Google Alert – সেনাপ্রধান
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দিনটি ছিল সোমবার। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে রূপ নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ও সহিংসতার জেরে এক দফা দাবি ওঠে শেখ হাসিনার পদত্যাগ। সেদিন বেলা ১১টার পর থেকে ঢাকার পথে ঢল নামে মানুষের। কারফিউ ভেঙে বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেন তারা। একপর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকারণ্য হয়ে ওঠে। দুপুর দেড়টার কিছু পড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জনস্রোত আরও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল এসে জনসমুদ্রে পরিণত হয় শাহবাগ।
দুপুরের দিকে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর জানায়, জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি খবর প্রকাশ করে জানায়, শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। সামাজিক মাধ্যমে হেলিকপ্টারে করে দেশ ত্যাগ করার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। ঢাকায় ধীরে ধীরে ইন্টারনেট সচল হতে থাকে।
গণভবনে প্রবেশ করে জনতার স্রোত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর গণভবনে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। তার আগে গণভবন ছেড়ে চলে যায় নিরাপত্তাবাহিনী। এসময় গণভবনের ভেতরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং ব্যাপক লুটপাট করা হয়। গরু, মাছ, হাঁস, মুরগি, আসবাবপত্র, ফ্রিজ, এসিসহ নানা পণ্য নিয়ে যেতে দেখা গেছে মানুষকে। অপরদিকে সংসদ ভবনে জনতার স্রোত দেখা গেছে। সংসদ ভবনের ভেতরেও আগুন দেওয়া হয়, সেখান থেকে মানুষকে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা গেছে।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও সুধা সদনে অগ্নিসংযোগ
রাজধানীর ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে সুধা সদনে বিকালে ভাঙচুর করে আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা। বাড়ি থেকে জিনিসপত্র যে যার মতো নিয়ে চলে যান। এছাড়া একই সময়ে ভাঙচুরসহ আগুন দেওয়া হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে। বিক্ষোভকারীরা সেখানে তখন নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর
৫ আগস্ট বিকালে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর চালান বিক্ষোভকারীরা। বিকাল পৌনে ৫টার দিকে বেশ কিছু মানুষ দেয়াল টপকে রাজধানীর ১৯ হেয়ার রোডে অবস্থিত প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ঢুকে পড়েন। তখন সেখানে কোনও নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন না। ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাটও চলে। এর কিছুক্ষণ আগে প্রধান বিচারপতি বাসভবন থেকে বের হয়ে হন।
আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন
ধানমন্ডির ৩/এ সড়কে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আগুন দেন বিক্ষুব্ধরা। বিকাল ৪টার দিকে তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। বিকালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও অগ্নিসংযোগ করা হয়।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ
বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ধানমন্ডিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। বাড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়াও বের হতে দেখা গেছে। এসময় লুটপাটও করা হয়।
পুলিশ সদর দফতর ও ডিএসসিসি ভবনে আগুন
রাজধানীর গুলিস্তানে পুলিশ সদর দফতর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ভবনে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এসময় দুটি ভবনে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এদিন রাত পৌনে ৮টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এছাড়া হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকাতেও ভাঙচুর করেন দুর্বৃত্তরা।

রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সেনানিবাসে বৈঠক করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান। বৈঠক শেষে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ না দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সেনাপ্রধান বলেন, ‘এখন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সব হত্যার বিচার হবে। সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখেন। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।’
জনগণের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, ‘দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখেন, একসঙ্গে কাজ করি। দয়া করে সাহায্য করেন। মারামারি সংঘাত করে আর কিছু পাবো না। সংঘাত থেকে বিরত হোন। সবাই মিলে সুন্দর দেশ গড়ি।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবো। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলবো। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা হবে।’কোন কোন রাজনৈতিক দল সঙ্গে বৈঠক করেছেন— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, ‘বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। শিক্ষক আসিফ নজরুল ও জোনায়েদ সাকিও বৈঠকে ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। ছাত্ররা শিক্ষক আসিফ নজরুলকে শ্রদ্ধা করেন। তাকে অনুরোধ করেছেন যোগাযোগ করতে। ইতোমধ্যে আসিফ নজরুল একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন।’
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আমরা এখন বঙ্গভবনে যাবো। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হবে।’ তিনি ছাত্রদের শান্ত হওয়ার পরামর্শ দেন।সব হত্যা ও অন্যায়ের বিচার হবে উল্লেখ করে ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আপনারা সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখেন। আমরা সব দায়দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনাদের কথা দিচ্ছি, আশাহত হবেন না। যত দাবি আছে, সেগুলো আমরা পূরণ করবো। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। আমাদের সহযোগিতা করেন। প্রতিটি হত্যার বিচার হবে।’
ভাঙচুর, হত্যা, সংঘর্ষ ও মারামারি থেকে জনগণকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আপনারা যদি কথামতো চলেন, একসঙ্গে কাজ করি। নিঃসন্দেহে সুন্দর পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে পারবো। মারামারি ও সংঘাত করে আর কিছু পাবো না। তাই দয়া করে ধ্বংসযজ্ঞ, অরাজকতা ও সংঘর্ষ থেকে বিরত হন। সবাই মিলে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হবো।’
ছাত্রদের শান্ত হতে আসিফ নজরুলের ভিডিও-বার্তা
৫ আগস্ট বিকাল সোয়া ৩টায় নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া ৩৮ সেকেন্ডের এক ভিডিও-বার্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা এখন আর্মি চিফের (সেনাবাহিনীর প্রধান) সঙ্গে একটা আলোচনায় আছি। আমি যতটুকু ওনার (সেনাপ্রধান) সঙ্গে কথা বলেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে— আমাদের ছাত্র-জনতার যে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা, তা উনি বুঝতে পেরেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আশা করছি আপনাদের জন্য অনেক বড় সুসংবাদ আসছে। ছাত্র, জনতা ও তরুণ সমাজের প্রতি আমার আকুল অনুরোধ— আপনারা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন, ধৈর্য ধরেন। এ দেশটা আমাদের। এখন থেকে আমরা অত্যন্ত সঠিক পথে অগ্রসর হবো।’

দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান বিএনপি মহাসচিবের
দেশবাসীকে শান্ত থাকার জন্য আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এদিন এক বার্তায় তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে আজকের বৈঠক সুন্দর হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন দেশবাসীকে জানানোর জন্য।’
হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম ৬ ঘণ্টা বন্ধ ছিল
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হয় এদিন। আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) ৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।অফিস-আদালত খুলে দেওয়ার ঘোষণা
৫ আগস্ট রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) তথ্য জানায়, মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকাল থেকে দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা খোলা থাকবে। একইসঙ্গে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে।সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর
কিশোরগঞ্জে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এদিন বিকালে শহরের খরমপট্টি এলাকার বাসভবনে শত শত মানুষ বাড়ির প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। স্থানীয়রা জানান, উত্তেজিত জনতা বাসার কিছু মালামাল বাইরে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া বাসার বিভিন্ন মালামাল মানুষ হাতে হাতে করে নিয়ে যায়।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দির মুক্তি দাবি
আন্দোলনকে ঘিরে গ্রেফতার হওয়া সব বন্দিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তির দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সোমবার (৫ আগস্ট) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা একটি অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করবো। সেই জাতীয় সরকারে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও বিভিন্ন পক্ষ রয়েছে। সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আমরা অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকারের রূপরেখা ও সেই সরকারে কারা কারা থাকবেন, তাদের নাম ঘোষণা করবো।’নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-নাগরিকদের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত সরকার ছাড়া আমরা কিন্তু আর কোনও সরকারকে সমর্থন করবো না। সেটা সেনা-সমর্থিত সরকার হতে পারে বা জরুরি অবস্থা দিয়ে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার হতে পারে—এ ধরনের সরকারকে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা গ্রহণ করবে না।’
এই সমন্বয়ক আরও বলেন, ‘যারা এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, তাদের আমরা জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করছি। এছাড়া যারা এই ফ্যাসিস্ট রেজিমে শহীদ হয়েছেন, তাদেরও স্মরণ করছি। ফ্যাসিবাদের দোসররা যেন কোনও সুযোগ না পায়, সেজন্য ছাত্র-জনতাকে রাজপথেই থাকতে হবে।’
এসময় তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব রাজবন্দির মুক্তি, সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা, পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানান। অনেক পক্ষ সুযোগ নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর দোষ চাপাতে পারে বলে সবাইকে সতর্ক করেন তিনি। রাষ্ট্রের কোনও সম্পদের ক্ষতি যেন না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে ছাত্র-জনতাকে রাজপথে থাকার আহ্বান জানান নাহিদ ইসলাম।
বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনীতিবিদদের বৈঠক
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে সেনাপ্রধান, নৌ-প্রধান, বিমানবাহিনীর প্রধান এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। বৈঠকে অনতিবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে সবাইকে ধৈর্য ও সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানানো হয় বৈঠকে। লুটতরাজ ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।
এ বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে অনতিবিলম্বে মুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এবং সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় আটক সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন কোনোভাবেই বিনষ্ট না হয়, সে ব্যাপারেও সভায় ঐকমত্য হয়।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, হেফাজতে ইসলামের মামুনুল হক, মুফতি মনির কাসেমী ও মাহাবুবুর রহমান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও শেখ মো. মাসুদ, মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে রাব্বি, জাকের পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা জালাল উদ্দীন আহমদ, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণ-অধিকার পরিষদের অ্যাডভোকেট গোলাম সারওয়ার জুয়েল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, ফিরোজ আহমদ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল হোসাইন, আরিফ তালুকদার, ওমর ফারুক ও মোবাশ্বেরা করিম মিমি এবং ইঞ্জিনিয়ার মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনএদিন রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো.সাহাবুদ্দিন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আজ বঙ্গভবনে তিন বাহিনীর প্রধান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা হয়। শুরুতেই সেনাপ্রধান বিরাজমান সার্বিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তার আলোচনা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। রাজনৈতিক নেতারাও এসময় তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।’
তিনি জানান, ‘সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। এছাড়া জরুরি ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সব দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব সাধারণ নির্বাচন করবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় আটকসহ সব বন্দির মুক্তি দেওয়া হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিহতদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ ও আহতদের সুচিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়া হবে। সর্বসম্মতিক্রমে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবং লুটতরাজ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি, প্রশাসন ও শিল্প কল-কারখানা চালু রাখার লক্ষ্যে সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই। ছাত্রনেতাদের ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে অতি শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হবে। এছাড়া যারা হত্যা ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িত, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী অনতিবিলম্বে বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করা হবে। দেশের সব অফিস-আদালত আগামীকাল (৬ আগস্ট) থেকেই স্বাভাবিকভাবে চলবে।’
বাংলাদেশ ইস্যুতে নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে মোদির বৈঠক
বাংলাদেশের চলমান ইস্যু নিয়ে (৫ আগস্ট) সংসদীয় নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সোমবার বিকালে তার সরকারি বাসভবনে এই বৈঠক হয়েছে। এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ
ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ ঘাঁটিতে অবতরণ করে শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান। এরপর বিকালে তিনি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়। এদিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অবগত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
বিবিসির সাক্ষাৎকারে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রতিক্রিয়া
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে গেছেন শেখ হাসিনা। সেখান থেকে তার লন্ডন যাওয়ার কথা রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না।
জয় বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা এতটাই হতাশ যে তার কঠোর পরিশ্রম করার পরও কিছু লোক তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন।’ বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে জয় বলেন, ‘গতকাল (৪ আগস্ট) থেকেই তার মা পদত্যাগের কথা চিন্তা করছিলেন। তিনি দেশ ছেড়েছেন তার নিরাপত্তার জন্য।’

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে যান বিএনপি নেতারা
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান দলটির নেতারা। সোমবার (৫ আগস্ট) রাতে বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গুলশানে চেয়ারপারসনের অফিস থেকে অনলাইনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে তারা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ার হাসপাতালে রওনা হন। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু এবং আশরাফ উদ্দিন নিজাম।’
দেশব্যাপী হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট, নিহত হয় শতাধিক
আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, কার্যালয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ তাদের মালিকানাধীন বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। যাদের বাড়িঘর ও স্থাপনা হামলার শিকার হয়েছে তাদের মধ্যে দলটির অন্তত ১৯ জন সংসদ সদস্য (এমপি) ও চার জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন।এ ছাড়া হামলা হয়েছে পুলিশ সদর দফতর, থানা, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও জেলা পুলিশ লাইনসসহ পুলিশের অসংখ্য স্থাপনায়। এসব জায়গা থেকে লুট হয় বহু অস্ত্র। হামলা চালানো হয় কয়েকটি কারাগারেও পালিয়ে যান অনেক বন্দি।
ঢাকা মেডিক্যালে ৪০ মরদেহ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে সোমবার (৫ আগস্ট) রাজধানীতে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে ৪০ জনের মরদেহ রয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। একইসঙ্গে ঢামেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৩৯৭ জনকে এবং ভর্তি হয়েছেন ৭১ জন।
গণমাধ্যম অফিসে ভাঙচুর
সহিংসতার অংশ হিসেবে ৫ আগস্ট বিকালে বেসরকারি কয়েকটি গণমাধ্যম অফিসে ভাঙচুর চালিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে বেসরকারি টেলিভিশন সময়, এটিএন নিউজ, মাই টিভি ও ৭১ টিভিতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ঢিল ছুড়ে এটিএন নিউজ ভবনের দরজা-জানালার প্রায় সব কাচ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ সময় অফিসের নিচে রাখা মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে ফেলা হয়।
যশোরে হোটেলে আগুন, নিহত ২৪
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগে ২৪ জন নিহত হন। ৫ আগস্ট বিকাল চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। যশোর ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক এএম মামুন জানান, জাবির হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘জাবির হোটেলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ২৪ জনের মরদেহ হাসপাতালের মর্গে আনে ফায়ার সার্ভিসের টিম। আহত হয়েছেন দেড়শত। আহতদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কাজনক ছিলেন।’