জিয়াউর রহমানের লিগ্যাসি এবং আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতা

Google Alert – সামরিক

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগকে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদিরা কখনো মেনে নিতে পারেনি। তারা মিথলজিক্যাল মহাভারত বা গ্রেটার হিন্দুস্তানের স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে দুর্বল করে দখল করে নেয়ার দীর্ঘ মেয়াদি রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়কার দাঙ্গা-সংঘাতে রক্তাক্ত জনপদে রক্তের দাগ আর শোক-সন্তাপের চিহ্ন মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কাশ্মিরের অর্ধেকটা ও হায়দারাবাদ দখল করে নেয় ভারতীয় বাহিনী। এরপরের টার্গেট ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে লেন্দুপ দর্জির মাধ্যমে সিকিম গ্রাস করে নেয় ভারত। বিশেষত ঔপনিবেশিক আমলের অখ- ভারতের যেসব অংশ সর্বশেষ ১৯৪৭ সালে মুসলমান জনসংখ্যা অধ্যুসিত হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করেছে, অথবা প্রিন্সলি স্ট্যাটের মর্যাদা অক্ষুণœ রেখেছে, পাকিস্তানসহ সেসব রাষ্ট্রের প্রতি ভারতের শ্যেণদৃষ্টি পুরো অঞ্চলে একটি অনাকাক্সিক্ষত অস্থিরতা ও অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ভারতের দখলদারিত্বের নীতি হাজার বছর ধরে স্বাধীন কাশ্মিরিরা কখনোই মেনে নেয়নি। জম্মু-কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামিরা ১৯৬৫ সালে ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের ডাক দিলে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মির থেকে বিদ্রোহে মদত দেয়ার অভিযোগে ভারত পাকিস্তানের উপর সামরিক আগ্রাসন শুরু করলে ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যায়। সেই যুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সৈনিক ও বৈমানিকদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা যুদ্ধের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অপারেশন জিব্রালটার নাম দিয়ে পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারত অনেকটা নাস্তানাবুধ হয়ে তার বন্ধু রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হয়। সেই যুদ্ধের বিরত্বের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তরুণ ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব হিলাল ই জুরাত পদকে ভূষিত হন। সম্ভবত সে সময়ই ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেভাবেই হোক, পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে ফেলার। আগরতলা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি ছিল তারই প্রথম রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট যেমন ছিল অস্বাভাবিক, তেমনি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপটও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তারাই অনিবার্য করে তুলেছিল। অন্যসব দেশীয় ও আঞ্চলিক কুশীলবরা তার সদ্ব্যবহার করেছে মাত্র। তবে ৪৭’-এ দেশভাগ না হলে একাত্তরের স্বাধীনতা জম্মু-কাশ্মির, হায়দারাবাদের মতই প্রায় অসম্ভব ছিল। পয়ষট্টি সালের যুদ্ধের ধাক্কা ভারতকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভেতর থেকে রাজনৈতিকভাবে ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে না পারলে গায়ের জোরে পাকিস্তানের কোনো অংশ দখল করে নেয়া সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরাই ভেতর থেকে ভাঙ্গনের জন্ম দিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ইন্ধন সে আগুনে ঘৃত সংযোগ ঘটিয়েছিল মাত্র। সেখানে তাদের দুরভিসন্ধি ছিল। পয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্ণেল ওসমানি ও ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২৫ মার্চ রাত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর জিয়া প্রথম বিদ্রোহ করে নিজের কমান্ডিং অফিসার জানজুয়াকে বন্দি করে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটান। এরপর ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যা দ্রুত সারাদেশে ও বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি নিজেকে দেশমাতৃকার সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। দেশের প্রয়োজনে তিনি বারবার জীবন বাজি রেখে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পয়ষট্টি সালে, একাত্তর সালে এবং পঁচাত্তরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের গতিপথ জিয়ার দেশপ্রেম ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের ঐতিহাসিক উদাহরন।

পলাশির যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর গত আড়াইশ’ বছরের ইতিহাসে সমরনায়ক থেকে রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার সমতুল্য আর একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, মাওলানা ভাষানী থেকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা থেকে জিয়ার ব্যতিক্রমী স্বাধীন নেতৃত্বের অনিবার্য উত্থানের মধ্যেই আধুনিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রযাত্রা নির্ণিত হয়েছে। ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ঐতিহাসিক লিগ্যাসি নির্মাণ করেছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে তার ভীরুতা, পলায়নপর মনোবৃত্তি এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তার নেতৃত্বের সংকট, লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে তিনি নিজের পলিটিক্যাল লিগ্যাসিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্ব মেনে নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সেনিকরাই পঁচাত্তরে তাঁকে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল। সেই ট্রাজিক ঘটনা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম ক্ষতচিহ্ন। ভবিষ্যতের ফ্যাসিস্ট শক্তির জন্য ভয়জাগানো দৃষ্টান্ত। একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েমের সাথে সাথে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতার পালাবদলের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে তিনি নিজেই সেই অনিবার্য ট্রাজেডির জন্ম দিয়েছিলেন। দু’একটা বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুজিবের করুন মৃত্যুতে কেউ শোক কিংবা বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ ‘ফেরাউনের পতন’ ঘটেছে বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। মুজিবের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক পতন ও বিচ্যুতির ক্ষত ঢেকে রেখে শেখ মুজিবকে এক নিস্কলুষ মহামানবে পরিনত করতে গিয়ে তার কন্যা শেখ হাসিনা শেখ মুজিবকে দ্বিতীয়বার হত্যা করেছেন। তাকে সব রকম সমালোচনার ঊর্ধ্বে রেখে, দেবতার আসনে বসিয়ে মিথলজির মত একটি মেকি অতিমানবীয় লিগ্যাসি সৃষ্টি করে বিভাজনের রাজনীতিকে চিরস্থায়ী বৈরিতা ও বিরোধি মত নির্মূলের জন্য গুম-খুন, ক্র্যাক-ডাউন ও আয়রণ-ক্লাড দু:শাসনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাও গণতন্ত্রের কবর রচনা করে নিজের ও দলের জন্য চরম পতন ডেকে এনেছিলেন। লোকে বলে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রশক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশের চরম ক্ষতি করা সম্ভব হলেও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের স্বপ্ন কখনোই পুরণ হয়না। ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই।

রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বাকশালি শেখ মুজিব কিংবা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার স্বাভাবিক পালাবদল সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন থেকে ছাত্র-জনতার একদফা ও গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়ার ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। একাত্তরের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। কিন্তু দেশের চলমান বাস্তবতায় এ কথা আবারো প্রমানিত হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা বেশি কঠিন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল লিখেছিলেন, অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা। আর এক সময়ের মেধাবি আওয়ামী লীগ নেতা ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, বেশিদামে কেনা কমদামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা। একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা হাতছাড়া হওয়ার ভয় জাতিকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আবারো প্রমানিত হচ্ছে, আমাদের কোনো চিরস্থায়ী শত্রু বা মিত্র নেই। জাতীয় ঐক্য, গণআকাক্সক্ষা ও গণতন্ত্রের শত্রুরাই আমাদের মত জাতিরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির প্রধান প্রতিবন্ধক বা শত্রু। সেই ১৭৫৭ সালে নবাব পরিবার ও মুসলমান সমাজে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বৃটিশ ও হিন্দুদের প্ররোচনা ও গোপন কলকাঠি যেভাবে স্বাধীনতা ও ভূখ- কেড়ে নিয়েছিল, আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক সম্প্রীতি ও ঐক্যবিরোধি শক্তিই স্বাধীনতার প্রধান প্রতিপক্ষ। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিজস্ব ন্যারেটিভ প্রচার করে রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে শত্রুতায় পরিনত করার মধ্য দিয়ে দেশকে দুর্বল, অস্থিতিশীল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উত্থিত নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা গতানুগতিক রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে তা দেশের জন্য বড় ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনবে। আওয়ামী লীগের পতন, পলায়ন ও রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ হওয়ার পর আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটারদের নিজের পক্ষে টানতে নানা কৌশল ও হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে আওয়ামী ন্যারেটিভ ধার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিভাজন-বিভক্তির রাজনীতি করতে গিয়ে কেউ নব্য ফ্যাসিস্টের পথে বাড়াতে চাইলে তা তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ভোটের রাজনীতিতে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এক চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, দেশে সশরীরে তারেক রহমানের অনুপস্থিতির কারণে দলে এক ধরণের ভারসাম্যহীনতা কখনো কখনো দল ও দেশকে অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতার মুখে দাঁড় করাচ্ছে। দলের অভ্যন্তরে অবস্থান নেয়া আওয়ামী ন্যারেটিভের সমর্থক ও সিম্প্যাথিটিক নেতাদের বেশিরভাগ এক সময় আওয়ামী লীগের সাথে সরাসরি জড়িত থাকার রেকর্ড রয়েছে। যারা এখনো একাত্তরের ন্যারেটিভ ও ইসলামি মূল্যবোধের রাজনীতিকে মোটাদাগে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বলে আখ্যায়িত করে দুর্বল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রকারান্তরে নিজেদের অজান্তেই শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এবার গতানুগতিক বিভাজনের ভোটের হিসাব করে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও রাজনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমানের রাজনীতিকে পরিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিতে না পারলেও তিনি পথভ্রষ্ট হননি। জিয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকাই হচ্ছে বিএনপির জনভিত্তি এবং রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার প্রধান শর্ত।

বাকশাল গঠন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ করে দেয়ার আগে কোনো রকম পাবলিক কনসেনশাস ছাড়াই বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা আরোপ করে স্বাধীনতার চেতনা ও জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সিপাহী জনতার অভিপ্রায়ে বন্দি জিয়াউর রহমান জাতির মুক্তির কান্ডারি ও অবিসম্বাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর উত্থান খৃষ্টপূর্ব যুগে জুলিয়াস সিজারের ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম (ভিনি, ভিডি ভিসি) এর মত সহজসাধ্য ছিল না। তিনি দেশের জন্য বারবার জীবন বাজি রেখে ইতিহাসের চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে দেশকে নতুন পৃথিবীর সম্ভাবনার কক্ষপথে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শূন্যতাকে অভিষ্ঠ প্রত্যাশায় ভরিয়ে তুলতে প্রকৃতিতে বিকল্প শক্তি সদা ক্রিয়াশীল। আওয়ামী রাজনীতির আত্মহনণের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তরে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, বীর মুক্তিযোদ্ধা (বীরোত্তম) জিয়াউর রহমানের জাগদল গঠন থেকে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে উত্তরণ ঘটার আগেই তার রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। আজকের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় জিয়ার ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বাংলাদেশের জন্য অলঙ্ঘনীয় বলে গণ্য করা যায়। ক্রমানুসারে ঊনিশ দফার ধারাগুলো হচ্ছে-(১) সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা,(২) শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা,(৩)সর্ব উপায়ে নিজেদের একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা .. এভাবে জিয়ার ১৯ দফার প্রতিটি দফাই একটা সর্বকালীন ও সার্বজনীন রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মত। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান একদশক বেঁচে থাকতে পারলে এদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভিত্তিতে কোনো পরাশক্তিও টলাতে পারতো না। তবে আধিপত্যবাদী শক্তির সব ষড়যন্ত্রের ন্যারেটিভ উল্টে দিয়েই এ দেশের ছাত্র-জনতা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনার পথ নির্মাণ করেছে। এ পথ জিয়ার দেখানো ঐক্যের পথ। যেখানে এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে ধারণ করে ডান-বাম-মধ্যপন্থার সম্মিলণে এক মহান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী শক্তির উন্মেষ ঘটেছিল। পঞ্চাশ বছর ধরে আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা ইতিহাসের ন্যারেটিভ জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তি ও লিগ্যাসিকে ধসাতে পারেনি। ভেতর থেকে বিভাজিত করে জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা গেলেই শুধু বিএনপি’র লিগ্যাসিকে আওয়ামী লীগের মত অসার করে দেয়া সম্ভব। পুরনো আওয়ামী লীগাররা বিএনপিতে ঢুকে সেই বিভাজনের আশ্রয় নিয়ে ভুল ন্যারেটিভের ফাঁদে ফেলে বিএনপির জনমতকে বিভ্রান্ত করছে বলে সংশয় প্রকাশের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রাষ্ট্র মেরামাতের যৌক্তিক দাবিকে সামনে রেখে ২০২২ সালে তারেক রহমান ৩১ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, জিয়ার ১৯ দফা মনে রেখে তার সফল বাস্তবায়নই হচ্ছে এ মুহূর্তে দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ঊনিশ দফা ভুলে গিয়ে ৩১ দফা বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। জিয়া আওয়ামী লীগ, বাকশাল, ন্যাপ (ভাসানী), জাসদ, মুসলিম লীগের রাজনীতিকে অকার্যকর করে দিয়ে বিএনপিতে এসব রাজনৈতিক মতাদর্শের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি রাজনীতিকে কঠিন করে দেবেন। অর্থাৎ তিনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও ড্রয়িং রুমের রাজনীতি বাতিল করে নিজের কর্মসূচি মাঠে ময়দানে ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। জিয়ার রাজনীতিতে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, চাপাবাজি, পেশিশক্তি ও আধিপত্যের কোনো স্থান ছিল না। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতাকর্মীদের জিয়ার ১৯ দফা ও জুলাই সনদের অঙ্গীকার মনে রেখে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার শপথ নিতে হবে। বিএনপি পথ হারালে দেশ ও জাতি আবারো পথভ্রষ্ট হবে।

[email protected]

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *