ট্রাম্পের মন পেতে আমদানি ‘উদ্দীপক’ নিয়ে দরকষাকষিতে বাংলাদেশ

Google Alert – বাংলাদেশ

রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফা বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ। তবে পাল্টা শুল্ক নিয়ে দরকষাকষির অংশ হিসেবে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশকিছু পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর মধ্যে উড়োজাহাজ, গম, তেল ও তুলা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আরও বেশকিছু পণ্য কেনার চিন্তাভাবনাও রয়েছে। আমদানির এসব উদ্যোগকে শুল্ক নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনার ‘উদ্দীপক’ হিসেবে দেখছে ঢাকা।

বেসরকারি খাত সংশ্লিষ্টজন, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, যা দ্রুত কমিয়ে আনতে ওইসব পণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি কাজেও লাগতে পারে। আবার অনেকে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্ক কমানোর বিষয়ে এখনো খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না।

তবে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কার্যালয়ে তৃতীয় দফা বৈঠকে বসার আগেই দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো তথা শুল্ক ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন পেতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশকিছু পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বৈঠকে বসার আগে এ সিদ্ধান্তগুলোকে ‘অনুপ্রেরণা’ হিসেবে দেখতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬০টি দেশের জন্য রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর পাঁচদিনের মাথায় ৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রকে দুটি চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ। ৯ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করে।

গত ৯ জুলাই ছিল তিন মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার শেষ দিন। ঠিক তার আগের দিন ৮ জুলাই ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে ঘোষণা দিয়ে জানান, বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্কহার হবে ৩৫ শতাংশ, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে।

বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে শুল্কহার বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। উচ্চমাত্রার পাল্টা শুল্কের কারণে দেশের পোশাকখাতসহ বেশ কয়েকটি খাতে রপ্তানি কমার বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

এ শুল্কহার কমাতে এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেও সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। বরং শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের শর্ত দিয়েছে, তা না জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (গোপনীয় বা প্রকাশ না করার মতো চুক্তি) বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বোয়িং বিমান কিনবে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশি মুদ্রায় খরচ হবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ব্যয় পরিকল্পনা

এরপর তৃতীয় দফা বৈঠকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শিডিউল পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশ। অবশেষে সেই শিডিউল মিলেছে। পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনায় সশরীরে অংশ নিতে ডাক পেয়েছে বাংলাদেশ।

ঢাকা ছাড়ছে প্রতিনিধিদল

এ আলোচনায় অংশ নিতে সোমবার (২৮ জুলাই) সন্ধ্যায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার ফ্লাইটে বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে যে প্রতিনিধিদলটি যাচ্ছে সেখানে থাকছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কার্যালয়ে ২৯ ও ৩০ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তৃতীয় দফার বৈঠক চলবে।

বৈঠকের আগেই বেশকিছু পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত

পাল্টা শুল্ক নিয়ে দরকষাকষি করতে ইউএসটিআর কার্যালয়ে বৈঠকে বসার আগেই বাণিজ্য ঘাটতি কমানো তথা যুক্তরাষ্ট্রের মন পেতে দেশটি থেকে বেশকিছু পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এই কেনাকাটার বড় অংশ হিসেবে মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বোয়িং বিমান কিনবে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশি মুদ্রায় খরচ হবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ব্যয় পরিকল্পনা।

আগামী পাঁচ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর ৭ লাখ টন করে গম আমদানির চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে দেশটি থেকে ৩৫ লাখ টন গম কেনা চূড়ান্ত হয়েছে। এর আগে কখনো সরকারি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কেনার রেকর্ড নেই

এছাড়া আগামী পাঁচ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর ৭ লাখ টন করে গম আমদানির চুক্তি করে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে দেশটি থেকে ৩৫ লাখ টন গম কেনা চূড়ান্ত হয়েছে। এর আগে কখনো সরকারি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কেনার রেকর্ড নেই। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতেই প্রথমবারের মতো এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গম রপ্তানিকারক সমিতি বা ইউএস হুইট সমিতির সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

ট্রাম্পের মন পেতে আমদানি ‘অনুপ্রেরণা’ নিয়ে দর কষাকষিতে বাংলাদেশ

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেসরকারি খাতে বছরে প্রায় ৯ মিলিয়ন টন গম আমদানি করা হয়। ওই খাতেও আমদানি বাড়াতে চেষ্টা করছে সরকার।

বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেসরকারি পর্যায়ে তেল ও তুলা আমদানির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা তেল আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে শিগগির আলোচনায় বসছেন। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে শুল্ক নিয়ে বৈঠক চলাকালেই ব্যবসায়ীরা দেশটির তেল রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বসছেন।

পোশাকশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ। এ আমদানি আরও বাড়াতে আগেই আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। তিন বছর আগেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর ১৮০ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করতো, যা পরবর্তীকালে কিছুটা কমেছে। সেটা আবারও বাড়িয়ে আগের অবস্থায় নিতে পারলে সেখানেই ১০০ কোটি ডলারের ঘাটতি কমানো সম্ভব।

যদি শুল্কহার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে সমতাভিত্তিক হয়, তাহলে বাংলাদেশ এখনো টিকে থাকার সুযোগ পাবে। কিন্তু তার জন্য সময় খুবই সীমিত। এখনই সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ও দৃশ্যমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা না চালালে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি নড়ে যেতে পারে।- এস এম এম খালেদ

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ এরই মধ্যে আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কটন কাউন্সিলের (এনসিসিএ) প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) গ্যারি অ্যাডামসকে চিঠি দিয়েছে।

জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তুলা আমদানি হাতিয়ার হতে পারে। বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ সুতা আমদানি করেছে, তার ১২ শতাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সেটা বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানির পরিমাণ চার-পাঁচ গুণ করা সম্ভব।’

ট্রাম্পের মন পেতে আমদানি ‘অনুপ্রেরণা’ নিয়ে দর কষাকষিতে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানি বাড়াতে বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান শওকত আজিজ। বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সুতা সংরক্ষণে নির্ধারিত কেন্দ্রীয় গুদাম স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানি চার-পাঁচ গুণ বাড়ানো।’

আরও পড়ুন

এসব পণ্যের পাশাপাশি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসসহ (এলএনজি) আরও বেশকিছু কৃষিপণ্যের আমদানি বাড়িয়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাবে বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু এখন অনেক আশাবাদী। কারণ, আমরা এখন বাণিজ্য বাড়াতে অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। সেগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকে তুলে ধরবো। আশা করছি, আমরা ভালো ফলাফল পাবো।’

খুব বেশি আশাবাদী নয় বেসরকারি খাত ও অর্থনীতিবিদরা

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য কেনার এসব চুক্তিকে শুল্ক আলোচনার ‘উদ্দীপক’ হিসেবে সরকার মনে করলেও ততটা আশাবাদী নয় বেসরকারি খাত, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, দরকষাকষিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এ কারণে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত শুল্ক না কমালে ক্ষতি মুখে পড়বে সামগ্রিক রপ্তানি খাত।

ট্যারিফ ইস্যুতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাণিজ্যের বাইরেও এখন এ শুল্ক চুক্তিতে অনেক বিষয় রয়েছে। সেগুলো কঠিন। যদিও সেটা পরিষ্কার করে বলছে না সরকার। ফলে সরকার একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে—সেটা আমরা বুঝতে পারছি।- সেলিম রায়হান

তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে এটি পরিষ্কারভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরার জন্য লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার কথা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু আগে সেটা না করে শেষ মুহূর্তে অনানুষ্ঠানিকভাবে লবিস্ট নিয়োগ করতে চাওয়া হয়েছিল। কাজটি করতে দেরি হওয়ায় এখন সেটি হয়নি।’

ট্রাম্পের মন পেতে আমদানি ‘অনুপ্রেরণা’ নিয়ে দর কষাকষিতে বাংলাদেশ

স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম এম খালেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যদি শুল্কহার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে সমতাভিত্তিক হয়, তাহলে বাংলাদেশ এখনো টিকে থাকার সুযোগ পাবে। কিন্তু তার জন্য সময় খুবই সীমিত। এখনই সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ও দৃশ্যমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা না চালালে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি নড়ে যেতে পারে।’

গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্যারিফ ইস্যুতে এরই মধ্যে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাণিজ্যের বাইরেও এখন এ শুল্ক চুক্তিতে অনেক বিষয় রয়েছে। সেগুলো কঠিন। যদিও সেটা পরিষ্কার করে বলছে না সরকার। ফলে সরকার একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে—সেটা আমরা বুঝতে পারছি।’

এনএইচ/এমকেআর/এমএস

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *