Google Alert – ইউনূস
গত আগস্টের শেষের দিকে রাজধানী ঢাকা গুজবের শহরে পরিণত হয়েছিল। গুজব কখন ছড়ায়? গুজব ছড়াতে পারে, যদি তথ্যের অবাধ প্রবাহ বন্ধ করা হয়। সত্য ঘটনা জানতে না পেরে নাগরিকদের মনে নানা ধরনের সন্দেহ ডালাপালা গজাতে থাকে। অনেকে যারা একটি সন্দেহ বা অজানা ঘটনাকে নিজের মতো করে প্রচার করতে চান, তাতে করেই গুজবের ডালপালা গজায়। মোবাইলফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন গুজব ছড়ানোর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়াকে আইনকানুনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-সংক্রান্ত আইনকানুন থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এতটাই প্রসারিত এবং বেশ কিছুটা অস্বচ্ছতার মধ্যে থাকে বলে একে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামল ছিল স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী দোষে দুষ্ট। সাধারণ মানুষের জীবন ও কর্মকাণ্ডের ওপর ওই সরকার যেভাবে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল তাতে সবচেয়ে ন্যায্য কথাটি বলা ও প্রচার করা ছিল দুঃসাধ্য। অনেককেই আইসিটি অ্যাক্টে কারাবরণ করতে হয়েছে। কেউ কেউ গুমের শিকার হয়েছে। সারা দেশে এমন এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। যার ফলে সত্য কথা উচ্চারণ তো দূরের কথা, এমন কথা মনের গভীরে রাখতেও সবাই আতঙ্ক বোধ করতেন! সেসময় এ কারণে গুজব খুব একটা ডালপালা মেলতে পারেনি। তারপরও হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি ও দুষ্কর্ম নিয়ে বিচিত্র রকম তথ্য জনারণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এক কান ভর করে অন্য কানে। তবে এ ধরনের তথ্যপ্রবাহ শেখ হাসিনার বজ্র আঁটুনির সরকারকে হেলাতে পারেনি। এ সরকারের ভয়াবহ শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে সাড়ে ১৫ বছর লেগেছে। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও স্থায়ী রূপ দিতে একটি শক্তিশালী নেক্সাস গড়ে তুলেছিলেন। এ নেক্সাসই ছিল বিত্তশালী, লুটেরা, অলিগার্ক, অনুগত আমলাতন্ত্র, অনুগত পুলিশ বাহিনী, অনুগত বুদ্ধিজীবী ও সামরিক বাহিনীর একটি অংশ (হয়তো ক্ষুদ্র অংশ)। এ রকম ক্ষমতা কাঠামোকে টলানো খুব কঠিন। গুজবের অস্ত্র এমন কাঠামোকে ভেদে করে যেতে পারে না। শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছিলেন। সেই ব্লুপ্রিন্ট কল্পনাতেই থেকে গেছে, কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কারণ তার আগেই ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার বিশাল অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালিয়ে তার প্রভুর দেশ ভারতে যেতে হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনক্ষমতার একটি বড় স্তম্ভ ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদ। যে নেক্সাসের কথা আমরা বলেছি, সেই নেক্সাসে ভারতও ছিল অন্যতম খুঁটি। শেখ হাসিনা টাইপের ফ্যাসিবাদী শাসনে গুজব ছড়িয়ে কিছু অর্জন সম্ভব ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসন তখনই উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে যখন, মানুষ একটি ভাবাদর্শে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। সেই ভাবাদর্শ পরিণত হয়েছিল বিশাল এক বস্তুগত শক্তিতে। কার্ল মার্কস্ বলেছিলেন, When ideas grip the minds of the masses, it can become a great material force. বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানে জনগণ মার্কসের কথিত great materials force-এ পরিণত হয়েছিল।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর কাছ থেকে এ সরকার ন্যায্যতা অর্জন করে। এটি সাধারণ নির্বাচিত সরকার নয় বলে এ সরকারের পক্ষে ন্যায্য বিষয়েও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। প্রথমত এ সরকার শেখ হাসিনা সরকারের মতো নিপীড়নমূলক হতে পারে না। তার পক্ষে নিপীড়ন চালানো প্রায় অসম্ভব। এর একটি বড় কারণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশবাহিনী পালিয়ে যায়। এ বাহিনীর একটি অংশ শেখ হাসিনা সরকারের কোলাবোরেটর ছিল। এ পুলিশবাহিনীকে আজ অবধি পরিপূর্ণভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পুলিশবাহিনী এখনো নৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। এরা প্রয়োজনের সময় সক্রিয় হয়ে উঠতে চায় না। সমস্যা দেখা দিলে এরা টালবাহানা করে। তারা ফ্যাসিবাদী অতীত ও বর্তমানের মুক্ত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারছে না। সে কারণে মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে তারা দোদুল্যমানতায় ভোগে। এ পুলিশবাহিনী দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা দুরূহ। এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। তবে এ ব্যবস্থা স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। গণতান্ত্রিকব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি সুঠাম পুলিশবাহিনী আজ সময়ের দাবি।
গত কয়েকদিনে আইনশৃঙ্খলা পরিবেশ মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়ে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্ররা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে পেশাগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আন্দোলনে নামে। তাদের দৃষ্টিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা ইঞ্জিনিয়ার নয়। তারা ইঞ্জিনিয়ার পদবি দাবি করতে পারে না। এমনই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা আন্দোলনে নামে এবং শাহবাগে জড়ো হয়। তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসস্থান যমুনার দিকে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। এই প্রথম দেখলাম, পুলিশ বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের ওপর গত ১ বছরের মধ্যে চড়াও হতে। পুলিশ লাঠিচার্জ করল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ল এবং জলকামান দিয়ে রঙিন পানি ছিটাল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্ররা অনেকেই আহত হলো। বুয়েটের উপাচার্য পুলিশ অ্যাকশনের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করলেন। নিন্দা জ্ঞাপন করলেন আরও অনেকে। সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে ছিল, যার দায়িত্ব হবে বিষয়টির সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান এবং ছাত্রদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। সড়ক ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান এ কমিটির প্রধান। তিনি রেল ভবনে বুয়েটের ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে একদফা আলোচনা করেছেন। কিন্তু কোনো সন্তোষজনক সমাধানের খবর আমরা পাইনি। আসলে মূল সমস্যা হলো বেকারত্ব। বুয়েটের মতো একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরও ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকে চাকরি পায় না, এমনকি তাদের যোগ্যতার সঙ্গে সমপর্যায়ের নয়, এমন চাকরি গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হয়।
বুয়েটের ছাত্রদের আন্দোলনের পর ভয়াবহ ঘটনা ঘটল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতেও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সময়ে সময়ে সংঘাত হতো। কিন্তু এবারের সংঘাত অতীতের সংঘাতগুলোর তুলনায় ব্যাপক এবং সংঘাতের ফলে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে ২ জনের অবস্থা গুরুতর। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটিও মারাত্মক। সেখানে ছাত্ররা ডিগ্রিসংক্রান্ত একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করে। এ বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে।
গত কয়েক দিনে বেশকিছু গোলযোগের ঘটনায় জনমনে শঙ্কার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের মানুষ যখন দেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে, তখন তারা তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপের অশানিসংকেত দেখতে পায়। তারা ভাবতে শুরু করে, বিদ্যমান সরকার যেহেতু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, তখন সেনাশাসন বা জরুরি অবস্থা জারি করা হবে বলে আশঙ্কা করতে শুরু করে। এর পাশাপাশি যখন শোনা গেল, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান প্রধান বিচারপতি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন, তখন গুজবের বন্যা বয়ে গেল। এই বুঝি সেনাশাসন আসছে, এই বুঝি জরুরি অবস্থা আসছে! কিন্তু যখন আইএসপিআর প্রেস নোটের মাধ্যমে অবগত করল যে, সেনাপ্রধান তার সাম্প্রতিক চীন সফরের বিষয়াদি রাষ্ট্রপাতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছেন মাত্র, অন্যকিছু নয়। সেনাপ্রধান প্রধান উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করে যাবে। তবে সেনাপ্রধান প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কিনা সে ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। অবশ্য, দেশের এখন যে পরিস্থিতি তাতে সেনাশাসন কিংবা জরুরি অবস্থার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে দূরত্ব থাকলেও শেষ পর্যন্ত দেশ নির্বাচনমুখী হবে এবং নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস কেটে যাবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, এ পর্যন্ত দেশে চৌদ্দশ সড়ক অবস্থানের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা অংশত ক্ষমতা হারানোদের উসকানি এবং অংশত ন্যায্য দাবিদাওয়া থেকে উৎসারিত। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান অতীতের অভ্যুত্থানগুলোর তুলনায় অনেক বেশি গভীর ছিল। এ অভ্যুত্থানে অল্পসময়ের মধ্যে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এবং বহু মানুষ আহত হয়েছে। এমন অভ্যুত্থানের পর সামাজিক সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সময়ের প্রয়োজন। অনেক দেশে দেখা গেছে, এর জন্য ৫ বছর লেগে গেছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে তুলনায় খুব অসন্তোষজনক নয়-এটাই ভরসার কথা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ