চাকসু নির্বাচনের আড়ালে হারিয়ে গেলেন আহত ‘সায়েমরা’

Bangla Tribune

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আগামী ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন। ভোট ঘিরে ক্যাম্পাসে এখন একধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন প্যানেল ঘোষণা করেছে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও মাঠে নেমেছেন। সবাই এখন প্রচারণায় ব্যস্ত। কিন্তু এই ব্যস্ততার ভিড়ে ধামাচাপা পড়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা। সংঘর্ষে আহত সায়েম, মামুন ও নাইমের খোঁজ নেওয়ার সময় হয় না কারও। সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত।

আহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েমের অবস্থা এখনও গুরুতর। গত ৩১ আগস্ট রাতে তাকে পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। এরপর থেকে আইসিইউতে থাকার পর ১৬ সেপ্টেম্বর কেবিনে নেওয়া হয়। কিন্তু শরীরের বাম অংশ এখনও অচল। বাম হাত ও বাম পা কাজ করে না। এমনকি সোজা হয়ে বসতেও পারেন না। সবচেয়ে কষ্টকর হলো, তিনি এলোমেলো কথা বলেন। কিছুই মনে করতে পারেন না। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন স্বজনরা। তারা বলছেন, ঠিকমতো সায়েমের খোঁজ নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সায়েমের বাড়ি কুমিল্লায়। তবে তার পরিবারের সদস্যরা বগুড়ায় থাকেন। আহত হওয়ার খবর পেয়ে বগুড়া থেকে তার বাবা আমির হোসেন ও মা শাহনাজ আমিন চট্টগ্রামে আসেন। ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরবেন, সেই অপেক্ষায় দিন কাটছে তাদের।

একই সময়ে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছিল সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মামুনকে। তার মাথার খুলিতেও গুরুতর আঘাত ছিল। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় গত ১ সেপ্টেম্বর বিকালে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয় এবং কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। ​বর্তমানে মামুন কেবিনে চিকিৎসাধীন আছেন। পুরোপুরি সুস্থ হতে দুই-তিন মাস লাগবে। তবে মাথার খুলি এখনও ফ্রিজে রাখা হয়েছে। কয়েক মাস পর তা আবার লাগানো হবে।

সংঘর্ষে আহত নাইমুল ইসলাম রাফিকে প্রথমে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এই শিক্ষার্থীকে অস্ত্রোপচারের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই দিন রাতেই ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি। তিনি এখনও ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। একটু হাঁটলেই তার কাটা পা ফুলে যায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তাকে ফিজিওথেরাপি দেওয়ার জন্য ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে হবে।

গত ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত সোয়া ১২টা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কয়েক দফা সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে মারধরের অভিযোগ থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত। সংঘর্ষে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ এবং অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী আহত হন।

তদন্ত ও বিচারকাজ নিয়ে শঙ্কা

সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধানে গত ১ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সুপারিশসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে মোট ১০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে তদন্ত কমিটি এখনও গঠিত হয়নি। বাস্তবায়ন হয়নি কোনও সিদ্ধান্ত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনে বলেন, ‌‘তদন্ত কমিটি গঠন করার অনুরোধ করে ২ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু তদন্তের বিষয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনও আপডেট নাই। তারা যখন কমিটি গঠন করবে, তখন আমাদের জানাবে।’ 

৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক হাজার ৯৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। এতে ৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাতনামা আরও এক হাজার জনকে আসামি করা হয়। মামলা হওয়ার দিন রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আট আসামিকে গ্রেফতার করলেও বাকিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন।

মামলার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বলেন, ‘এখান কেউ কেউ বলছেন, নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। তাই আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেছি, যাতে কোনও নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়। সেদিক থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাচ্ছে, অপরাধী শনাক্ত করে গ্রেফতার করবে।

বিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন

কয়েকদিন আগেও অপরাধীদের বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন করে ছাত্র সংগঠনগুলোসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে প্রক্টরের পদত্যাগসহ ৭ দফা দাবিতে আমরণ অনশনে বসেন ‘অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোসহ কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী। অনশনে বসার ৩৫ ঘণ্টা পর নয় জনের মধ্যে ছয় জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মধ্যে তিন জনকে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা নেওয়া হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ ৫২ ঘণ্টা পর গত ১২ সেপ্টেম্বর উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাসে আমরণ অনশন ভাঙেন তারা। তবে এখন পর্যন্ত তাদের কোনও দাবি পূরণ হয়নি।

গত ২৮ আগস্ট চাকসুর তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। ​এ ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের নির্বাচনি আমেজ তৈরি হয়। পরে তফসিল ঘোষণার দুদিনের মাথায় এক নারী শিক্ষার্থীকে দারোয়ান কর্তৃক মারধরের অভিযোগকে কেন্দ্র করে ৩০ ও ৩১ আগস্ট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাস সংলগ্ন জোবরা গ্রামের স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়। টানা দুদিনের সংঘর্ষে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।

এরপর নির্বাচনের আমেজ ভুলে গিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রক্টোরিয়াল বডির পদত্যাগ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে একযোগে আন্দোলন করে ছাত্র সংগঠনগুলো। ছাত্রদল, ইসলামি ছাত্রশিবির, নারী অঙ্গন, গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, প্রতিবন্ধী ছাত্রসমাজ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্কৃতি সংগঠন এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ​ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে শহীদ মিনার পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে তারা। এ ছাড়া প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ, মশাল মিছিল এবং লাল কার্ড প্রদর্শনের মতো বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দাবিগুলো তুলে ধরেন।

এরই মধ্যে গত কয়েকদিনে ভোটের আমেজে হারিয়ে যায় আহতদের কথা। বর্তমানে ক্যাম্পাসের শাটল ট্রেন, ঝুপড়ি, কিংবা আড্ডা সবখানেই কেবল চাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। এতে সায়েমদের বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিগুলো যেন নির্বাচনি উত্তেজনার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু হলেও পরদিন শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ক্যাম্পাস ছুটিতে চলে যায়। শিক্ষার্থীরা নেমে যান বাড়ির পথে। কিন্তু প্রার্থীরা থেমে থাকেননি। ফাঁকা ক্যাম্পাসের বদলে বেছে নিয়েছেন ফেসবুকের বিশাল ভার্চ্যুয়াল আঙিনা। ফেসবুকে একের পর এক পেজ খুলে প্রচারণা চালাচ্ছে প্যানেলগুলো। কেউ কেউ ফেসবুকে লাইভও দিচ্ছেন। ‘দ্রোহ পর্ষদ’, ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’, ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’, ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’, ‘সার্বভৌম শিক্ষার্থী ঐক্য’, ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’, ‘চাকসু ফর স্টুডেন্টস রাইটস’—প্রতিটি নামের সঙ্গে পেজ, প্রতিটি পেজে হাজারো অনুসারী।

ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’-এর ফেসবুক পেজের অনুসারী ইতিমধ্যে ছাড়িয়েছে ২৪ হাজার। পেজে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেলো, প্রার্থীরা হলে ঘুরছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, দোয়া চাইছেন। প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন বললেন, ‘প্রথম দিন প্রচারণা করেছি অনুষদ, শাটল ট্রেন, ঝুপড়িতে। তবে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি সাড়া পাচ্ছি। এখানে একসঙ্গে হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যায়।’

অন্যদিকে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করছেন সাজ্জাদ হোসেন। তিনিও অনলাইনে বেশ সক্রিয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের ভিডিও দিচ্ছেন নিয়মিত। দোয়া ও সমর্থন চাইছেন।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *