বর্ণ গ্রহণ করা হবে।

এ সিদ্ধান্ত পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ, বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি কাজ করে কাগজের মুদ্রার ওপর ভিত্তি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল নেয়, বিনিময়ে দেয় ডলার, যা আসলে শুধু কাগজ। কিন্তু তেল একটি সীমিত ও অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এই অসম বিনিময়ে পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বের সম্পদ লুটে নিচ্ছে, আর বিক্রেতা দেশগুলো পাচ্ছে শুধু কাগজ।

গাদ্দাফি চেয়েছিলেন, আফ্রিকার সম্পদ আফ্রিকাতেই থাকুক। যদি কেউ আফ্রিকার তেল বা খনিজ কিনতে চায়, তা হলে তাকে স্বর্ণ দিতে হবে, কাগজের টাকা নয়। এই ধারণা পশ্চিমাদের জন্য ভয়ংকর ছিল। কারণ, এর মানে হলো- ডলারের আধিপত্য ধসে পড়বে, ফ্রান্সের সিএফএ ফ্রাঙ্ক অকার্যকর হয়ে যাবে এবং আফ্রিকার সম্পদ আর পশ্চিমে পাচার হবে না। এ সিদ্ধান্তের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট : আলজেরিয়া, নাইজার, নাইজেরিয়া, চাদ, সুদানসহ প্রায় ১৪টি আফ্রিকান দেশ গাদ্দাফির পরিকল্পনায় সায় দিয়েছিল।

২০০০ সালে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনও ডলারের বদলে ইউরোতে তেল বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার পরিণতি কী হয়েছিল, তা সবার জানা। গাদ্দাফিও একই পথে হাঁটছিলেন। এই পরিকল্পনা শুধু আমেরিকা নয়, ফ্রান্সের জন্যও বড় হুমকি ছিল। কারণ, আফ্রিকার অনেক দেশ ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রিত সিএফএ ফ্রাঙ্ক মুদ্রা ব্যবহার করে। স্বর্ণদিনার চালু হলে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত এবং আফ্রিকার অর্থনীতি ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত।

গাদ্দাফির স্বপ্ন ছিল আফ্রিকার সম্পদ আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এই স্বপ্নই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমা শক্তির জন্য তিনি ছিলেন একজন ‘বিপজ্জনক পাগল’, যিনি তাদের অর্থনৈতিক আধিপত্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।

২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের ফাঁস হওয়া ই-মেইলগুলো তাদের এই আকাক্সক্ষাকে আরও স্পষ্ট করে। ২০১১ সালের এপ্রিলে তার এক সহকর্মী লিবিয়ার ১৪৪ টন স্বর্ণের গতিবিধি নিয়ে তথ্য পাঠান। এই বিপুল স্বর্ণ ভান্ডার গাদ্দাফির প্রস্তাবিত আফ্রিকান সেন্ট্রাল ব্যাংকের জন্য যথেষ্ট ছিল। আদতে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র এই স্বর্ণের ওপর নজর রাখছিল, মানবাধিকারের ওপর নয়।

এই বাস্তবতা অনেকেই তখন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক একমত যে, গাদ্দাফির অপরাধ কেবলই তার স্বৈরশাসন নয়, বরং তার অপরাধ ছিল ডলারের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো। আজ লিবিয়ায় গণতন্ত্র নেই, নেই স্থিতিশীলতা কিংবা উন্নয়ন। আছে বহু পক্ষের সংঘর্ষ, বিদেশি হস্তক্ষেপ, মানব পাচার, সশস্ত্র গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য। যে মানবাধিকারের কথা বলে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে যারা জনগণকে মুক্ত করতে এসেছিল তারাই লিবিয়ার সাধারণ জনগণের ওপর ২৬ হাজার বোমা ফেলেছে। সমগ্র লিবিয়াকে পরিণত করেছে একটি ধ্বংসস্তূপে।

গাদ্দাফি নিঃসন্দেহে নিপীড়ক ছিলেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে মানবাধিকারের বুলি শোনা গিয়েছিল, সেটি আদৌ কি পশ্চিমা নীতির মূল চিন্তা ছিল? নাকি এটি ছিল আফ্রিকার ভূখণ্ডে এক অচিন্তনীয় মুদ্রা বিপ্লব ঠেকানোর পূর্বপরিকল্পিত এক অভিযান? লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী বিভীষিকাময় বাস্তবতার মাঝে দাঁড়িয়ে আজ এই প্রশ্নগুলোই সবার সামনে আসছে।

লিবিয়ার পতন সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি বড় শিক্ষা। বিশ্বরাজনীতিতে নৈতিকতা বা মানবাধিকার নয়, কাজ করে স্বার্থ, শক্তি ও আধিপত্যবাদ। আফ্রিকার সোনার ওপর যেমন ছিল পশ্চিমাদের নজর, তেমনি বঙ্গোপসাগরের গভীরে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত অবস্থানও আজ বাংলাদেশের ভূরাজনীতিকে স্পর্শ করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে আন্দামান হয়ে বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বার এখন শুধুই সমুদ্রসীমা নয়, বরং একটি কৌশলগত সংঘর্ষ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকা। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কৌশল, ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের আকাক্সক্ষা এবং রাশিয়া-ইইউর অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন বহুমাত্রিক কৌশলগত চাপে ও সুযোগের মুখোমুখি। এমন বাস্তবতায় দেশের স্বার্থরক্ষায় কোনো ভ্রান্ত কূটনীতি বা পরাধীন নীতি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

গাদ্দাফি ‘স্বর্ণদিনার’ দিয়ে পশ্চিমা মুদ্রার বিরুদ্ধে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, তেমন চ্যালেঞ্জ হয়তো বাংলাদেশ তুলবে না। কিন্তু আমরা যদি নিজের ভূখণ্ড, সম্পদ ও কৌশলগত অবস্থান সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারি, তবে আমাদেরও একদিন আফ্রিকার ভাগ্যবরণ করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আমাদের এই অঞ্চলেও মানবাধিকার, গণতন্ত্র, কিংবা উন্নয়ন-এই শব্দগুলোর আড়ালে বিভিন্ন পরাশক্তি স্বাধীনতা ও সম্পদের ওপর হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করতে চাইছে।

এই শব্দগুলো শুনতে নিরীহ মনে হলেও, বাস্তবে এটি একটি রাজনৈতিক পরিদর্শনমূলক মিশন। সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সাধারণত এ ধরনের চমকপ্রদ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় একটি দেশে ভবিষ্যৎ হস্তক্ষেপের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে। আফগানিস্তান, সুদান, সিরিয়া, মালি কিংবা ইরাক-সবক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপের আগে ‘মানবাধিকার’ নিয়ে এমন মনিটরিং মেকানিজমই ব্যবহৃত হয়েছে।

আজ বাংলাদেশে যারা পশ্চিমা মানবাধিকার ভাষ্যকে মুক্তির একমাত্র পথ ভাবছে, তারা যদি গাদ্দাফির ঘটনার গভীরতা না বোঝেন, তবে ভবিষ্যৎ বিপদের পূর্বাভাসও হয়তো বুঝতে পারবেন না।

এমএইচ

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *