ছাত্রশিবির, ‘গোপন রাজনীতি’ ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

The Daily Ittefaq

‘ওই বড় ভাই প্রথমে আমাকে আলাদা রুমে নেয়। তারপর আমার বাম হাতটা ধরে একটু মোচড় দিয়ে রাখল। এরপর ক্রমাগত আমার কান আর গাল বরাবর সর্বশক্তি দিয়ে থাপ্পড় দিতে থাকে। এত জোরে মারছিল যে আমার কান থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গেস্টরুম’ নির্যাতনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সূর্যসেন হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান। তার ভাষায়, ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অনিয়মিত হওয়ায় ২০২৪ সালের শুরুতে তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।

আরিফুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিন গেস্টরুমে যেতে হবে। হলে থাকার নিয়মই এটা। আপনার যদি ফাইনাল পরীক্ষাও থাকে, তবু এসে অপেক্ষা করতে হবে। ভাইয়েরা এলে অনুমতি নিয়ে পড়তে যেতে পারবেন। নাহলে খোঁজাখুঁজি শুরু হবে।’

তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গেস্টরুমের সংস্কৃতি আর নেই বলে জানান আরিফ। তবে তার আশঙ্কা, আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি ফিরে এলে আবারও ‘গণরুম-গেস্টরুম কালচার’ ফিরে আসবে।

তিনি বলেন, ‘দেখেন, এখন আমরা স্বাধীন। দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা রাজনীতিতে নষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু হলে রাজনীতি ফিরলে এর প্রভাব পড়বেই। হলে রাজনীতি না থাকলে ছাত্রদল, শিবির কিংবা বাম সংগঠনদের কী সমস্যা হয়, আমি বুঝি না। তারা কমিটি দিলেই গেস্টরুম, গণরুম আবার ফিরবে।’

পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে আরিফের মতো অনেকে হলে ছাত্ররাজনীতি চান না। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও অনেকেই এর বিরোধী। এক সপ্তাহ আগে ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কমিটি ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীদের একাংশ বিক্ষোভ দেখায়। হলে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে বিক্ষোভের মুখে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের মৌখিক ঘোষণা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।



কিন্তু এর মধ্যেই ছাত্রদল, ছাত্রইউনিয়নসহ বামপন্থী সংগঠনগুলো হলে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) হলে রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

ফলে ডাকসু নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। প্রকাশ্য রাজনীতি বনাম গোপন রাজনীতির প্রসঙ্গও সামনে এসেছে।

যদিও অভ্যুত্থানের সময় দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নয় দফার মধ্যেও এই দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল, এখন ছাত্র সংগঠনগুলো ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে।

ক্যাম্পাস ও হলে রাজনীতি কেন দরকার?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে মূলত ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার পর। এরপর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নয় দফাতেও লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ছিল।

কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দ্রুতই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি ফিরে আসে। সক্রিয় হয় সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন। দীর্ঘদিন প্রকাশ্য রাজনীতি না করলেও ইসলামী ছাত্রশিবিরও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি ঘোষণা করে প্রকাশ্যে আসে।

এসব সংগঠনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা বৈঠকেও অংশ নিয়েছেন। তবে ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ আর সামনে আসেনি।

এর মধ্যেই ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একাংশ ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ (বাগছাস) গঠন করে। দলটি এনসিপির হয়ে কাজ করছে—এমন অভিযোগ থাকলেও নেতারা তা অস্বীকার করেছেন।

বাগছাসের মুখপাত্র হাসিব আল ইসলাম বলেন, ‘এটা অপপ্রচার। আমরা এনসিপির লেজুড়বৃত্তিক সংগঠন না। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করছি। আমাদের কোনও অভিভাবক সংগঠন নেই। আমরা নিজেরাই নিজেদের অভিভাবক।’


ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ছে

এই দল ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে হলেও হলে রাজনীতির বিপক্ষে। অপরদিকে ছাত্রদলসহ বিভিন্ন সংগঠন হলে রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে চায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী বলেন, ‘হলে রাজনীতি করতে না দিলে ডাকসু নির্বাচনে আমরা কীভাবে কাজ করব? হলে যদি সাংগঠনিক কাঠামো না থাকে তাহলে প্রচারণা কীভাবে করব? আমরা গুপ্ত সংগঠন নই। প্রকাশ্য সাংগঠনিক কাঠামোর জন্যই হল কমিটি দিয়েছি।’

ছাত্রইউনিয়নও প্রথমে হলে কমিটি ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, ‘হলে রাজনীতি নিয়ে একটা ভীতি আছে, আমরা সেটা সম্মান করি। তবে হলে যেকোনও সংকট মোকাবেলায় হল কমিটির নেতারাই কাজ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নয়।’


ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার দপ্তর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী

গোপন রাজনীতি কীভাবে বন্ধ হবে?

অনেক ছাত্রনেতা মনে করেন, হলে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলে গোপন রাজনীতি বাড়বে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘গোপন রাজনীতি বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। ছাত্রশিবিরকে গোপন রাজনীতির জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে, কিন্তু প্রশাসনের কি কোনও অবস্থান আছে? প্রশাসন কঠোর না হলে গোপন রাজনীতি বন্ধ হবে না।’

উমামা ফাতেমার মতো বাগছাসও হলে রাজনীতির বিপক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘হলে রাজনীতি ফিরলে শিক্ষার্থীরাই ভিক্টিম হবেন। এখন হলে কমিটি নেই বলে কেউ বাধ্য করছে না। কিন্তু হলে কমিটি হলে শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামে আনতে চাপ দেবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই আমরা বলছি রাজনীতি ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ থাকুক।’

তবে শিক্ষার্থীরা যেহেতু হলে থাকেন, তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাজনীতি থাকলে হলে তার প্রভাব পড়বেই বলে অনেকে মনে করেন। আব্দুল কাদেরের মতে, সেটি ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ‘রাজনীতির একটি রূপরেখা’ তৈরি করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অপরাজেয় বাংলা' ভাস্কর্য

ছাত্রশিবির কী বলছে?

হলে রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তির মধ্যে ছাত্রশিবির মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে।

বিভিন্ন দল অভিযোগ করেছে, হলে শিবিরের ‘গোপন কার্যক্রম’ আছে, ফলে প্রকাশ্য রাজনীতি না থাকলে তাদেরই সুবিধা। তবে শিবির নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করেন।

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘আমরা অসংখ্য প্রোগ্রাম করেছি ক্যাম্পাসে। এগুলোতে হলে থাকা শিক্ষার্থীরাই এসেছে। হলগুলোতে আমাদের ছোট ছোট টিম তাদের কাছে গেছে। সবাই সবাইকে চেনে।’

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *