গোপালগঞ্জে সেদিন কারা গুলি চালিয়েছে? গ্রেপ্তার হচ্ছে কারা?

Google Alert – সেনাবাহিনী

সেদিন গুলি করেছে কে? গোপালগঞ্জের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে একবাক্যেই তারা বলছেন, ‘সরকারি বাহিনী’, ‘প্রশাসন’। গোপালগঞ্জ শহরের রিকশাচালক, চায়ের দোকানি, ফল বিক্রেতা, রেস্তোঁরা কর্মী–যার কাছেই জিজ্ঞেস করা হোক, জবাবটা যেন সবারই জানা।


তবে পুলিশ এ ঘটনায় দায়ের করা চারটি হত্যা মামলার এজাহারে লিখেছে, পুলিশ ও সেনা সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে হামলাকারী আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই।


সেনাবাহিনীর তরফে অবশ্য তাদের সদস্যদের ওপর হামলার কথা বলা হয়নি।


স্থানীয়রা বলছেন, ওইদিন এনসিপির সমাবেশে হামলাকারী আওয়ামী লীগ সমর্থকরা দুইশর বেশি ককটেল ফাটিয়েছে। তবে তাদের হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র তারা দেখেননি।


এক সপ্তাহ আগে ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জ শহরে এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত তৈরি হয়েছিল, তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। সন্তানহারা মায়েদের আহাজারি এখনো থামেনি। গ্রেপ্তারের ভয়ও কাটেনি।


হতাহত হওয়া দরিদ্র পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। গুলিতে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা হত্যা মামলায় আবার আসামি করা হয়েছে কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা মানুষকে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারদের বেশিরভাগই নিরীহ বলে ভাষ্য স্থানীয়দের।


তবে জেলার এসপি মিজানুর রহমান বলছেন, এখানে কোনো ‘গণগ্রেপ্তার’ হচ্ছে না। ভিডিও দেখেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।


ঘটনার দিন গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিতে দফায় দফায় হামলার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে পুরো শহরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।


সংঘর্ষের মধ্যে চারজন নিহত এবং অন্তত নয়জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়।

ময়নাতদন্তের জন্য আদালতের নির্দেশে সোমবার কবর থেকে তোলা হয় লাশ।


নিহতরা হলেন, শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৭), কোটালীপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৭), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩০), সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (১৭) এবং সদরের থানাপাড়া এলাকার মৃত আকবর মুন্সীর ছেলে রমজান মুন্সী (৩২)।


চারজনকে হত্যাসহ পুলিশের গাড়ি পোড়ানো, কারাগারে হামলার মত কয়েকটি ঘটনায় মোট ১০টি মামলা করা হয়েছে পুলিশ ও কারাপ্রশাসনের তরফ থেকে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯ হাজার ৮৪৬ জনকে। ৩১৭ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।


ঘটনার দিনই সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়া চারজনের দাফন ও সৎকার হাওয়া নিয়ে আলোচনার মধ্যে কবর থেকে লাশ তোলার আদেশ দেয় আদালত। এরপর সোমবার তিনজনের লাশ কবর থেকে তোলা হয়।


গুলি করল কে?


রমজান কাজী হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার এসআই মুরাদ হোসেন সুরতহাল প্রতিবেদনে লিখেছেন, নিহতের ডান কাঁধে গুলির চিহ্ন রয়েছে।


আর ইমন তালুকদার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার এসআই শহিদুল ইসলাম নিহতের বাম উরুতে গুলির চিহ্ন থাকার কথা সুরতহালে লিখেছেন।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া অটোরিকশা চালক রমজান মুন্সীর সুরতহাল করেছেন শাহবাগ থানার এসআই আশরাফ আলী। ওই প্রতিবেদনে নিহতের ডান হাতের কনুইয়ের ওপরে ও নিচে দুটি গুলির ছিদ্র এবং পিঠের ডানপাশে একটি গুলির ছিদ্র থাকার কথা বলা হয়েছে।


প্রতিবেদনে এসআই আশরাফ লিখেছেন, নিহত রমজান ব্যাটারি চালিত রিকশার চালক। ১৬ জুলাই বেলা আড়াইটার দিকে গোপালগঞ্জ সদরের চৌরঙ্গী সিনেমার উত্তরপাশের রাস্তায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এরপর প্রথমে তাকে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এনসিপির সমাবেশের পরপরই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহর।


পুলিশ মামলায় লিখেছে, হামলাকারীরা গুলি ছুড়েছে। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তারা এপিসি থেকে গুলি ছুড়তে দেখেছেন। গুলি ছুড়েছে পুলিশও।


তিনটি হত্যা মামলায় বলা হয়েছে, সোহাগ ও রফিকুল ইসলাম নামে দুই কনস্টেবল শটগান থেকে ১০ রাউন্ড করে কার্তুজ ফাঁকা ফায়ার করেছেন।


তবে সুরতহাল প্রতিবেদনে ক্ষতের যে বর্ণনা এসেছে, তা তুলে ধরে জেলা পুলিশের একজন এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, “এইটা ক্লিয়ার যে তারা গুলিবিদ্ধ (লাইভ বুলেট) হয়ে মারা গেছেন, ছররা গুলিতে না। ছররা গুলি লাগলে ছোট ছোট অনেকগুলো বসন্তের দাগের মতো আঘাতের চিহ্ন হয়। এদের শরীরে গুলির বড় ছিদ্র ছিল।”


পুলিশ যে চারটি হত্যা মামলা করেছে, সেগুলোর ভাষ্য মোটামুটি একই রকম।


দীপ্ত সাহাকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে মামলাটি করেছেন গোপালগঞ্জ সদর থানার এসআই শামীম হোসেন।


এজাহারে বলা হয়েছে, ওইদিন দুপুর সোয়া ২টায় এনসিপির নেতারা সমাবেশ শেষে গাড়িতে করে মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পরই তাদের উপর ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের অজ্ঞাতনামা সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার ‘দুষ্কৃতকারী’ আগ্নেয়াস্ত্রসহ রামদা, টেঁটা, ঢাল-সড়কি ও বর্শার মতো অস্ত্র নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে হামলা চালায়।


মামলার বিবরণ অনুযায়ী, পরবর্তীতে এই পুলিশ কর্মকর্তা লঞ্চঘাট মডেল মসজিদের সামনে থেকে লঞ্চঘাট পুলিশ বক্সের সামনে পাকা রাস্তায় র পৌঁছালে অজ্ঞাতনামা চৌদ্দশ থেকে পনেরশ ‘দুষ্কৃতকারী’ পুলিশের ওপর রামদা, টেঁটা, ঢাল-সড়কি ও বর্শা নিয়ে হামলা করে।


এ সময় আত্মরক্ষার্থে তাদের সঙ্গে থাকা কনস্টেবল সোহাগ তার শটগান থেকে ১০ রাউন্ড কার্তুজ ‘ফাঁকা ফায়ার করে’ বলে এজাহারের ভাষ্য।


সেখানে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সেনা সদস্যরা ‘বলপ্রয়োগ’ করলে তারা (হামলাকারীরা) আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের দিকে গুলি ছোড়ে। আর তাতে গোপালগঞ্জ কলেজ মসজিদ রোড মিলন ফার্মেসির সামনে পাঁকা রাস্তার ওপর গুলিবিদ্ধ হন দীপ্ত সাহা। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।


এই ‘দুষ্কৃতকারীদের’ গুলিতে বিদ্ধ হয়ে সোহেল রানা মোল্লাও প্রাণ হারান বলে পুলিশের অন্য মামলায় বলা হয়েছে।


নিহত পাঁচজনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানগুলো একেবারেই কাছাকাছি, মোটামুটি এক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে। এর মধ্যে রমজান মুন্সী চৌরঙ্গী সিনেমার উত্তরপাশের রাস্তায়, দীপ্ত সাহা কলেজ মসজিদ রোড মিলন ফার্মেসির সামনে পাকা রাস্তার ওপর, সোহেল রানা মোল্লা লঞ্চঘাট হোটেল রাজ এর সামনে, রমজান কাজী আলিয়া মাদ্রাসার সামনে পাকা রাস্তায় এবং ইমন তালুকদার লঞ্চঘাট পুরাতন সোনালী ব্যাংকের সামনে পাকা রাস্তার ওপর গুলিবিদ্ধ হন বলে পুলিশের নথিতে লেখা হয়েছে।


ওই এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি চালাতে দেখার কথা বলেছেন স্থানীয়রা।


চৌরঙ্গীর কাছেই ফলপট্টির এক আম বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বুধবার সকালে দোকানপাট সবই খোলা ছিল। যহনই দেখলাম সমানে ফুটতেছে আমরা দোকান বাঁধা-ছাদা শুরু করলাম। এর মধ্যি লোকজনের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল।”


তিনি বলেন, “বৃষ্টিতে দোকান ঢেকে রাখা ত্রিপলে পানি জমল নাকি তা দেখতি আমি একবার আসলাম। তখন দেখি পোলাপান দা-বল্লম নিয়ে যাতিছে, ঢিল মাইরে আবার দৌড় দিতেছে। পুলিশ গলির মুখে। এর মধ্যেই শুনলাম মাদ্রাসার ওখানে একটা ছেলেক গুলি লাগিছে। আমরা তখন সরে আসি।”


গোপালগঞ্জের মূল ব্যবসা কেন্দ্র পুরাতন বাজার, কলেজ রোড, মাদ্রাসা রোড এসবই অলিগলিতে ভরা। মধুমতির তীর ঘেষা বঙ্গবন্ধু সড়কে গিয়ে মিশেছে গলিগুলো।


প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব গলির মুখে দাঁড়ানো হামলাকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর এপিসি থেকে গুলি চালানো হয়।


এ প্রতিবেদকের সঙ্গে এমন অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে, যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি করতে দেখার কথা বলেছেন। তবে তাদের কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।

সমাবেশের আগেই এনসিপির সমাবেশস্থলে একবার হামলার ঘটনা ঘটে।মামলাগুলোতে গুলির জন্য হামলাকারীদের দায়ী করে কয়েক হাজার আসামি করা হয়েছে। গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী গুলি করেছে- এমন ভাষ্য অস্বীকার করছেন না স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও।


গত ২০ জুলাই আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে তিনি বলেন, “সেখানে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমি অস্বীকার করছি না। এটা তো রাজনীতি, রাজনীতি করতে গেলে অনেক সময় অনেক কিছু হয়, আমরাও করছি, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনেক কিছু হয়। ঘটনার পরে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাই হচ্ছে আসল কথা। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”


একজন সাংবাদিক তখন বলেন, ‘সেখানে সেনাবাহিনীকে গুলি করতে দেখেছি আমরা’। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “যেখানে যে পরিস্থিতি, সেখানে সে ব্যবস্থা নিতে হয়।”


এরপর অনেকগুলো সংবাদমাধ্যম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে যে, গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী গুলি করেছে।


এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আইএসপিআর ১৭ জুলাই যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তাতে সেনা সদস্যদের ওপর কেউ গুলি চালিয়েছে–এমন কিছু বলা হয়নি।


সেখানে বলা হয়েছে, “সেনাবাহিনী হামলাকারীদের মাইকে বারংবার ঘোষণা দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা সেনাবাহিনীর উপর বিপুল সংখ্যক ককটেল ও ইট পাটকেল ছুড়ে হামলা করে এবং এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়।”


সেনাবাহিনীর ‘বলপ্রয়োগে’র কথা বলা হয়েছে পুলিশের দায়ের করা মামলাতেও। তবে সেটা কী ধরনের বল প্রয়োগ- তা স্পষ্ট করা হয়নি।


এ বিষয়ে গোপালগঞ্জের এসপি মিজানুর রহমানকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রশ্ন করেছিল, পুলিশের দায়ের করা চারটা হত্যা মামলায় বলা হয়েছে–পুলিশ ও সেনাসদস্যদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। বিষয়টি আসলে কী?


জবাবে এসপি শুধু বলেছেন, “ওরা (হামলাকারীরা) যে অস্ত্র নিয়ে গুলি করছে, সেই ছবিগুলো আপনার এই নম্বরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”


এসপি পরে চারটি ছবি পাঠান। ছবিগুলো গোপালগঞ্জের অন্তত ১০ জন স্থানীয় সাংবাদিককে দেখানো হলে তারা কেউ অস্ত্রধারী বা কোন জায়গার ছবি, সেটা শনাক্ত করতে পারেননি।


এই ছবি গোপালগঞ্জের সংঘাতের বলে ভাষ্য এসপির। তবে স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন ভিন্ন কথা।

স্থানীয় দুজন সাংবাদিক ছবি দেখে বলেছেন, সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। আর এই ছবি শুকনো সময়ের।


গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছিল কি না, সে বিষয়ে জানতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরীর সরকারি নম্বরে বার্তা পাঠানো হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে।


জবাবে তিনি বলেন, “দয়া করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির জন্য আইএসপিআর’র ওয়েবসাইট অনুসরণ করুন।”


তবে শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত আইএসপিআরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি।

কারা গ্রেপ্তার হল


শহরের বিসিক শিল্পনগরীর একটি ধানকলের ছোট্ট একটা খুপড়ী ঘরে বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে থাকতেন কালু শেখ। ছোটবেলা থেকে পায়ে সমস্যার কারণে খুড়িয়ে হাঁটেন। গত ১৭ জুলাই কালু শেখকে বাসার সামনে থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে বলে জানালেন বোন সুফিয়া বেগম।


তিনি বলেন, ছোটবেলায় ড্রেনে পড়ে গিয়ে পায়ে লোহা ঢুকেছিল কালু শেখের। এরপর তারা অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন, কিন্তু কয়েকদিন পরপর পায়ে পচন আসে।


গত বছর তারা ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভাইকে ভর্তি করিয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছিলেন কালুকে বাঁচাতে হলে পা কেটে ফেলতে হবে। এরপর তার মা ভয়ে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসেন। ছোটাছুটির কাজ করতে পারেন না বলে একটি আসবাবপত্র তৈরির কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন ১৯ বছরের কালু।


কালুর বোন সুফিয়া বলছিলেন, “আমার ভাইটা প্রতিবন্ধী। ও হাঁটতে পারে না ঠিকমত। ও কী জন্যি মারামারি করতে যাবে, বলেন। আমরা বলেছি, কিন্তু পুলিশ ছাড়েনি। এখন তারে পাঠাইছে পিরোজপুর জেলে। আমরা উকিল ধরতি গেছি, অনেক টাকা চায়। আমরা জানি না কী হবি।”

পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ কালু শেখের পরিবারের।


গোপালগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের মুকসুদপুর উপজেলার বাইশবাড়িয়া ইউনিয়নের বুলবুল মুন্সীকে (৪০) সংঘাতে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৮ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়।


বুলবুলের ভাই শিপুল মুন্সী বললেন, “আমার ভাই কৃষিকাজ করে, ও ইউনিয়ন কৃষক দলের আহ্বায়ক। যেদিন গোপালগঞ্জ শহরে গ্যাঞ্জাম হল, সেদিন ও সারাদিন পাট কাটিছে, এহন পাট কাটার মৌসুম।


“শুক্রবার যেদিন তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, সেদিনও সে পাট নিয়ে ব্যস্ত সারাদিন খাটাখাটনি করছে। ক্লান্ত হয়ে রাতে ৮টার মধ্যে শুয়ে পড়ছিল, পরে পুলিশ আইসে ঘুম থেকে উঠায়ে নিয়ে গেছে।”


গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭০ বছরের মোদক হালদারও।


তার স্ত্রী শিখা হালদার বললেন, “যেদিন গ্যাঞ্জাম হল, তার পরদিন দুপুরে গেছে বাইরে চা খাতি। আর ওমনি পুলিশ তারে ধইরে নিয়ে গেল।


“বুড়ো মানুষটারে কী ভেবে তারা ধইরে নিয়ে গেল, জানি না। সে তো দলও করে না, আর এই বয়সে তো গ্যাঞ্জামও করতি যায়নি। আমাগো যে কী বিপদ!”


আবার ১৫ বছর বয়সী সবুজকে ছাড়াতে তার পরিবার ছুটছে নানা জায়গায়। শহর থেকে একটু দূরে মধুমতি নদীর পাড়ে ভেড়ার বাজারে তাদের বাড়ি।


সবুজের নানি হাজেরা বেগম বললেন, “এখানে একটা ছেলে ইমনরে গুলি কইরে মারছে প্রশাসনে। ইমনরে বাঁচাতি গেছিল আমার সবুজে। তারেও ধইরে নিয়ে গেছে।


“এহন রাখছে যশোর পুলেরহাট (কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে)। সেখানে যাতায়াত করার টাকাও তো আমগের নাই।”

সবুজের নানি হাজেরা বেগম


গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেইসবুক গ্রুপে গণগ্রেপ্তার নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা আর ক্ষোভ জানিয়েছেন মানুষ।


‘আমাদের গোপালগঞ্জ’ নামে একটি ফেইসবুক গ্রুপে গোপালগঞ্জের গণপ্রেপ্তার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।


একটি পোস্টের নিচে মো. এলানুর লিখেছেন, “যারা অর্জিনাল আসামি তাদের ধরা হয়নি, সাধারণ জনগণ দিয়ে জেল-হাজত ভরে ফেলেছে।”


এই মন্তব্যের নিচে মুশফিকুর রহমান লিখেছেন, “অর্জিনাল আসামি আবার কারা? যাদের নাম এসেছে এরাও ভুয়া আসমি। গুলি করে মানুষ মেরেছে কারা তা জাতি জানে।”


সায়ান আঢ্য অঙ্কু নামে একজন লিখেছেন, “এখন সব ঠিকই আছে। কিন্তু গণগ্রেপ্তার চলছে, দোষীদের না পেয়ে নির্দোষ মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যারা ওইদিনের ঘটনা জানে না, বাসা থেকে বের হয়নি তাদেরকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে।”


ইভা ইসলাম লিখেছেন, “গ্রামের দিকের লোকেরা অনেকে মিছিলে যায়নি। কিন্তু তাদেরকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে বিনা অপরাধে।”


‘আমাদের গোপালগঞ্জ’ গ্রুপে ভিডিও পোস্ট দিয়ে মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সুজন শিকদার।


ওই ভিডিওতে তিনি বলছেন, “ওইদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরীহ-নিরাপরাধ গোপালগঘঞ্জবাসীর অনেকেই প্রশাসনিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন। আমাদের নেতা সেলিমুজ্জামান সেলিম ও এসএম জিলানীর দিক নির্দেশনায় গোপালগঞ্জের মানুষকে আইনি সহায়তা দিতে একটি টিম গঠন করা হয়েছে।”


ভিডিওতে তাকে আইনি সহায়তা দলের কয়েকজন আইনজীবীর নামও বলতে শোনা যায়।


জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন হীরা অবশ্য বলছেন, “আমাদের এরকম কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নেই। সেটা সুজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ হতে পারে।”


‘গণগ্রেপ্তার’ হয়েছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে এসপি মিজানুর রহমান বলেন, “গত পরশুদিন গ্রেপ্তার হয়েছে সাতজন, গতকাল (মঙ্গলবার) হয়েছে তিনজন আর আজকে হয়েছে দুজন। এরপর কীভাবে গণগ্রেপ্তারের বিষয়টি আসে, আমার জানা নেই। আমরা ভিডিও দেখে দেখেই গ্রেপ্তার করছি।”


সব মিলিয়ে ১০টি মামলায় ৩১৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে কয়েকজন শিশু-কিশোর রয়েছে, যাদের পাঠানো হয়েছে যশোর পুলেরহাট কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশের প্রধান বলেন, “তা থাকতে পারে কয়েকজন। স্পেসিফিক যারা ঘটনায় জড়িত ছিল, ভিডিও দেখে দেখে তাদের ধরা হয়েছে।”


এক সাংবাদিকের চোখে সেদিন


যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ তুহিন প্রায় দেড় দশক ধরে ঢাকায় অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা করছেন। এর আগে অনেক ধরনের রাজনৈতিক সংঘাতের সংবাদ সংগ্রহের অভিজ্ঞতা থাকা এই সাংবাদিক বলছেন, ওইদিন সকালে গোপালগঞ্জে ঢুকেই পুলিশের এলোমেলো ও খুবই অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রস্তুতি দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন।


তুহিন বলেছেন, সকালে তিনি ঢাকা থেকে ক্যামেরা ইউনিটসহ রওনা দেন। গোপালগঞ্জে ঢোকার আগেই তিনি খবর পান, পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এর একটু পরে সেখানে ইউএনও’র গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।


“আগের রাতে গোপালগঞ্জের এই কর্মসূচি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বাদানুবাদ দেখেছি, এখানে রক্তারক্তি কাণ্ড হতে পারে- এমন কথাও ছড়িয়েছিল। একদল বলেছিল টুঙ্গীপাড়ায় যাওয়ার কথা; আরেকদল তাদের প্রতিরোধের আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। দুই পক্ষের মধ্যেই ব্যাপক একটা সাজসাজ রব।”

এনসিপির সমাবেশ শেষ হওয়া মাত্র সভাস্থলের চেয়ার সড়কে এনে ভাঙার পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা।


আশঙ্কা নিয়ে রওনা হওয়ার পর পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার খবর পেয়ে তুহিন ‘আতঙ্কিত’ হন। গোপালগঞ্জ পৌঁছানোর পর তিনি শহরে ঘুরে দেখছিলেন- নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন।


সাংবাদিক তুহিন বলেন, “একদম গোপালগঞ্জ শহরে ঢোকার পর পৌরসভার কাছাকাছি দুটো গলির মুখে দুই-চারজন করে পুলিশের দেখা পেলাম। আমার কাছে অবাক লাগল। যেখানে আগের রাত থেকে এত উত্তেজনা, সকালে পুলিশের গাড়িতে আগুনও দিয়েছে, সেখানে একটা সাধারণ সমাবেশের মত নিরাপত্তাও আমার চোখে পড়েনি।


“এ কারণে আরও আগ্রহ নিয়ে সমাবেশস্থলের চারদিক আরেকটু ঘুরলাম। পৌর চত্বরে যেখানে সমাবেশ হচ্ছিল, তার দুই পাশে দুটো গেইট। স্টেজ বরাবর যে গেইটটা, সেখানে একজন এসআইয়ের নেতৃত্বে পুলিশ ছিল ছয় থেকে আটজন। আর পেছনে যে গেইটটা সেখানে এপিবিএনের একটা টিমে আট থেকে ১০ জন ছিল।


“এছাড়া চৌরঙ্গী মোড়- যেখানে মূল মারামারিটা পরে হয়েছিল, সেখানে ছোট একটা ইউনিট দেখলাম, ৪-৫ জন কনস্টেবল। কিন্তু এত উত্তেজনা, আমরা ঢাকায় যেটা দেখি, দাঙ্গা দমনের সরঞ্জাম নিয়ে অনেক পুলিশ, এরকম কিছু না। সবার ভাবটাও অনেক গাছাড়া, যেন থাকার দরকার, তাই থাকছে।”


১২টার সময় সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে যমুনা টেলিভিশন লাইভে কথা বলেন তুহিন।


তিনি বলেন, “পুলিশের গাড়ি ও ইউএনওর গাড়িতে হামলার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার হবে এমনটা ভাবছিলাম আমি। কিন্তু সমাবেশের আশপাশে নিরাপত্তার কোনো বাড়তি প্রস্তুতি আর দেখলাম না। সকালে যা ছিল, তাই। এগুলোই আমি লাইভে বললাম। এর মধ্যে ঝুম বৃষ্টি নামল।


“সাড়ে ১২টার পরে স্টেজে কেউ একজন বক্তব্য দিচ্ছে, আর ১৫-২০ জনের মত শ্রোতা ছাতা মাথায় শুনছে। এর কিছুক্ষণ পর বৃষ্টিটা যখন একটু কমে এল, তখন মাঠের পেছন থেকে হামলা। তারা এসে এলোপাতাড়ি চেয়ারগুলো ভাঙা শুরু করল।


“স্টেজে এনসিপির যেসব নেতাকর্মীরা ছিল, তারা এবং সামনে-পেছনে থাকা পুলিশ সব দৌড়ে পালিয়ে গেল। এ সময় পরপর বেশ কয়েকটা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আমি গুলির শব্দও শুনেছি। কিন্তু কে গুলি করেছে তা দেখি নাই।”


যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি তুহিন জানান, এরপর আবার এনসিপি সমর্থকরা ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা মধুমতির ওপারে গিয়ে ঢিল মারা শুরু করে। এই লোকগুলোসহ আরও লোকজন চৌরঙ্গী মোড়ের আশপাশে অবস্থান নেয়।


ততোক্ষণে ১টা পার হয়েছে। স্টেজ থেকে ডাকাডাকি চলছিল নেতাকর্মীদের। এরমাঝেই এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের বহর পুলিশ-সেনা পাহারায় সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়। তিন-চারজন বক্তব্য দিয়ে অল্প সময়েই সমাবেশ শেষ করে।


হাসনাত আবদুল্লহ, সারজিস আলমরা যখন সমাবেশ শেষ করে গাড়ি বহর নিয়ে শহর থেকে বের হচ্ছিলেন, তখন মূল হামলাটা হয় জানিয়ে তুহিন বলেন, সমাবেশস্থল থেকে কিছুটা এগোতেই চৌরঙ্গী মোড়ের আশপাশের গলিগুলো থেকে অতর্কিতে মনে হয় হাজারের বেশি মানুষ একযোগে বহরের ওপর হামলা চালায়। সমানে ইট মারছিল তারা। ককটেল বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছিল।


“মুহূর্তে চরম ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। অ্যাম্বুশে পড়লে যেমন হয়। তখন বহরের কিছু গাড়ি ঢাকা রোডের দিকে আর বেশিরভাগ চলে আসে পেছনের দিকে। আর্মির গাড়ির উপরেও প্রচুর ইট মারে তারা। আর্মিরা তখন ফাঁকা গুলি শুরু করে। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া।”

সহিংসতার পর শহরে জারি করা হয় কারফিউ। 


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রসঙ্গে তুহিন বললেন, “আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আগের রাত থেকে ফেইসবুকে এত উত্তেজনা, হুমকি। কিন্তু গোপালগঞ্জ পুলিশের সেই তুলনায় কোনো প্রস্তুতিই যেন ছিল না। সারা দেশের মানুষ জানে, গোপালগঞ্জে কিছু একটা হবে।


“সেই তুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনে হয়েছে নির্লিপ্ত। সমাবেশের নিরাপত্তা যদি দিতে না পারেন, তাহলে অনুমতি কেন দিলেন। যে ১৪৪ ধারা বিকেলে দিল, এটাতো সকালেই দিতে পারত। এতগুলো লোক জড়ো হল, সেই তথ্যও কী পুলিশ পায়নি?”


সাংবাদিক তুহিন বলেন, “আর্মিরা যখন এপিসি নিয়ে এসে সকলকে ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দিল, তখনো মূল সড়কে লাগোয়া গলিগুলো থেকে লোকজন হুটহাট বেরিয়ে হামলা করে চলে যাচ্ছে। বিকেলের দিকে সেনাবাহিনীর এপিসিগুলো একদিকে সরে যাওয়ার পর পুলিশসহ আমরা মাঝখানে পরে যাই।


“মানে সামনে থেকেও হামলা আসছে, পেছন থেকেও হামলা আসছে। আমরা চৌরঙ্গী মোড়ের কাছাকাছি বড় রাস্তার ওপর। সঙ্গে জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও আছেন। পুলিশ শটগানের গুলি ছুড়ে হামলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।


“কিন্তু তাদের টিয়ার শেল ও শটগানের কার্তুজের স্টকও প্রায় শেষ। চারদিক থেকে পুলিশকে ঘিরে ফেলে হামলাকারীরা। বিকেল ৫টার দিকে একেবারে যখন নাজুক অবস্থা, তখন আর্মির এপিসিগুলো এসে হামলাকারীরা সরিয়ে দেয়।


“৬টার দিকে আরেক দফা হামলা। তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আর্মির এপিসিগুলো সরে গেলেই হামলা শুরু হয়। তখন সেনাবাহিনীর ৫-৬টা জিপ ও পিকআপে করে একটা দল আসে। তখন আশপাশের মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে যে, পুলিশ রাস্তায় যাকে-তাকে ধরে মারছে। সবাইকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানানো হচ্ছে ওইসব ঘোষণায়।”


বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনায় তুহিন বলেন, “এসময় দেখি আশপাশের বাড়িগুলো থেকে অনেক নারীরাও নেমে এসেছেন। পুলিশ তখন ঢিল খেতে খেতে পুলিশ লাইনের দিকে হাঁটা দেয়। এত ঢিল আসছিল, আমার হেলমেট আগেই কোথাও খুলে পড়ে গেছে।


“একজন পুলিশ সদস্যের পরামর্শে আমের প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ক্রেট মাথায় দিয়ে কোনোরকমে পুলিশের দলটার সঙ্গে আমরাও যাত্রা করি। পেছন থেকে মাঝে মাঝে গুলি করছিল দু-একজন পুলিশ সদস্য। যাতে তারা কেউ কাছে না এসে। কিন্তু ওরা ২০-২৫ গজ দূরে এসেও ঢিল মেরে চলে যাচ্ছিল। শটগানের গুলিকে তারা ভয়ই পাচ্ছিল না।


“এরকম ভয়াবহ অবস্থার ভেতরে মার খেতে খেতেই পুলিশ লাইনে গিয়ে ঢুকলাম। ওরা আর পুলিশ লাইনের ভেতরে গিয়ে ঢোকেনি। পুলিশ লাইনের ভেতরে গিয়েই অনেকে হাসপাতালে গেল চিকিৎসা নিতে, মুহূর্তেই হাসপাতাল ভরে গেল। আর যাদের রক্তপাত হয়নি, তারা মাঠে জামা-কাপড় খুলে বিধ্বস্ত অবস্থায় শুয়ে পড়ে।”


হামলাকারীরা পুলিশ লাইনের গেইটে এসে কিছুক্ষণ ঢিলাঢিলি করে আটকে থাকা কিছু গাড়ি ভাঙচুর করে। এসময় তারা সেখানে বিএনপি নেতাদের নামে কিছু তোরণেও ভাঙচুর করে। সন্ধ্যার পর বাইরের জেলা থেকে পুলিশ আসে। সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত কনভয় শহরে গিয়ে টহল দিতে শুরু করে। হামলাকারীরা তখন সরে যায়।


পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন দুপুরে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে রাত ৮টা থেকে কারফিউ জারির ঘোষণা আসে।


তুহিন বলছেন, তার হাতে-পায়ে প্রচুর ইটের আঘাত লেগেছে। তবে জিন্স পরে থাকায় প্যান্ট ছেড়েনি।


রামদা-টেটার মত দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও জিন্স পরা লোকদের হাতে শটগান দেখেছেন বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক তুহিন। হামলাকারীরা প্রচুর ককটেলও ফাটিয়েছে। তিনি বলছেন, প্রচুর গুলির শব্দ হয়েছে। পুলিশ আর সেনাবাহিনী কিছু ফাঁকা ফায়ার করেছে।


হামলার ব্যাপকতা থেকে আব্দুল্লাহ তুহিন বলছেন, “হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল প্রাণে মেরে ফেলার।”


এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে আগেই উত্তেজনা তৈরি হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা প্রস্তুতি সেভাবে ছিল না বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য।


পর্যবেক্ষণে যা বলছে আসক


মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, তাদের চার সদস্যের প্রতিনিধি দল গত ২১ ও ২২ জুলাই সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি মনে করছে, গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। আর ১৬ জুলাইয়ের রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।


প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে আসক জেনেছে, সংঘর্ষে হামলাকারীদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপের পরিমাণ ছিল তীব্র, কারো কারো হাতে দেশি অস্ত্র ছিল। ঘটনার সময় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলেও হামলাকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে- এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে গুলি করেছে।


ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলে আসক বলছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে জানা যায়, এনসিপির নেতৃবৃন্দ স্বল্প সংখ্যক সমর্থকদের উপস্থিতিতে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়। এই মন্তব্যের পরপরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।


প্রত্যক্ষদর্শীরা আসক প্রতিনিধি দলকে বলেছে, বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ‘সাধারণ জনতা’ রাস্তায় নেমে আসে, একপর্যায়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।


নিহত ইমন তালুকদারের পরিবার প্রতিনিধি দলকে বলেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহ দ্রুত নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়ায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য হয়েছেন।


হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ একজন জানান, তার পেটে ও হাতে গুলি লেগেছে, হাতের একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি রিকশায় তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে তিনি আহত হন। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।


এছাড়া ২১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় ১৮ জন শিশুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যাদের অনেককে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে আসক’র তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।


গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাসের কাছে আসক প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছিলেন- আহতদের মধ্যে কতজন গুলিবিদ্ধ ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ঠিক এভাবে বলা যাবে না, গুলির বিষয়টি বলতে হলে আরো ‘এক্সামিন’ এর ব্যাপার রয়েছে।” তবে তিনি আসক প্রতিনিধিদের নিশ্চিত করেছেন, আহত পুলিশ সদস্য মিনহাজ সরদার ও কাওছার হোসাইন এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’র গাড়িচালক হামীম গুলিবিদ্ধ ছিলেন না।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *