Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment
ঢাকা: ২০২৪ সালের ২৮ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন সমন্বয়ক নুসরাতকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর পর ডিবি অফিসে সমন্বয়কদের অস্ত্রের মুখে দাঁড় করিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ায়।
জুলাইয়ের শেষপ্রান্তে আন্দোলনকারীরা যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গণগ্রেফতার আর ক্ষমতাসীন দলের হামলার মুখে ছত্রভঙ্গ, তখনও থেমে থাকেনি প্রতিবাদ, সাহস হারায়নি তারা। বড় মিছিল-সমাবেশের পরিবর্তে তারা বেছে নেয় এক নিঃশব্দ অথচ দৃশ্যমান বিদ্রোহ। হাতে উঠে আসে রং তুলি। কিন্তু তখনও চলছে গণগ্রেফতার।
নুসরাতকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ
এদিন সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম মুখ নুসরাত তাবাসসুমকে মিরপুরের রূপনগরের একটি বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। এর পর একে একে ডিবির হেফাজতে নেওয়া হয় আরও ছয় সমন্বয়ককে।
সেদিন রাত ৯টায় গণমাধ্যমে আসে একটি ভিডিও বার্তা। দৃশ্যপটে— ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়। সেখানে বসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম লিখিত বক্তব্য পাঠ করছেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের প্রধান দাবি মেনে নিয়েছে। শিক্ষার স্বার্থে আমরা সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।’
তবে এই ভিডিও ক্লিপ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে। মুখে চাপা উদ্বেগ, পাশে বসে থাকা পুলিশের উপস্থিতি এবং বার্তার ভাষার কৃত্রিমতা লক্ষ্য করেন অনেকে। পরদিন মধ্যরাতে আরেকটি বার্তায় আন্দোলনের অন্য তিন সমন্বয়ক— মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের ও আব্দুল হান্নান মাসউদ জানান, ওই বার্তা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। বরং, অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আদায় করা হয়েছে। মাহিন সরাসরি বলেন, ‘ডিবি অফিস কখনোই ছাত্রদের সংবাদ সম্মেলনের জায়গা নয়।
নিরাপত্তাহীনতার অজুহাত, নাকি ভয় দেখানো
গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক উপকমিশনার হারুন অর রশীদ পরে ফেসবুকে লেখেন, ‘সমন্বয়কারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই তাদের কথা শুনেছি, খাবার খাইয়েছি।’ তার ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে যুক্ত ছবিতে দেখা যায়, সমন্বয়কারীরা ডিবি কার্যালয়ে টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক দৃশ্য হলেও আন্দোলনকারীদের ভাষায় এটি ছিল ‘প্রোপাগান্ডা।’ প্রত্যুত্তরে সমন্বয়কারীরা বলেন, এটি একধরনের ‘স্টেজড প্রোপাগান্ডা’— যা মূলত দেশের ছাত্র সমাজের প্রতিবাদের ধারাকে হাইজ্যাক করার প্রচেষ্টা।
দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আন্দোলন
এদিন বিকেল থেকে শহরের অলিগলিতে শুরু হয় এক অভিনব প্রচেষ্টা। প্রথম ফেনী শহরের তাকিয়া রোডসংলগ্ন পানির ট্যাংকি রোডে ১০-১২ জন তরুণ-তরুণী হাতে রংতুলি আর স্প্রে নিয়ে দেয়ালে আঁকতে থাকেন প্রতিবাদ চিত্র।
প্রথমবারের মতো দেয়ালে আঁকা হয় সাহসী বাক্য: ‘শিক্ষা-ছাত্রলীগ, এক সঙ্গে চলে না।’ এটা শুধু রাজনৈতিক মন্তব্য নয়, এটি ছিল এক গহীন যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিনের দখলদারিত্ব আর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এক চিত্রকথন।
দেয়ালে দেয়ালে প্রতিবাদের ক্যানভাস
শহরের ফেনী সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণ, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়ক, ডাক্তার পাড়া, কলেজ রোড, মাস্টার পাড়া, রাজাঝির দিঘীর পাড়, মুক্তবাজারসহ নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এই চিত্রযুদ্ধ। দেয়ালে ফুটে ওঠে আন্দোলনের স্লোগান, হতাহতদের স্মৃতি, স্বপ্ন ও প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিটি গ্রাফিতি যেন একটি করে ইতিহাস।
দেয়ালে দেখা যায়— ‘৩৬ শে জুলাই’, ‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা’, ‘ভয়ের দেয়াল ভাঙলো, এবার জোয়ার এলো ছাত্র-জনতার’, ‘রক্তাক্ত জুলাই ২০২৪’, ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’, ‘পলকে পলকে ইন্টারনেট শেষ’, ‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনব’— এই সমস্ত বাক্য শুধু দেয়াল নয়, মানুষের হৃদয়েও জায়গা করে নেয়।
সবচেয়ে আলোড়ন তোলে অদম্য এক তরুণের ছবি। বুক চিতিয়ে গুলির সামনে দাঁড়ানো আবু সাঈদের রক্তাক্ত প্রতিকৃতি হয়ে ওঠে শহরের দেয়ালজুড়ে এক প্রতীক, এক প্রতিরোধের মূর্ত প্রতিচ্ছবি।
শিল্প যখন হয়ে ওঠে অস্ত্র
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এর আগে গ্রাফিতি কখনো সরব হয়ে উঠে আসেনি। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই বিদ্রোহে এই ‘নীরব চিত্র’ হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের স্লোগান। প্রতিটি তুলির টানে ফুটে উঠেছিল ছাত্রদের ক্ষোভ, স্বপ্ন আর অঙ্গীকার। এই দেয়ালগুলো আজ শুধুই দেয়াল নয়— এগুলো আন্দোলনের স্মৃতিফলক, তারুণ্যের কণ্ঠস্বর, একটি জাতির ট্রমা ও প্রত্যয়ের প্রকাশ।
গোপন যোগাযোগে টিকে থাকে প্রতিবাদের শিখা
জুলাইয়ের শেষ দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গণগ্রেফতার ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া আন্দোলনকারীরা একে অন্যের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলনকে গতিশীল করার চেষ্টা করে। মিছিল-সমাবেশের পরিবর্তে আরেক শক্তিশালী প্রতিবাদের পথ বেছে নেয় আন্দোলনকারীরা।
শেখ হাসিনার মায়াকান্না!
এদিন সকালে ঢাকার গণভবনে যেন এক ব্যতিক্রমী মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সহিংসতায় নিহত হওয়া ৩৩ শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী, শহিদ ছাত্রনেতা আবু সাঈদের পরিবারও। সেখানেও শেখ হাসিনা কেঁদে বলেন- ‘আমাকে দেখেন, আমি অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি।’ আবারও সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড়। মায়াকান্নার রাজনীতি করছেন শেখ হাসিনা।
নিপীড়নের মুখেও প্রতিরোধ
যেখানে আন্দোলনের মুখ্য নেতা আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ মৃত্যু এখনো ধোঁয়াশায় মোড়া, সেখানে এই ধরনের জোরপূর্বক বার্তা ছাত্রদের ক্ষোভে ঘি ঢালে। মধ্যরাতে ঘোষণা আসে- সারা দেশে আটটি পয়েন্টে প্রতিবাদ কর্মসূচি হবে। ঢাকার সায়েন্স ল্যাব, জাতীয় প্রেসক্লাব, মিরপুর, রামপুরা, উত্তরায় বিক্ষোভের ডাক দেয় মুক্ত থাকা সমন্বয়কারীরা।
কে দিচ্ছেন কণ্ঠ?
এই পর্যায়ে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে— কে আসলে এই আন্দোলনের কণ্ঠ? যারা ডিবির হেফাজতে একটি স্ক্রিপ্ট পড়ছে, না কি যারা রাস্তার উপর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয় উপেক্ষা করেও বলছে, ‘আমরা হারিনি?