Google Alert – সেনাবাহিনী
দিকে দিকে বিক্ষোভ-বিদ্রোহের ধিকি ধিকি দাবানল : ফ্যাসিস্ট হাসিনার মন্ত্রী-মেয়র-নেতা-এমপি-অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের পলায়ন : সেনাবাহিনীর হাতে ছাত্র-জনতার গোলাপ ও চকলেট
‘হাসিনা হঠাও- বাঁচাও দেশ’, ‘খুনি হাসিনার ক্ষমা নাই’, ‘আমার ভাই মরলো কেন- খুনি হাসিনা জবাব দাও’। ২০২৪ সালের আগস্টের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার থেকেই চট্টগ্রামের রাজপথে বিক্ষোভের জোয়ারে ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা। মিছিল-সমাবেশে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার সরকার পতনের দাবিতে এক আওয়াজ আরও জোরালো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট ছাড়া অন্য সব দলমত শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়। এতে আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি ঘটে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের বর্গীহানা হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করেই বন্দরনগরী এমনকি মফস্বলের হাট-বাজারে, পথের ধারে প্রতিবাদী দেয়াল লিখনে (গ্রাফিতি) ছড়িয়ে পড়ে ওই স্লোগানগুলো। পুলিশি বাধা এড়িয়ে এমনকি লুকিয়ে গ্রাফিতি যেন আন্দোলন সোচ্চার ভাষায় রূপ নেয় হাজারো তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত অঙ্কনে। তাদের হাতে রঙতুলি কেনার টাকা, চা-সিঙ্গারা ও শরবত তুলে দেন নিরীহ গৃৃহবধূ পর্যন্ত।
চব্বিশের ২ এবং ৩ আগস্ট ছিল শুক্রবার ও শনিবার। এ দুদিনে সমগ্র চট্টগ্রামে খুব দ্রুতই বিস্তার লাভ করে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে প্রায় অচলদশায় পড়ে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, প্রধান লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলপথ। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জ, আগ্রাবাদসহ চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পাঞ্চলগুলো থমকে যায়। ওই দুইদিনে আন্দোলন নতুন মাত্রায় বেগবান হয়। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ভার্সিটি, কলেজ ও মাদরাসা ছাত্র-সমাজ একজোট হয়েই নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশন, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, ওয়াসা মোড়, টাইগারপাস, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় বড়সড় বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করেন। এতে দলে দলে যোগ দেন ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তিকামী সাধারণ ছাত্র-জনতা।
অন্যদিকে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশি পাহারায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী গু-াবাহিনী বিশেষত ছাত্রলীগ, যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের ক্যাডাররা। তবে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে ওরা পুলিশ পাহারায় অলিগলি পথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র-জনতার মিছিল ও সমাবেশে জনতার ঢল নামতে থাকে সর্বত্র। বিক্ষোভ ও মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় চট্টগ্রাম। ২ ও ৩ আগস্ট থেকেই চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্র-জনতার সুসংগঠিত গণ-অভ্যুত্থানের পদধ্বনি সূচনা হয়।
৩ আগস্ট দুপুর, বিকাল ও সন্ধ্যা নাগাদ নগরীর বিভিন্ন স্থানে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকারীদের মিছিল-সমাবেশে ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসীরা চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। আহত হন অনেকেই। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সমাবেশ থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর মেয়র গলিলে ফ্যাসিস্ট হাসিনার কুখ্যাত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাড়ি, বহদ্দারহাটে আওয়ামী মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীসহ কয়েকজন আওয়ামী নেতার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-জনতা চড়াও হয়ে ভাঙচুর চালায়। অথচ মেয়র গলি চশমা হিলে নওফেলের বাবা সাবেক সিটি মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবন ছিল তার জীবদ্দশায় সব দলমতের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ক্যাডাররা শেষ কামড় দিতে মরিয়া হয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলের কয়েকজন নেতার বাসায় হামলা ও আগুন দেয়। ছাত্র-জনতা এদের প্রতিহত করে।
চট্টগ্রামসহ দেশে ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে টালমাটাল পরিস্থিতিতে অবস্থা বেগতিক দেখে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দোর্দন্ড প্রতাপশালী মন্ত্রী-মেয়র-নেতা-এমপি, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ছায়ায় লালিত-পালিত ও লুটপাটকারী, পদলেহী আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, অলিগার্করা ২ থেকে ৪ আগস্টের মধ্যেই বেশিরভাগ পালিয়ে যান। অনেকে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন। অনেকেই ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাইসহ দেশান্তরী হন।
নেপথ্যে ছিল ফ্যাসিস্টদের পেটেয়া পুলিশসহ বিভিন্ন প্রশাসনের ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। অনেকেরই পকেটে আগেভাগেই ছিল বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকেট। অনেকে আবার প্রথমে গা-ঢাকা দিয়ে পরে সুযোগ বুঝে বিদেশে পাড়ি জমান। অনেকে ভারতে পালাতে গিয়ে সীমান্তে বিজিবির হাতে ধরা পড়েন। ঢাকায় গিয়েও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন অনেকেই। তাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল, সাবেক মেয়র রেজাউল করিম, মহনগর আওয়ামী নেতা সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ছাড়াও অনেকেই পালিয়ে গেছেন। আওয়ামী সরকার দলীয় নেতা-মন্ত্রী-এমপি, মেয়র, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ১ থেকে ৪ আগস্টের মধ্যে হঠাৎ লাপাত্তা হওয়া নিয়ে চট্টগ্রামে জনসাধারণের মাঝে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা জমে ওঠে।
তীব্র গণ-আন্দোলনের বিস্ফোরণে এ অবস্থায় চট্টগ্রামে আগেই গণ-অভ্যুত্থান সূচিত হয়েছিল। সেই উত্তাল কয়েকটি দিনে বৃহত্তর চট্টগ্রামের দিকে দিকে জ্বলছিল গণবিক্ষোভ-বিদ্রোহের ধিকি ধিকি দাবানল। এতে দিশেহারা হয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার মন্ত্রী-মেয়র-নেতা-এমপি, অলিগার্ক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের ‘এক দফা এক দাবি’তে যখন একদিন এগিয়ে এনে ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন (আগেরদিন ৪ আগস্ট), তখন বৃহত্তর চট্টগ্রামের অগণিত ছাত্র-জনতা যে যেভাবে পারে রাজধানী ঢাকায় ছুটতে থাকে।
৩, ৪ এবং ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়ন ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে চূড়ান্ত বিজয়ের সূর্য উদিত হওয়া অবধি অর্থাৎ সেই ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের দিনটিতে চট্টগ্রামের রাজপথ অলিগলি কাঁপানো ছাত্র-জনতার গগনবিদারী স্লোগান ছিল- ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘এইমাত্র খবর এলো- হাসিনা পালিয়ে গেলো’ ইত্যাদি।
৫ আগস্ট, ’২৪ইং। ঠিক এক বছর আগে হাসিনার ফ্যাসিবাদী অপশাসনের পতন ও পলায়নের ঐতিহাসিক দিনটি ছিল সোমবার। ওইদিন দুপুর থেকেই পতেঙ্গায় সাগরের জোয়ারের মতোই সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা চট্টগ্রামের রাজপথ, সড়ক, রাস্তাঘাট প্লাবিত করে। মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। মিছিলকারী ছাত্র-জনতা বন্দরনগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে ফুল, চকলেট তুলে দিতে এবং আবেগাপ্লুত হয়ে হাত মেলাতে ও কোলাকুলি করতে দেখা যায়। সেনা সদস্যরাও সহাস্যে আনন্দ ভাগাভাগি করছিলেন।
হিজাব ও বোরখা পরিহিত ছাত্রী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, গৃহবধুরাও স্মরণীয় আনন্দে নিজেদের স্মরণীয় রাখতে রাস্তাঘাট সড়কে নেমে আসেন। এসব দৃশ্য ছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রামের উত্তর প্রান্তে অক্সিজেন-ফতেয়াবাদ থেকে দক্ষিণে পতেঙ্গা-কাটগড়, পূর্বে মোহরা-কালুরঘাট থেকে পশ্চিমে হালিশহর-কাট্টলী-ফৌজদারহাট পর্যন্ত। জনতার ঢলে ভেসে যায় কারফিউ। ৫ আগস্ট সকালেও নগরীতে পুলিশ-র্যাব ছিল তৎপর। অথচ দুপুর গড়াতেই সবখানে তারা নির্বিকার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন অথবা গা-ঢাকা দেন অনেকেই। পাল্টে যায় দৃশ্যপট। অভূতপূর্ব ছিল সেসব দৃশ্য! যা আগে দেখেনি কেউ।