Bangla Tribune
২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক সহিংসতা। তার আগে আন্দোলন দমনে পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছিল মানুষ। এরই প্রতিক্রিয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলাসহ প্রায় ৫০০টিরও বেশি থানা ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, জুলাই ও আগস্টের সহিংসতায় অন্তত ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। তাদের মধ্যে ৫ আগস্ট একদিনে নিহত হন ২৫ জন। আর জুলাই-আগস্টজুড়ে আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার। এসময় বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ৫ হাজার ৭৫৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৭ হাজার ২৬২টি গোলাবারুদ লুট করা হয়। এছাড়া ৩২ হাজার ৫টি টিয়ার গ্যাসের শেল, ১ হাজার ৪৫৫ টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড, ৪ হাজার ৬৯২ সাউন্ড গ্রেনেড, ২৯০ স্মোক গ্রেনেড, ৫৫ স্টান গ্রেনেড, ৮৯৩ মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড এবং ১৭৭টি টিয়ার গ্যাস স্প্রে লুট হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, জুলাই আন্দোলনে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে এখনও এক হাজার ৩৬৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। অপরদিকে ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ গোলাবারুদের মধ্যে উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭২০টি। গত ৬ আগস্ট পর্যন্ত এ তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রমতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও থানার বাইরে থাকা পুলিশের ওপর সংঘবদ্ধ হামলা করে ভিক্ষুদ্ধ জনতা। এদিন যাত্রাবাড়ী থানায় চার পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যাসহ থানা ভবনে আগুন দেওয়া হয়। কনস্টেবল আব্দুল মজিদকে থানার ভেতরে ঢুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী শাহজাদী বেগম গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে একই থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়। জানা গেছে, এসব মামলার তদন্তে কোনও অগ্রগতি নেই। যদিও যাত্রাবাড়ী থানার ওসি ফারুক আহমেদ বলেছেন, মামলার তদন্ত চলছে, কিন্তু এখনও কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে নিহত পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল মজিদের স্ত্রী শাহজাদী বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “পুলিশ ভাইয়েরা মারা গেলেও তাদের নিয়ে কোনও খবর হয় না। আমার স্বামী আন্দোলনে অংশ নেননি। থানা ভবনের ভেতরেই তাকে হত্যা করা হয়।”
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ওসিসহ ১৫ জনকে হত্যা
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় উত্তেজিত জনতা হামলা চালিয়ে থানার ওসিসহ ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ওই বছরের ২৭ আগস্ট থানার এসআই আব্দুল মালেক বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে আরও পাঁচ থেকে ছয় হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
ওই মামলাটির তদন্ত এখনও শেষ হয়নি বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন এনায়েতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, “এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে নিহত কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ময়নাতদন্ত ও বিস্ফোরক পরীক্ষার প্রতিবেদন আসেনি। ফলে তদন্ত শেষ করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।”
ব্যারাকে লুটপাট ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি
৫ আগস্ট থানাগুলোতে হামলার পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন ব্যারাকেও হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। রাজধানীর আদাবর থানার ব্যারাকে থাকতেন এসআই রফিকুল ইসলাম ও আনিসুর রহমান। একজনের দুই মাসের বেতনের টাকা, অন্যজনের বাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া পাঁচ লাখ টাকা লুট হয়ে যায়। ব্যারাকে থাকা শতাধিক পুলিশ সদস্যের টাকা, মোবাইল, ল্যাপটপসহ মূল্যবান জিনিসপত্রও লুট করে দুর্বৃত্তরা।
হাজারীবাগ থানায় এসআই ওয়াহিদের নতুন কেনা অ্যাপাচি ফোরভি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে ফেলা হয়। ব্যারাক থেকে পুলিশ সদস্যদের ট্রাংক, টাকা, ফোন সব নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার পুলিশ কোয়ার্টারেও লুটপাট হয়, পুলিশ পরিবারের সদস্যদের স্বর্ণালঙ্কার, টাকা এমনকি আসবাবপত্রও লুট করা হয়।
বিক্ষোভের সময় সরকারি স্থাপনার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত ক্ষতির কোনও তালিকা বা ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ সদর দফতর, কিংবা সরকার। ব্যারাক, কোয়ার্টার ও ব্যক্তিগত যানবাহনে হামলা, লুটপাট ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটলেও তার কোনও আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন হয়নি।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, গত এক বছরেও ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরির জন্য কোনও নির্দেশনা আসেনি। আবার কেউ কেউ বলছেন, সদর দফতর থেকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে উদ্যোগ না নিলে তারা নিজেরা ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ পাবেন না।
নিহত ৪৪ জনের ২১ জনই কনস্টেবল
শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই পুলিশ ওপর হামলার শিকার হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা অনেকেই প্রাণ ভয়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মপোগনে ছিলেন।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২০ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪ আগস্ট ১৫ জন ও ৫ আগস্ট নিহত হয়েছেন ২৫ জন। এছাড়া ২০ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ জন, ২১ জুলাই ১ জন এবং ১৪ আগস্ট ১ জন পুলিশ সদস্য মারা যান।
নিহতদের মধ্যে ২১ জন কনস্টেবল ছিলেন।এছাড়া ১১ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই), ৮ জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), ৩ জন পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) এবং ১ জন নায়েক পুলিশ সদস্য।
তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় ধীরগতি
জুলাই-আগস্টের ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে শতাধিক মামলা হলেও কোনও মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। অনেক ঘটনায় চার্জশিট দাখিল তো দূরের কথা, প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনও জমা পড়েনি। এমনকি কিছু মামলার ময়নাতদন্ত, ফরেনসিক ও বিস্ফোরক পরীক্ষার প্রতিবেদন আসেনি, ফলে বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, মামলাগুলোতে আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং আসামিরা অজ্ঞাত থাকায় গ্রেফতার বা সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে সময় লাগছে।
এদিকে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবার ও সহকর্মীদের অভিযোগ, তদন্তে গতি না থাকায় বিচারপ্রক্রিয়া থমকে আছে। কিছু কিছু ঘটনায় পরিবার নিজে থেকেই মামলা করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্ট থানা সময় মতো মামলা নেয়নি বা নিতে চায়নি। অনেক মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এখনও এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে—যা তদন্ত ও সাক্ষ্যগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের ভেতরেও তদন্তের তদারকি ও সমন্বয়ের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।
ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় হতাশা
ব্যক্তিগত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্যদের অনেকেই হতাশ। তারা বলছেন, নিজ উদ্যোগে সদর দফতরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদনও করতে পারেননি। সরকার যদি উদ্যোগ না নেয়, তাহলে তারা এসব ক্ষতির জন্য কোনও প্রতিকার পাবেন না বলেও তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া ও পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন জানান, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বিভিন্ন থানা ও পুলিশের স্থাপনা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের বেশিরভাগই উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় করা মামলাগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।