Bangla Tribune
প্রতারণার মামলায় কারাগারে থাকা দুই সন্তানের জনক ও ২৫ বছরের আলোচিত হ্যাকার চক্রের হোতাকে শিশু দেখিয়ে আদালত থেকে জামিনে মুক্ত করার ঘটনায় গাইবান্ধায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জন্মনিবন্ধন জালিয়াতিতে আসামিপক্ষের আইনজীবীর যোগসাজশেই এ ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি প্রকাশ পেতেই জেলাজুড়ে তীব্র আলোচনার জন্ম দেয়। জালিয়াতির এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
মামলার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই ভোরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযানে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে আলোচিত হ্যাকার চক্রের হোতা পলাশ রানাকে তার শ্বশুর মশিউর রহমানের বাড়ি থেকে এবং সহযোগী সুমন মিয়া, সাইদুল ইসলাম ও আবু সাইদ লিটনকে আটক করে। এ সময় বিপুল পরিমাণ সিম, মোবাইল ও প্রযুক্তি ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। ওই দিনই গোবিন্দগঞ্জ থানায় মামলা হলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
অভিযোগ রয়েছে, তালুককানুপুর গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে পলাশ রানা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি ভাতার বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করতেন।
এরপর গত ২০ জুলাই গোবিন্দগঞ্জ আমলি আদালতে পলাশ রানা ও সুমন মিয়ার জামিন আবেদন ব্যর্থ হলে, ২৭ জুলাই দায়রা জজ আদালতে একটি মিস কেস দায়ের করেন আইনজীবী শেফাউল ইসলাম রিপন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে জামিন শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন ১২ আগস্ট।
অভিযোগ উঠেছে, মিস কেসের তথ্য গোপন রেখেই পলাশ রানাকে জামিনে মুক্ত করতে ভিন্ন কৌশল নেয় তার আইনজীবী। গত ৩ আগস্ট গাইবান্ধার শিশু আদালত-২-এ কারাগারে থাকা পলাশ রানাকে শিশু হিসেবে জামিনের আবেদন করলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। একটি ভুয়া জন্মনিবন্ধন তৈরি করে ২৫ বছরের পলাশ রানাকে শিশু (১৭ বছর ৭ মাস) দেখিয়ে জামিনে মুক্তির ঘটনা প্রকাশের পর আদালতপাড়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
এদিকে, দায়রা জজ আদালতে পূর্বনির্ধারিত তারিখে ১২ আগস্ট পলাশ রানার জামিনে মুক্তি ও জাল জন্মনিবন্ধন দিয়ে প্রতারণার ঘটনাটি আদালতে লিখিতভাবে অবগত করেন আইনজীবী সরওয়ার হোসেন বাবুল।
আইনজীবীর আবেদনে উল্লেখ করা হয়, শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রেফতার হওয়া ২৫ বছর বয়সী বিবাহিত পলাশ রানার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। অথচ তাকে শিশু দাবি করে নাম পরিবর্তন করে ‘পলাশ মিয়া’ বানিয়ে জামিন নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে আইনজীবী সরওয়ার হোসেন বাবুল অভিযোগ করে বলেন, ‘তালুককানুপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪ আগস্ট ইস্যুকৃত অনলাইন জন্মনিবন্ধনটি ৩১ জুলাই রেজিস্ট্রেশন করা হয়, যেখানে পলাশ রানার জন্মতারিখ দেখানো হয় ১৫ জানুয়ারি ২০০৮, যাতে তার বয়স দাঁড়ায় ১৭ বছর ৭ মাস। অথচ জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্মতারিখ ১ জুন ২০০০, অর্থাৎ বয়স ২৫ বছর ২ মাস। মামলার এজাহারেও বয়স ২৫ বছর উল্লেখ রয়েছে।’ এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে পলাশ রানাকে শিশু দেখিয়ে জামিনে মুক্তির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকেই দায়ী করছেন তিনি।
যদিও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এবং জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)। এ বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর পিপি আবু বকর সিদ্দিক ছানা বলেন, ‘আদালত থেকে শিশু জামিন নেওয়ার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এ ঘটনা জানার পর আদালতের নির্দেশে ওই জামিন বাতিল করাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
অপরদিকে, জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি আব্দুল হালিম প্রামাণিক বলেন, ‘এটি আমার আদালতের ঘটনা নয়, জালিয়াতি কিংবা আসামির জামিনের বিষয় সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানেন। আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনও সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া জামিন দেওয়ার এখতিয়ার সম্পূর্ণ আদালতের।’
এদিকে, জেলা জজ আদালতে মিস মামলাটি পেন্ডিং থাকা সত্ত্বেও জন্মনিবন্ধন জালিয়াতি করে আসামির জামিন বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনায় হতবাক ও ক্ষুব্ধ জেলা বারের আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে জেলা জজ আদালতের আইনজীবী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জাল জালিয়াতি করে আসামি জামিনে মুক্ত হওয়ার ঘটনা লজ্জাজনক। আদালতে এমন ঘটনা কাম্য নয়। এ ঘটনায় শুধু আইনজীবী নয়, আদালতের অসাধু কর্মচারী, সেরেস্তাদার ও ল-ক্লার্করাও জড়িত।’
আইনজীবী আশরাফুল আলম রঞ্জু বলেন, ‘এমন ঘটনা আদালতে নতুন নয়। এর আগেও জালিয়াতি ও তথ্য গোপন করে আসামি জামিনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা দরকার, না হলে এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এতে আদালতে আসা মানুষের আস্থা হারাবে।’
আইনজীবী ও বাংলাদেশ নারী মুক্তিকেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী বলেন, ‘আদালত মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল। সেখানে এমন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত আইনজীবী শেফাউল ইসলাম রিপনের মুখোমুখি হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আসামির বয়স কম হওয়ায় আদালতে জামিন আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন বিচারক। আসামিপক্ষের দেওয়া জন্মনিবন্ধনটি জাল কি না তা আমার জানার কথা নয়।’ এ ছাড়া আসামিপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে জালিয়াতির এমন ঘটনার অভিযোগও নাকচ করেন তিনি।
এরই মধ্যে জালিয়াতির ঘটনার প্রতিকার চেয়ে গত ১৩ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ও বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন রহমত আলী নামে এক ব্যক্তি।
এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া ও অভিযুক্ত আইনজীবীর সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন।