নিহত ৩, সেনাসহ আহত ১৬

Google Alert – পার্বত্য চট্টগ্রাম

খাগড়াছড়ির গুইমারায় গতকাল গুলিতে তিনজন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন। তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ছাবের। তিনি বলেছেন, সদর হাসপাতালের মর্গে তিনজনের লাশ রয়েছে। তবে কার গুলিতে কীভাবে মারা গেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। নিহত তিনজনই পুরুষ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিনজন পাহাড়ি নিহতের ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, গুইমারা উপজেলায় দুষ্কৃতকারীদের হামলায় মেজরসহ ১৩ জন সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিনজন পুলিশ সদস্য এবং আরও অনেকে আহত হয়েছে। সূত্র জানায়, আজ সোমবার সকালে তিনজনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হবে। হাসপাতালে গুইমারা থেকে আনা আহত চারজনের চিকিৎসা চলছে। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তৃতীয়পক্ষ ফায়দা নেওয়ার জন্য ইন্ধন জোগাচ্ছে। এদিন দুপুরে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এই অভিযোগ করেন।

এদিকে ধর্ষণের ঘটনা কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরেই উত্তপ্ত খাগড়াছড়ি। ধর্ষণের অভিযোগে আন্দোলনে নামে জুম্ম ছাত্র-জনতার নামে একটি নতুন সংগঠন। এই সংগঠনের ব্যানারে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক কর্মসূচি। টানা সড়ক অবরোধ, ১৪৪ ধারা জারি, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে শনিবার ভোর থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি-সাজেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সকালে জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ করেন অবরোধকারীরা। গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে ওই কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : রোববার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, তিনজন নিহতের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগির তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধারণপূর্বক শান্ত থাকার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ নিরাপত্তায় যৌথভাবে কাজ করছে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও পৌরসভায় ১৪৪ ধারা জারি করার পর থেকে থমথমে রয়েছে পরিস্থিতি। ধর্ষণের প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজারে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে অবরোধ চলাকালে গুইমারার একটি বাজারে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুনে বেশ কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়। এ সময় বাজারের পাশে থাকা বসতঘরও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভা : খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে রোববার জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় সুপ্রদীপ অভিযোগ করেন আন্দোলনের নামে সহিংসতা তৈরিতে একটি পক্ষ অর্থায়ন করছে। আমি নিশ্চিত কেউ না কেউ এদের পেছনে অর্থ ঢালছে। আন্দোলনকারীদের বয়স অনেক কম। তাদের পক্ষে গাড়ি ভাড়া করে দীঘিনালা, পানছড়ি থেকে জেলা সদরে আসা সম্ভব নয়।

পক্ষটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। ১৪৪ ধারা জারির মধ্যে তারা কীভাবে মব করে। যদি ১৪৪ ধারা কেউ ভাঙে তাহলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করতে হবে।’ তিনি বলেন ‘সরকার অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছাড়া কারও হাতে আর অস্ত্র থাকবে না। আজকে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রশাসনকে বলব তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এছাড়া এই মব বন্ধ করা যাবে না। এই সহিংস পরিস্থিতির জন্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করে জেলা বিএনপির সভাপতি এমএন আফসার বলেন, ‘তাদের উসকানিতে আজকে এই ঘটনা ঘটছে। তারা পাহাড়ে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের ওপর ভর করেছে। তারা উসকানি দিয়ে আজকে জেলার মধ্যে একটি এরকম সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করেছে।’

জনজীবন স্থবির : জেলা সদর ও পৌরসভায় শনিবার দুপুর ২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। পৌর শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। জেলা সদরে মোতায়েন করা হয়েছে সাত প্লাটুন বিজিবি। মোড়ে মোড়ে চলছে তল্লাশি। কয়েকটি খাবারের দোকান ছাড়া বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। যানবাহনও রাস্তায় নামেনি।

গুইমারায় সংঘর্ষ, আগুন : রোববার দুপুরে গুইমারায় ১৪৪ ধারার মধ্যেই সড়ক অবরোধ করে জুম্ম ছাত্র-জনতা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবরোধকারীদের সড়ক ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে তারা বাহিনীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ায়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ হয়। পরে অবরোধকারীরা সড়ক ছেড়ে দেয়। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, ‘গুইমারায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আমি পরিস্থিতি দেখতে সেখানে যাচ্ছি। যাওয়ার পর বিস্তারিত জানাতে পারব।’

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত : খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালায় অষ্টম শ্রেণির স্কুলছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে বুধবার শহরে বিক্ষোভ করে জুম্ম ছাত্র-জনতা। ওই দিন ভোররাতে সদর থানায় ভিকটিমের পিতা মামলা করেন। আসামি করা হয় অজ্ঞাত তিন ব্যক্তিকে। শয়ন শীলকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের দাবিতে বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়িতে আধাবেলা সড়ক অবরোধের ডাক দেয় জুম্ম ছাত্র-জনতা নামের সংগঠনটি। পরদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে খাগড়াছড়ি জেলায় পুনরায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধের ডাক দেয় সংগঠনটি। এতে জেলায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরে খাগড়াছড়ির নারানখাইয়া এলাকায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মহাজনপাড়া এলাকায় দুপক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। এরপর সেনাবাহিনী ও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। শনিবার রাতভর খাগড়াছড়িতে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হয়। রোববার থেকে কঠোর হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।’

ম্লান শারদীয় দুর্গা উৎসব : রোববার মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে সারা দেশে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। খাগড়াছড়িতে উৎসবের কোনো আমেজ ছিল না। মন্দিরে পুনার্থীদের কোনো ভিড় ছিল না। সনাতনধর্মীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাঝে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা। খাগড়াছড়ি সনাতন সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি নির্মল দেব বলেন, ‘আমরা খুবই মর্মাহত। আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের আগে সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়ায় আমরা হতবাক। দুর্গাপূজা একটি সার্বজনীন উৎসব। কিন্তু জুম্ম ছাত্র-জনতার সড়ক অবরোধের কারণে কেউ এবার উৎসব পালন করতে পারবে না। প্রতিমা দেখার জন্য বিভিন্ন উপজেলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যায় । এবার সেটা তারা পারছে না।’ খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হওয়ার আগেই আমরা এক আসামিকে গ্রেফতার করেছি। বাকি যে দুই আসামি রয়েছে তাদের নাম কেউ বলতে পারে না। ভিকটিমও জানে না।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নিন্দা : খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে অবরোধ চলাকালে গুইমারা বাজারে দুর্বৃত্তদের আগুন, গুলি ও হামলার ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতি সংগঠনের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে যে বা যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে হবে।

সেনাবাহিনীর ওপর হামলার নিন্দা হেফাজতের : হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, গুইমারায় সেনাবাহিনীর ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। রোববার এক বিবৃতিতে হেফাজতের দুই শীর্ষ নেতা আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক নিরাপত্তা আরও বাড়াতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।

রাবিতে বিক্ষোভ : রাবি প্রতিনিধি জানান, কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং এর প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অধ্যয়নরত পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা। রোববার বিকাল সাড়ে ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্যারিস রোডে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন তারা।

সেনাসদস্যদের ওপর হামলায় এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশনের নিন্দা : খাগড়াছড়িতে সেনাসদস্যদের ওপর ঘাতক সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন। রোববার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ খান সাইফ (অব.) স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাহাড়ে আরও সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে খাগড়াছড়িতে সেনাসদস্যদের ওপর নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ হামলায় দেশপ্রেমিক সেনাসদস্যদের জীবন দিতে হয়েছে, যা শুধু সেনাবাহিনী নয়, সমগ্র জাতির জন্য এক বেদনাবিধুর ক্ষতি। আমরা নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সেনাসদস্যদের ওপর হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রবিরোধী ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ। পাহাড়ের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় যারা চিরকাল প্রহরীর ভূমিকা পালন করে আসছেন, তাদের ওপর হামলা আসলে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের শেকড়ের ওপর আঘাত করা।

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *