Google Alert – প্রধান উপদেষ্টা
ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল। প্রতিটি সেক্টরের মতো গণমাধ্যমও তা থেকে বাদ যায়নি। ফলে বেশির ভাগ দৈনিক পত্রিকা, টিভি, অনলাইন মিডিয়া দিল্লির নাচের পুতুল হাসিনার তাবেদারী করায় গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। বিপরীতে সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের মতামত আদান প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠে।
ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউবের প্রতি সবার আগ্রহ বেড়ে যায়। সেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুর রহমানের একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। গত শনিবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জামায়াতের প্রশংসা করেন। তিনি বলেছেন, ‘ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াত অভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও সততার সুনাম বজায় রেখেছে। তাদের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা, সততার সুনাম সব দলের জন্য অনুকরণীয়’। মূলত প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের এই বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। নেটিজেনরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক করছেন, সমালোচনার ঝড় তুলছেন। নেটিজেনদের কেউ কেউ জামায়াতের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও সততার সুনামকে প্রাণঘাতি ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করছেন। একজন লিখেছেন, ‘কারো ক্যান্সার হলে রোগী টের পান না অথচ নীরবে সারাশরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে। রোগী বুঝতে না পারলেও ভিতরে ভিতরে নি:শব্দে রোগীকে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনের পর জামায়াত নি:শব্দে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। নি:শব্দে প্রতিটি সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে; অথচ অন্যেরা টেরও পায়নি। জামায়াতকে রাজনীতি প্রাণঘাতি ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করে বিএনপির রাজনীতিকে ডেঙ্গু জ্বরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কেউ কেউ লিছেছেন, দেশের রাজনীতিতে জামায়াত ক্যান্সার হলে বিএনপির অবস্থা ডেঙ্গু জ্বরের মতো। জ্বর হলে শরীরে তাপমাত্রা বাড়লে রোগী যন্ত্রণাকাতর হয়। বিএনপির তৃর্ণমূলের কিছু নেতা চাঁদাবাজী করছে তা গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। বিএনপি যদিও ওই সব নেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে; তারপরও ডেঙ্গু জ্বরের মতো সবাই রোগ জানতে পারছে। কিন্তু জামায়াত ক্যান্সারের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রভিসি, বিভিন্ন সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ পদ নীরবে দখল করেছে। মসজিদ-মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, সচিবালয় থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রাস করছে নি:শব্দে, অথচ ক্যান্সার রোগের মতোই কেউ বুঝতেই পারছে না। ক্যান্সার যেমন রোগীর শরীককে ধ্বংস করে; জামায়াত তেমনি দেশের রাজনীতিকে ধ্বংস করছে। দলটি এনজিও এবং কর্পোরেট রাজনীতির মতো ব্যবসা-রাজনীতি একসঙ্গে করছে। এমনকি গত এক বছরে কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা দখল করেছে। রাজনীতির নামে ব্যাংকিং, হাসপাতাল, শিক্ষা ব্যবসা করছে।
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। তার দ্রুত সুস্থতা কামনা করা হচ্ছে। সবাই তার খোঁজখবর নিচ্ছেন; এটা দেশের রাজনীতিতে সুস্থধারা সৃষ্টির লক্ষণ। দেশের রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ীদের সর্জি জ্বর হলেই যখন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার হিড়িক চলছে; তখন সব ধরনের ব্যবস্থা থাকার পরও জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান বিদেশে না গিয়ে দেশে চিকিৎসা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা সবাই করছেন। কিন্তু তার নেতৃত্বে জামায়াতের রাজনীতি দেশের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও সততার সুনাম এবং অনুকরণীয় বলার কী সুযোগ আছে? ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে দেখা যায়, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতের জামায়াতের প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি অনুসরণীয়-অনুকরণীয় কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। বরং দলটি ১৯৪৭ সালে দেশভাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এমনকি স্বৈরশাসক এরশাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে হাসিনার সঙ্গে গোপন আঁতাত করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে স্বৈরশাসন দীর্ঘায়িত করার সুযোগ করে দেন। ’৯০ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলনে আওয়ামী লীগের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। অথচ সেই বিএনপির অনুকম্পায় ২০০১ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর দলটির দু’জন নেতা মন্ত্রী হন। ভারতের নাচের পুতুল হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত ১৫ বছরের মাফিয়াতন্ত্রে জামায়াতের উপর দিয়ে নির্যাতনের সুনামি বয়ে যায়। বিএনপির সঙ্গে জোট করে দলটি টিকে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এখন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব আগামী সংসদে নিশ্চিত করতে দিল্লির এজেন্ডা ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির (পিআর)’ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। প্রকাশে ভারতের বিরোধিতা পর্দার আড়ালে দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা কেন?
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের পোস্টে লিখেছেন, ‘হার্ট সার্জারির পর শফিকুর রহমান ভাইয়ের কথা ভেবেছি এবং তাকে আমার দোয়ায় রেখেছি। গভীর অনিশ্চয়তার এ সময়ে তার ধৈর্যশীল নেতৃত্ব ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় গঠনমূলক অংশগ্রহণের সদিচ্ছা সত্যিই প্রশংসনীয়। তার নেতৃত্বে জামায়াত অভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও সততার সুনাম বজায় রেখেছে, যা সব দলের অন্য অনুকরণীয়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন দৃঢ়তা ও প্রশান্তি লাভ করেন এবং দ্রুত সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন, ইনশাল্লাহ।’
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে জামায়াত প্রশাসনের পরতে পরতে যে ভাবে নিজেদের চেতনার ব্যাক্তিদের বসাচ্ছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মসজিদের ইমান নিয়োগ, মাদরাসার কমিটি গঠন করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছে তা সব দলের সব দলের অন্য অনুকরণীয় হয় কেমন করে?
’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষ্যে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। দলটির নেতারা এখনো জাতির কাছে ওই কর্মকান্ডের ক্ষমা চায়নি। জামায়াতের সেদিনের ভুমিকা কী অন্যান্য দলগুলোর জন্য অনুসরণীয় কিছু? ’৮২ সালে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন এইচ এম এরশাদ। এরশাদের পতন আন্দোলনে সব দল ঐক্যবদ্ধ হলে এরশাদ নিজের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশলে ’৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। চট্টগ্রাম লালদিঘী ময়দানের সমাবেশে ‘এরশাদের অধিনে নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় বেঈমান হবে’ ঘোষণা দিয়ে পরের দিন শেখ হাসিনা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জামায়াত ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পথধরে নির্বাচনে অংশ নেয়। তাহলে জনগণের বিরুদ্ধে জামায়াতের সেদিনের কৌশল কী কোনো নীতিবান রাজনৈতিক দলের জন্য অনুসরণীয়?
সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেরা লিখেছেন, ‘বর্তমানে প্রশাসনে জামায়াতের চেতনায় বিশ্বাসী ৩২ জন সচিব রয়েছেন। আওয়ামী লীগের অনুগত আমলা হিসেবে পরিচিত অনেকেই ‘জামায়াতি চেতনা’ বিশ্বাসী তকমা নিয়ে এখন প্রশাসনে বিভিন্ন সেক্টরে ও তৃর্ণমূল প্রশাসনে নিজের রাজনৈতিক চেতনার বিশ্বাসী কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলি ও পদ-পদবিতে বসাচ্ছেন। জেলা উপজেলা পর্যায়ে জামায়াতের চেতনার বিশ্বাসী কর্মকর্তারা চেয়ারে থাকায় বিভিন্ন সেক্টরের ঠিকাদারি কাজ থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজ নি:শব্দে জামায়াতের লোকজন বাগিয়ে নিচ্ছে। অন্য দল তথা বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ঠিকাদারিসহ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করলে জামায়াতি চেতনাধারী কর্মকর্তারা সততার নামে তা প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলে দিচ্ছেন।
জামায়াত শিবিরেরা মুখোশ খুলে দিয়ে বোমা ফাটিয়েছেন দু’জন নেতা। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহবায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, ‘শিবিরের কোনো নেতা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্বয়ক ছিলেন না’। অথচ শিবির নেতা সাদিক কায়েম প্রচার করছে তারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বয় ছিলেন দাবি করছেন। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আব্দুল কাদের ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম ভাই ক্ষমতার হিস্যাটাই চেয়েছেন। অভ্যুত্থানে তাঁদের অবদান, ত্যাগ অনুযায়ী হিস্যা বুঝে পেতে চেয়েছেন। সব সমস্যার মূল হচ্ছে এই ‘যথাযথ হিস্যা না পাওয়া’! অভ্যুত্থান পরবর্তীতে জামাত শিবিরের পক্ষ থেকে ঢাবি শিবিরের একজন সাবেক এক সভাপতি এবং এক শিবির নেতার বউ মূলত হিস্যার বিষয়টা ডিল করতেন। সচিবালয় থেকে মন্ত্রণালয়, আমলাতন্ত্রের সব জায়গায় নিজেদের মতাদর্শী লোকজন বসানোর ক্ষেত্রে লিঁয়াজো করেছেন মূলত এই দুই ব্যক্তি’। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন শিবির নেতারা যেভাবে ক্ষমতার হিস্যার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মেতে উঠেন সেটা কি কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য অনুসরণী হতে পারে? ফলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া পোস্টে জামায়াতের গুণগান বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিতর্কে জড়ানো নেটিজেনদের কেউ কেউ অবশ্য নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে পক্ষপাতমূলক ভাবে কোনো দলের পক্ষ্যে বক্তব্য দেয়া নির্দলীয় সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে এমন মন্তব্য করেন।