Google Alert – আর্মি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের প্রভাবে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। বেড়েছে চোরাচালান, পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার থেকে আসছে না কোন পণ্যবাহী ট্রলার। যার ফলে হতাশায় দিন কাটাচ্ছে ব্যবসায়ী, শ্রমিকেরা। কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, বিপাকে টেকনাফের অর্থনীতি। কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। এখন আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় সীমান্তে ৩৯টি চোরাই পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার মালামাল। তাতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন শতাধিক আমদানি-রপ্তানিকারক।
জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থেকে শেষবারের মতো মালবাহী ট্রলার এসেছিল মাস তিনেক আগে। তখন থেকে বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। এদিকে আরাকান আর্মি ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিবন্ধকতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্যবাহী ট্রলার আসছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের প্রভাব পড়েছে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যে।সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যে জান্তার বিরুদ্ধে কয়েকবছর ধরে লড়ছে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠি আরাকান আর্মি। তুমুলভাবে অভ্যন্তরীণ সংঘাত চললেও টেকনাফ স্থলবন্দরের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত বাণিজ্যে তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। ফলে যুদ্ধ এড়িয়ে বেশ ভালোই যাচ্ছিলো দু’দেশের বাণিজ্য। কিন্তু জেলায় জেলায় জান্তাকে পরাজিত করে রাখাইনে আরাকান আর্মি যতই সফলতার দিকে যাচ্ছে ততই সীমান্ত বাণিজ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করে। সর্বশেষ গত ৩ মাসে এই বন্দরের আমদানি-রপ্তানী প্রায় শূন্যের কোটায়।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ বন্দর চালু হওয়ার পর থেকে মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছে সরকার। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারও ব্যবসায়ী-শ্রমিকের। দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছিল অর্জিত রাজস্ব।
বিগত ১৬ বছর আওয়ামী ফ্যাসিস্টের আমলে টেকনাফ স্থলবন্দরকে নিজেদের ভোগবিলাসের আস্তানা বানিয়েছিল সাবেক এমপি আব্দুররহমান বদি ও তার সঙ্গপাঙ্গরা। এখন মিয়ানমার আরাকান আর্মি বৈধ বাণিজ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অনেকটা মাদক ও চোরাচালের দিকে হেলে পড়েছে।
জানা যায়, বন্দরে গুদাম ভর্তি রপ্তানিযোগ্য কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও মজুররা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন যাপন করছে। অনেকেই নানা অপকর্মে জড়িয়ে অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে।
আরও জানা যায়, আরাকান আর্মির কারণে নাফ নদ ও সাগরে মাছ আহরণ প্রায় অনিশ্চয়তার মধ্যে। গত ১২ আগস্ট মাছ আহরণ করতে গেলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আরাকান আর্মি ৫ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এ ছাড়া আরাকান আর্মি গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ২১১ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় কয়েক দফায় ১৮৯জন জেলে এবং ২৭টি ট্রলার ও নৌকা ফেরত আনা হয়েছে।
আব্দুল আমিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দরে দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক রয়েছে, যারা পণ্য উঠানামায় ব্যস্ত সময় পার করতো। কিন্তু এখন সুনশান নিরবতা। দেখে মনে হবে যেনো কোথাও কেউ নেই। আমদানি-রপ্তানি না থাকায় দুর্ভিক্ষ পার করছে শ্রমিকেরা।
শ্রমিকদের মাঝি নামে পরিচিত লালু মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন বন্দর বন্ধ থাকায় আমাদের শ্রমিকরা বেকার বসে আছে। অনেকের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চড়া দাম, অন্যদিকে বন্দর বন্ধ থাকায় কোন কাজকর্ম নেই। তাই আয় রোজগারও নেই।
কাঠ ব্যবসায়ী কমিটির সহসভাপতি জসিম উদ্দিনের কাছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্দর অচল হয়ে পড়েছে। কোন প্রকার মালামাল মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে না। কারণ, মিয়ানমারে দুইটা গ্রুপ সৃষ্টি হওয়ায় কোন মালামালের ট্রলার আসলে একদিকে আরাকান আর্মি আরেক দিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে ট্যাক্স দিয়ে আসতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ বন্দরেও রাজস্ব দিতে হয়, যার কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য অনেকটাই অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ী ও টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান জিহাদ বলেন, সমুদ্রের সেন্টমার্টিনের অংশ থেকে নাফনদীর দীর্ঘ অংশ ভরাট হয়ে গেছে। যেকারণে মিয়ানমার থেকে পণ্যবাহী জাহাজগুলো আসার পথে মিয়ানমার সীমানা ঘেঁষে আসতে হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরাকান আর্মি জাহাজগুলো আটকে দেয়। মূলত আরাকান আর্মির বাঁধার মুখে ইয়াংগুন থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসতে পারেনা। ফলে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ এই বন্দরে। ভরাট হয়ে যাওয়া অংশটুকু খননের ব্যবস্থা করলে সীমান্ত বাণিজ্যে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিদিন এই বন্দরে ৫০ থেকে ৬০টি জাহাজ আসতো। ২০০ থেকে ৩০০ ট্রাক মালামাল বের হতো। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ থেকেও যেতো। কিন্তু সেটি এখন আর হচ্ছে না। যার ফলে ব্যবসায়ী, শ্রমিক, রাজস্ব আয় সবখাতে হাহাকার বিরাজ করছে। আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা মিয়ানমারে বিনিয়োগ করা আছে। সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে পথে বসতে হবে আমাদের।
টেকনাফ স্থলবন্দরের কাস্টমস অফিসার মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও রাখাইন আর্মিদের মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার কারণে, এ অঞ্চল দখল হওয়ার পর থেকে আর কোন পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে আসেনি। ফলে বন্দরের কার্যক্রম একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানির মত গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চলে।
তিনি আরও বলেন, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ১ লক্ষ ২৮ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানী হয়েছিলা যেখানে রাজস্ব আয় হয় ৬৪০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৬৮ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয় যেখানে রাজস্ব আয় হয় ৪০৪ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে আমদানি হয়েছে মাত্র ১১ হাজার মেট্রিক টন, যেখানে রাজস্ব আয় হয়েছে ৮৭ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে চালু হওয়া টেকনাফ স্থলবন্দর বিগত দিনে এমন দুঃসময় আর পার করেনি। যে বন্দরকে ঘিরে টেকনাফের ৩০ শতাংশ মানুষের জীবিকায়ন সেখানে বাণিজ্য কার্যক্রম বন্ধ থাকায় চরম দুর্দিন যাচ্ছে তাদের। আর সরকার হারাচ্ছে শতশত কোটি টাকার রাজস্ব।