জুলাইয়ের দিনলিপি শিল্পীদের ‘দ্রোহযাত্রা’, ৩ আগস্ট বিক্ষোভ, ৪ আগস্ট থেকে ‘অসহযোগ’ ঘোষণা

Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা: ২০২৪ সালের ২ আগস্ট। আকাশ মেঘলা। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় জড়ো হচ্ছেন হাজারো মানুষ। মুখে প্রতিবাদের স্লোগান, হাতে প্ল্যাকার্ড— ‘গুলিতে মরতে পারি, পিছু হটব না।’ রক্তের দাগ না শুকাতেই ফের উত্তাল বাংলাদেশ। সহিংসতার বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, আর একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্নে ফের একবার রাজপথে নেমে এলো ছাত্র-নাগরিক ও শিক্ষকরা।

আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন ঘোষণা

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের শীর্ষ তিন সমন্বয়ক মাহিন সরকার, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও আব্দুল হান্নান মাসউদ রাতে তিনটি পৃথক মাধ্যমে ৩ আগস্ট দেশব্যাপী বিক্ষোভ এবং ৪ আগস্ট থেকে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। মাহিন ও আসিফ হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান, আর হান্নান মাসউদ ফেসবুক লাইভে এসে জনগণকে আহ্বান জানান, ‘কেউ ট্যাক্স দেবেন না, গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের বিল দেবেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন ও রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। সরকারকে কেউ যেন কোনো সহযোগিতা না করে। দেশের জনগণকে এমনভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে সরকার স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে না পারে।’ তাদের ভাষায়, এ ছিল ‘নতুন এক অসহযোগ।

এই ঘোষণার পেছনে ছিল দীর্ঘ এক সপ্তাহের তিক্ত অভিজ্ঞতা। আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সজীব ভূঁইয়া, নুসরাত তাবাসসুম ও আবু বকর মজুমদার ১ আগস্ট মুক্তি পাওয়ার পর তারা জানান, ডিবি কার্যালয়ে তারা অনশনরত অবস্থায় ছিলেন। জোর করে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা, পরিবারকে না জানিয়ে আটক রাখা এবং আন্দোলন প্রত্যাহারের ভুয়া বিবৃতি তাদের আত্মসম্মানে গভীর আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। এর পর বের হয়ে এসে তারা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তাদের দাবি— এটি বেআইনি, অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের অংশ।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজপথে জনস্রোত

২ আগস্টের সকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় বিক্ষোভ। দুপুরের বৃষ্টিও দমিয়ে রাখতে পারেনি জনতার ঢল। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত চলে এক ‘দ্রোহযাত্রা।’ যে যাত্রায় শিক্ষক, ছাত্র, শিল্পী, অভিভাবক সবাই ছিলেন এক কাতারে। এই ‘দ্রোহযাত্রায়’ বক্তব্য দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তার বক্তৃতায় উঠে আসে সরাসরি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন— ‘এই সরকার ছাত্রদের রক্তে হাত রঞ্জিত করেছে। তাদের পদত্যাগ ছাড়া উপায় নেই।’

‘দ্রোহযাত্রা’র পথ জুড়ে ছিল ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই’ স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড। এদিন বক্তারা ৩ আগস্ট বিকেল ৩ টায় নতুন করে গণমিছিলের ডাক দেন।

‘পোয়েটস অ্যান্ড রাইটারস’ ও ‘প্রতিবাদ মঞ্চ’র কর্মসূচি, ব্র্যাকের ৬২৬ শিক্ষকের সংহতি

এদিন ‘পোয়েটস অ্যান্ড রাইটারস অ্যাগেইনস্ট কান্ট্রিওয়াইড অ্যারেস্টস অ্যান্ড অপ্রেশন’ ব্যানারে শহরের নগর পরিকল্পনাবিদ, লেখক, কবি ও প্রকাশক এবং ‘প্রতিবাদ মঞ্চ’ ব্যানারে কিছু শিক্ষক ও অধিকারকর্মী, চিকিৎসক এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীও রাজধানীতে আলাদা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এছাড়াও এদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬২৬ জন শিক্ষক চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।

সংঘর্ষে ছড়ায় প্রান্তিক শহরগুলোতেও

এদিন হবিগঞ্জ, খুলনা, সিলেট, নরসিংদী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইলসহ অন্তত ১০টি জেলায় সংঘর্ষ হয়। হবিগঞ্জে এক শ্রমিক, খুলনায় এক কনস্টেবল নিহত হন। ঢাকার উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে তিনজন রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হন। গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসে, আওয়ামী লীগের কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করলে পালটা প্রতিরোধ থেকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়।

শিশুদের মৃত্যু ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা

দ্য ডেইলি স্টার ও ইউনিসেফের রিপোর্ট এক গভীর সংকেত দেয়। শুধু জুলাই মাসেই অন্তত ৩২ শিশু নিহত— এমনটাই জানায় ইউনিসেফ। এ ছাড়া, ২০০ জনেরও বেশি নিহত, হাজার হাজার গ্রেফতার। ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক পরিচালক সঞ্জয় উইজেসেকেরা বলেন, ‘এটি ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়। শিশুরা কোনো আন্দোলনের ‘কোল্যাটারাল’ হতে পারে না।

চিরুনি অভিযানে ‘দমনযন্ত্র’ চালু

১৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সহিংসতা ২১ জুলাইয়ের পর আরও ঘনীভূত হয়। সরকার এক সপ্তাহের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করে। অধিকাংশই ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ঢাকার মানুষ ফিসফিস করে বলে, ‘গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হলো এবার।’

ক্ষমতাসীনদের দাবি— এগুলো ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘চক্রান্ত’

সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে ‘চক্রান্ত’ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ছাত্রদের দাবি মেনে নেওয়ার পরেও একটি চক্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য সরকারের পতন ঘটানো।’

তবে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ছিল একরোখা— ‘আমরা ন্যায়বিচার ছাড়া ঘরে ফিরব না।’

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *