চীনের কূটনীতি চমকে জাগে আশা

দেশ রূপান্তর

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কারোপের ঘোষণায় ভারত পড়েছিল আকস্মিক চাপে। পরীক্ষিত মিত্র রাশিয়া রয়েছে ভরসাস্থল, এটা জেনেও অস্বস্তির বৃত্তে আটকে ছিল ভারত। এমন দুঃসময়ে চীন পাশে দাঁড়ায়। কূটনীতির ভুবনে এ ছিল অপ্রত্যাশিত। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার যেসব পণ্য ক্রয় অন্য সব দেশের জন্য বারণ, তার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল, গ্যাস। পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ওই নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় চীন সরাসরি নাকচ করে দিয়ে ইউয়ান ও রুবলে চীন-রুশ বাণিজ্য পরিমাণ আরও বাড়ানোর কথা জানায়। রাশিয়ার সঙ্গে রাখঢাকে তেল-গ্যাস ক্রয় বাণিজ্য চালাচ্ছিল ভারত। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও পশ্চিম ইউরোপের অর্থ-শক্তি বলীয়ান রাষ্ট্রগুলো প্রথম থেকেই এটা জানে। তখনকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন এটা জানতেন এবং তিনি এ ব্যাপারে চীনকে পরোক্ষভাবে ভ্রষ্টাচারী বলে নিন্দাবাদ করলেও, ভারতের ক্ষেত্রে না-দেখা না-বোঝার ভান করে সময় পার করেছেন। ভারতের ওপর তিনি দণ্ডারোপে যাননি বরং চীনের পণ্যের ওপর রপ্তানি শুল্ক বৃদ্ধিসহ আমদানি ও বিক্রি ক্ষেত্রে নানা পর্যায়ে কর বসিয়ে দেন। চীন তখন বাইডেন কার্যক্রমকে স্বেচ্ছাচার ও মুক্তবাণিজ্য নিরোধক প্রবলের একপক্ষীয় বাধা বলে চিহ্নিত করে। সে সময় ভারত ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারতসহ কয়েক দেশের সামরিক জোট) মহড়ার উৎসাহী সহযোগী। আবার ভারত-চীন সীমান্তের গালওয়ানে তখন একমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া সব ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহারে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ভারতের ২০ এবং চীনের ৫ সেনা নিহত হয় সীমান্ত যুদ্ধে।

এসব ঘটনাধারা অতীতের জিম্মায় জমা দিয়ে কূটনীতির মহাসড়কে নতুন এক বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ যাত্রায় সোমবার দিল্লি যান চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংই। কুশলী কূটনীতিক ওয়াংইর বিচক্ষণতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুবিদিত। দিল্লিতে নেমেই তিনি বলেন, ‘আমাদের দুদেশের সম্পর্ক একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। এখন আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। সেজন্য দুই দেশেরই উচিত খোলামেলা ও গঠনমূলক আলোচনা করা।’ বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানায়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে ওয়াংই বলেছেন, ‘ভূ-রাজনীতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের নামোল্লেখ না করে তিনি একটি দেশের একতরফা জবরদস্তিকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, ‘মুক্তবাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা পড়ছে তীব্র চ্যালেঞ্জে।’ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মনিয়ম জয়শঙ্কর বলেন, ‘স্থিতাবস্থা বজায় রেখে সীমান্ত হতে হবে শান্তিপূর্ণ।’ সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘উভয় পক্ষের নানা মতপার্থক্য সত্ত্বেও পারস্পরিক শ্রদ্ধা, পারস্পরিক সংবেদনশীলতা ও পারস্পরিক স্বার্থ এই তিন মৌল ভিত্তির ওপর রচিত হতে হবে দুদেশের সম্পর্ক এবং এড়িয়ে যেতে হবে সংঘাত ও প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব।’ দুই বৃহৎ এশীয় দেশের দুই প্রধান কূটনীতিকের বক্তব্যের বিশদ উল্লেখে আমরা দেখছি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবর্গের চলার এবং অনুসরণের রীতিনীতি পুনর্বার স্পষ্ট উচ্চারিত হয়েছে। এজন্যই চীন ও ভারতের এই অতি সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সংলাপ সব দেশে, বিশেষ করে আমাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাড়িত এবং অনুন্নয়ন পীড়িত এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আশার সঞ্চার করে বলে আমরা মনে করি। থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া, মিয়ানমার-থাইল্যান্ড, পাকিস্তান-ভারত, নেপাল-ভুটান, মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-ইন্দোনেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এবং আমাদের বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের স্থিতি, উত্তেজনাহীন শান্তিপূর্ণ যাত্রা ও পারস্পরিক কল্যাণ উন্নয়ন, সমৃদ্ধির স্বার্থে আলোচ্য দুই কূটনীতিকের বক্তব্য হতে পারে নতুনভাবে চর্চার নয়া দিশা।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুদেশের ২৮০ কোটি জনসমষ্টির ঐক্যকে শক্তি বলে অভিহিত করেছেন এবং বহুমুখী পৃথিবীর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে এমন ঐক্য শক্তি সঞ্চয়ে অগ্রণী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রায়নে অবদান রাখা দুই দেশের কর্তব্য হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে ১৯৬২-এর সীমান্ত যুদ্ধ পর্যন্ত চীন-ভারত সম্পর্কের ধ্বনি ছিল, ‘হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই’। সেই মধুর অতীতের স্মৃতি দুদেশের রাষ্ট্রস্তরে আবার জেগে উঠুক, এই একান্ত প্রার্থনার সঙ্গে এই প্রত্যাশাও যুক্ত করতে চাইব যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত-চীন-পাকিস্তান হোক এক শান্তিময় দক্ষিণ এশিয়া।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *