জুলাই আন্দোলনে আগুন জ্বালানো সেই ঘোষণা

Google Alert – সশস্ত্র

ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্যে প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করে ২০০৮ সালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ভারত তার অভিলাষ কায়েম করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। হাসিনা এক এক করে ভারতের প্রতিটি চাহিদা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার হীন উদ্দেশ্যে ভারতীয় পরিকল্পনায় এক এক করে দেশপ্রেমিক ও ইসলামপন্থিদের প্রশাসন ও সব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিয়ে সংখ্যালঘু ও দলীয় অযোগ্য ক্যাডার বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। গুম, খুন, লুটপাট করে দেশকে চিরতরে ভারতের গোলাম বানিয়ে দেশটাকে করদ রাজ্যে পরিণত করা হয়। সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীকে জেনারেল তারেক সিদ্দিকের মাধ্যমে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়। পুলিশ ও লীগের সব অঙ্গ সংগঠন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, পরিণত হয় সন্ত্রাসী বাহিনীতে। তারা দিনে বা রাতে ফ্যাসিস্টবিরোধী জনগণকে নির্মমভাবে হত্যা করা শুরু করে। জঙ্গি নাটকের মাধ্যমে মানুষকে গুম-খুন অব্যাহত থাকে। জামায়াত-শিবির আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার ও হত্যা করা যেন আইনি বৈধতা লাভ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয় কসাইখানায়। মহিলা হলগুলো পরিণত হয় লীগের নেতাদের লীলাকেন্দ্রে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করে বিদেশে টাকা পাঠায় লীগের নেতারা। জাতীয় সংসদ রূপান্তরিত হয় ভাঁড়দের আড্ডাখানায়। প্রশাসনকে সাজানো হয় লীগ ক্যাডারদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে। বিচার বিভাগ পরিণত হয় লীগ বিভাগ হিসাবে; যখন যাকে ইচ্ছা যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান হাসিনার ইচ্ছায় পরিণত হয়। পুরো দেশটি পরিণত হয় এক জ্বলন্ত শ্মশানে। এ অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কাজ শুরু করে সচেতন জনগণ। আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে ফ্যাসিস্টবিরোধী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের একত্রিত করে মিডিয়ার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্বার গণ-আন্দোলন শুরু করি।

এ আন্দোলনে নৃশংস পুলিশ যখন নিষ্ঠুর ও নির্মম কায়দায় নিরীহ নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সামরিক বাহিনী নামানো হলো হাসিনার নির্দেশে; দেশের সবখানে যখন চলছে লীগ নামক গুন্ডাবাহিনীর নির্মমতা, ঠিক সে সময় সামরিক বাহিনীর অকুতোভয় নির্ভীক দেশপ্রেমিক কিছু অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে আমি ২ আগস্ট ২০২৪ যে ঘোষণাটি পাঠ করি, তা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। সামরিক বাহিনী ঘুরে দাঁড়ায় মাফিয়া হাসিনার বিরুদ্ধে এবং অর্জিত হয় তৃতীয় স্বাধীনতা। সেই ঘোষণাটি ছিল নিুরূপ :

‘দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আমরা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যরা গভীরভাবে মর্মাহত ও হতাশ। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটা নীতি বাতিলের ন্যায্য দাবি নিয়ে গত ১ জুলাই থেকে কোমলমতি, নিরীহ, নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করলে দেশের অসংখ্য মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, সরকার তাদের সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা না করে এ আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য হিংস্র রক্তাক্ত পথ বেছে নেয়। প্রথমে ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সশস্ত্র গুন্ডা বাহিনীকে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর লেলিয়ে দেয়। তাদের বর্বরোচিত আক্রমণে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং অসংখ্য আন্দোলনকারীকে গুরুতর আহত ও গুম করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতিহত করতে বর্বর বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত বিজিবি, র‌্যাব, আনসার ও পুলিশের নির্বিচার আক্রমণ; ব্যবহার করা হয় হেলিকপ্টার ও স্লাইপার, যা যুদ্ধক্ষেত্রেও সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। এ আক্রমণ এতটাই বর্বর ও নৃশংস ছিল যে, হত্যার শিকার প্রতিটি মানুষের শরীর বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে যায়, অন্ধ করা হয় বহু ব্যক্তিকে।

এমনকি আক্রমণকারীরা হাসপাতালে গিয়েও গুরুতর আহতদের ওপর নির্মম আক্রমণ চালায় এবং চিকিৎসাবঞ্চিত করে, যা কোনো সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না। নির্লজ্জতা ও নির্মমতার এখানেই শেষ নয়; আন্দোলন দমানোর জন্য সরকার কারফিউ জারি করে দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নামায় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে। লক্ষ করলাম, জাতিসংঘ মিশনে ব্যবহৃত এপিসি ও অন্যান্য অস্ত্র-সরঞ্জামাদিও ব্যবহার করা হয় শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বিরুদ্ধে। অতিউৎসাহী কিছু অফিসার বিবেক বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনরত মানুষের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে বার্স্ট ফায়ার করে, যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত গৌরব ধূলিসাৎ হয়ে যায় এর মাধ্যমে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের গৌরব আমাদের এ প্রাণের সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বর্তমান প্রজন্ম আমাদের অনুজ, আমাদের ছোট ভাইবোন ও সন্তান। তারা ইউনিফর্ম পরিধান করে বিধায় অনেক কিছুই খোলাখুলি বলতে পারে না। তাই অগ্রজ হিসাবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাদের গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা।

সুতরাং আমরা জনগণের বিরুদ্ধে এসব হীন কাজ থেকে সামরিক বাহিনীকে বিরত রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই। এত অল্পসময়ে নিজ দেশের মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় অর্থে লালিত বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিশাল এ হতাহতের নজির বিগত একশ বছরের ইতিহাসে এ দেশে তো বটেই, বিশ্বের কোথাও মিলবে না। এমন হত্যাকাণ্ডের নিন্দা বা ধিক্কার ও প্রতিবাদের উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। বিপুল এ প্রাণহানির দায় অবশ্যই সরকারের। সাংবিধানিক শপথ ও আইন উপেক্ষা করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী প্রকাশ্যে চরম উসকানিমূলক দায়িত্বহীন ভাষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর তাদের লালিত গুন্ডাবাহিনীকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দিলেন, এতে আমরা, সমগ্র জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হতবাক, স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও গভীরভাবে মর্মাহত। রাষ্ট্র যখন আক্রমণকারী হয়, জনগণ বিচার চাইবে কার কাছে।

আমরা মনে করি, সংবিধান অনুযায়ী বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু তা কোনোক্রমেই দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী হওয়া কাম্য নয় এবং যতক্ষণ সে দায়িত্ব জনবিরোধী পর্যায়ে না পড়ে শুধু ততক্ষণ সে দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। কিন্তু জনবিরোধী হওয়ার উপক্রম হলেই তা থেকে বিরত হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। এ বাহিনীর সব সদস্য এ দেশের সাধারণ জনগণেরই অংশ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ তথা দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ সেই নিরিখে অবৈধ ও জনবিরোধী। এমনকি যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে তাদের নিয়োজিত করা হয়েছে, সে সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি ও একই সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধ।

বর্ণিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি, অবিলম্বে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে এ নিষ্ঠুর অপারেশন থেকে প্রত্যাহার করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হোক। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সব অফিসার ও সৈনিকদের উল্লিখিত কার্যকলাপে বিরত থেকে সংবিধানের মূল দাবি অনুযায়ী জনগণের পাশে থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, এখনো সময় আছে সামরিক বাহিনীর ঘুরে দাঁড়িয়ে এ কলঙ্ক মুছে দেওয়ার। একই সঙ্গে গণহত্যায় জড়িত পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও গুন্ডাবাহিনীর সদস্যদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করি, জনগণ এখনো সামরিক বাহিনীকে তাদের আশা ও ভরসাস্থল হিসাবে বিবেচনা করে। সামরিক বাহিনী সদাচরণশীল হলে জনগণের সে আস্থা আবার ফিরে আসবে। তবে তা হতে হবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই। সে নিশ্চয়তা আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে দিতে পারি। আমরা মনে করি, দেশের মালিক জনগণ, কোনো ব্যক্তি নয়। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন।’

এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। প্রবাসী সাংবাদিক কনক সারওয়ার ফোন করে এটি প্রচারের অনুমতি চান। আমি সানন্দে সম্মতি দিলে সেটি তিনি তার চ্যানেলের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এর ফলে চারদিকে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। ওইদিন বিকালে সব সহযোদ্ধা অফিসার নিয়ে মিরপুর ডিওএইচএসের ভেতরে মিছিল বের করি। এই মিছিলে ছাত্রছাত্রী, জনসাধারণ, অসংখ্য অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও তাদের পরিবার-পরিজন অংশগ্রহণ করেন। এখানে বক্তব্য দিয়ে সবাইকে উজ্জীবিত করি, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয় আসে ৫ আগস্ট ২০২৪। ছাত্র-জনতার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যে সমর্থন ও সহযোগিতা সেটিই এ আন্দোলনকে সফলতার মুখ দেখায়। যারা বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের মুক্তি, এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রেখেছেন, তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞতা ও দোয়া করছি। আল্লাহপাক দেশমাতৃকার জন্য তাদের এ আত্মত্যাগ ও শাহাদত কবুল করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। সবার ওপরে যিনি, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই। জুলাই ও আগস্ট বিপ্লব ২০২৪-এর বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনমুক্ত বাংলাদেশে সবাই সত্যিকার স্বাধীনতা ও নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছি।

কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি : কলামিস্ট, রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক

hoque2515@gmail.com

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *