Google Alert – সেনাবাহিনী
আসামি ধরার পর থানায় হামলা করে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির খবর আসছে৷ গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পরও পুলিশ ঘুরে দাঁড়তে পেরেছে কি না সেই প্রশ্ন উঠছে৷
এদিকে ৬ মাস পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। পরদিন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনও ঘোষণা দিয়েছে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে।
সাবেক পুলিশ প্রধানরা বলছেন, মাঠে তো সেনাবাহিনী থাকছেই। ফলে সবাই মিলে সহযোগিতা করলে পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগামী মাস থেকে পুলিশের ট্রেনিং শুরু হচ্ছে। আগামী তিন মাস ট্রেনিং চলবে। এরপর নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের বিষয়। যদিও সেই সময় এখনও অনেক দূরে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, নির্বাচনে যাতে সঠিকভাবে পুলিশ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে।”
নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর করা শুধু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব না। আইনশৃঙ্খলার কাজে পুলিশকে প্রস্তুত করে দেওয়া সরকারের নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব। যদিও আমরা এখনও পুলিশের সঙ্গে বসিনি। সেপ্টেম্বরের শেষে অথবা অক্টোবরের শুরুতে আমরা তাদের নিয়ে বসব। তখন বোঝা যাবে পুলিশ কতটুকু প্রস্তুত।”
প্রিজাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় ‘অস্ত্রসহ আনসার’
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসারের নিরাপত্তায় ‘অস্ত্রসহ আনসার’ সদস্য রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “নির্বাচনের সময় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আনসার। এবার আমরা আরেকটা জিনিস করতেছি, অন্য সময়ে থাকে না, এবার প্রিজাইডিং অফিসারকে নিরাপত্তা দিতে হাতিয়ারসহ আনসার থাকছে। অনেক সময় প্রিজাইডিং অফিসারের ওপর (লোকজন) হামলা করতে যায়। এজন্য উনার জন্য হাতিয়ারসহ একটা গার্ডের ব্যবস্থা করছি। ওনাকে কেউ যেন কোনো কিছু না করতে পারে।”
এর আগে প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রে চারজন নারী ও ছয়জন পুরুষ আনসার সদস্য দেওয়া হয়, যাদের কাছে হাতিয়ার থাকে না। হাতিয়াসহ থাকেন দুইজন আনসার সদস্য। এবার হাতিয়ারসহ তিনজন আনসার সদস্য থাকবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আনসার ছাড়াও পুলিশ ও র্যাব মোতায়েনের আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হবেও জানান উপদেষ্টা।
আগামী নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “এটা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ নয়। মূল কাজ করবেন নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবেন তারা। তারা নির্বাচনটা কীভাবে চাচ্ছেন, নির্বাচন কমিশন কীভাবে চাচ্ছে। প্রশাসন রয়েছে, তারপরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারপরের বিষয়টি জনগণ, তাদেরতো ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে।”
ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় বডি ক্যামেরা
আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে পুলিশের জন্য কমপক্ষে ৪০ হাজার বডি-ওয়্যার ক্যামেরা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
গত শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় এই পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকস চৌধুরী এবং ফয়েজ তৈয়ব আহমেদ সভায় উপস্থিত ছিলেন।
ফয়েজ তৈয়ব আহমেদ বলেন, ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা, যা সাধারণত বডিক্যাম নামে পরিচিত, সংগ্রহের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই ডিভাইসগুলো হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করবে। তিনি বলেন, আমরা অক্টোবরের মধ্যে বডিক্যামগুলো সংগ্রহ করতে চাই যেন পুলিশ বাহিনী এসব বডিক্যামের এআই সক্ষমতাসহ মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পেতে পারেন। জার্মানি, চীন ও থাইল্যান্ডের তিনটি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ করেছে ক্যামেরা সরবরাহের জন্য। পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবলরা নির্বাচনের সময় ডিভাইসগুলো তাদের বুকে পরবেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এ সময় কর্মকর্তাদের বডিক্যামগুলো দ্রুত ক্রয় এবং হাজার হাজার পুলিশ কর্মীর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।
যদিও পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বডি ক্যামেরাগুলো এখনও পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এতগুলো ক্যামেরা সংগ্রহ করা এবং পুলিশের প্রশিক্ষনের বিষয়ও আছে। এই মুহুর্তে (রবিবার সন্ধ্যায়) আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি, তখন একটি কোম্পানী আমাদের তাদের তৈরী ক্যামেরাগুলো দেখাচ্ছে। বিষয়টি চূড়ান্ত হতে সময় লাগবে। সবাই মিলেই চেষ্টা করছি, কিভাবে ভালো একটা নির্বাচন করা যায়।”
‘ঝুঁকি বাড়াবে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র’
গত বছরের ৫ আগস্ট থানা ও স্টেশনগুলো ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল পুলিশ সদস্যরা। লুট হয়েছিল তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। লুট হওয়া অস্ত্রের একটা অংশ উদ্ধার হলেও এখনও প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। যেগুলো অপরাধীদের কাছে চলে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। আগামী নির্বাচনের আগে এই অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই।
এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, গতবছরের জুলাই-অগাস্টে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর যেসব অস্ত্র হারিয়ে গেছে বা লুট হয়েছে তা উদ্ধারের ব্যাপারে একটা পুরস্কারও ঘোষণা করা হচ্ছে। যারা সন্ধান দিতে পারবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। দুই একদিনের মধ্যে এটি জানানো হবে। নির্বাচনের আগে এই অস্ত্র উদ্ধারের আশার কথা বলেন তিনি।
যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ অস্ত্র উদ্ধার বাকি রয়েছে। কিন্তু পুলিশের হিসাবে ১ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা ও পুলিশি স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৮১৮টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র এবং ৬ লাখ ৭ হাজার ২৬২টি গোলাবারুদ লুট হওয়ার তথ্য এসেছিল।
গত মাসে ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (স্টাফ কর্নেল) কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী লুট হওয়া ৮০ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্র আসন্ন নির্বাচনের আগে জব্দ করা হবে। যাতে আগামী নির্বাচনে এসব অস্ত্র দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারে অপরাধী চক্রগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে বড় রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে লুটের অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিকল্প নেই।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টির মধ্যে ৪৬০ থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। ১১৪টি ফাঁড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ ১১ ধরনের প্রায় ৬ হাজার অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ৪ হাজার ৩৮৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টির মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৫টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “নির্বাচনী দায়িত্ব তো আর পুলিশ একা পালন করবে না। এখানে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যদিও এক বছরে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ, তারপরও এই পুলিশকে দিয়েই ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। এখন যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের আস্থায় নিয়ে কাজ করতে হবে। তাদের সুযোগ দিতে হবে। এখনও আসামী গ্রেপ্তারের পর থানা ঘেরাও হচ্ছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের অভিযানটি কার্যকরভাবে করতে হবে। তাহলেই সম্ভব।”
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “মানুষ ভোট কেন্দ্রে হাঙ্গামা করতে আসবে, আর পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এমন যদি হয় তাহলে আমরা কিসের পরিবর্তন করলাম। সেই গণতন্ত্র তো দরকার নেই। শুধু পুলিশ কেন, রাজনীতিবিদদের কোন দায় নেই? তারাও তো নির্বাচনের অংশ। আর পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী তো থাকছে, থাকছে আনসার সদস্যরাও। ফলে পুলিশ ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাহলে নির্বাচন কিভাবে হবে এসব চিন্তা বাদ দিতে হবে। ভালো নির্বাচনের জন্য সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন।”