Google Alert – সেনাপ্রধান
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ৬ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর সংঘটিত ১৭ দিনের সর্বাত্মক যুদ্ধ সেই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা, যা মূলত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানেই সীমিত ছিল। এ যুদ্ধে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার, সৈনিক এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি পাইলটদের বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ সামরিক কৃতিত্ব (‘নন-মার্শাল রেস’ থিওরির ধারণা ভেঙে দিয়ে) সামরিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিল। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে অত্যন্ত অরক্ষিত-এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে তখন আলোচনায় আসে। এ নিবন্ধে বাঙালি সৈনিকদের বীরত্ব ও কৃতিত্বের কথা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের কিছুদিন পর পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের জন্য একটি ‘রেজিমেন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর নামকরণ করা হয় ‘দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় (দারোগাবাড়ি) ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ‘১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬৫ সালে ১ম ইস্ট বেঙ্গল লাহোর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। তখন এর অধিনায়ক ছিলেন চৌকশ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল এ টি কে হক (পরে কর্নেল, সিতারায়ে জুরাত ও বার্মায় নিযুক্ত ‘ডিফেন্স অ্যাটাশে’)। ব্যাটালিয়নের উপাধিনায়ক ছিলেন আমাদের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান মেজর মঙ কিউ (পরে লে. কর্নেল)। মেজর জিয়াউর রহমান (পরে লে. জেনারেল, বীর-উত্তম, সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি) ছিলেন এ বা আলফা কোম্পানির ‘কোম্পানি কমান্ডার’।
পাকিস্তান ১৯৬৫ সালের আগস্টের প্রথমদিকে ‘বিরোধপূর্ণ’ কাশ্মীরে ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ নামে গোপন সামরিক অভিযান শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান আক্রমণ করলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান তখন কাশ্মীর ফ্রন্টে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়ায় শিয়ালকোট ও লাহোর ফ্রন্টে ভারতীয় আক্রমণ মোকাবিলার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল।
ভারতীয় বাহিনীর লাহোর ফ্রন্টে আক্রমণের প্রস্তুতির বিবেচনায় ১ম বেঙ্গল ৪ সেপ্টেম্বর রাতে লাহোরের প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে কাসুর জেলার বেদিয়ান এলাকায় (খেমকরণ সেক্টর) প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। এ ইউনিটটি ছিল লাহোরের ১১ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন ১০৬ পদাতিক ব্রিগেডের অংশ। ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব থেকে লাহোরে আসার তিনটি রাস্তা বা অ্যাপ্রোচের অন্যতম হলো খেমকরণ-ফিরোজপুর-কাসুর-লাহোর। এ অ্যাপ্রোচটি রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল ১১ পদাতিক ডিভিশন। অন্যদিকে ভারতের ৪ মাউন্টেন ডিভিশন এ অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করছিল।
অধিনায়ক লে. কর্নেল এ টি কে হকের পরিকল্পনায় ব্যাটালিয়নের চারটি রাইফেল কোম্পানি কোনো গভীরতা না রেখে বিস্তৃত এলাকা ধরে বেদিয়ান-ওয়াইজল এলাকায় ‘বিআরবি ক্যানেলের’ (খাল) পশ্চিম তীর বরাবর প্রতিরক্ষা (ডিফেন্স) অবস্থান গ্রহণ করে। বিআরবি ক্যানেলের কয়েকশ গজ আগেই দুদেশের সীমান্ত। ৬ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় ভারতীয় বাহিনী পদাতিক ট্যাংক ও বিমানবাহিনীর সাহায্যপুষ্ট হয়ে ১ম বেঙ্গলের বেদিয়ান হেডওয়ার্কস (ছোট ব্যারাজ) এলাকায় আক্রমণ করে। কিন্তু অতন্দ্রপ্রহরীর মতো প্রতিরক্ষায় অবস্থানরত দুর্ধর্ষ বঙ্গশার্দুলরা ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করে। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা পর অনেক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী পিছু হটে। কয়েক ঘণ্টা বিরতির পর ৬ সেপ্টেম্বর সারাদিন, এমনকি রাত পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী এ ইউনিটের প্রতিরক্ষা এলাকা দখল করতে পুনঃপুন আক্রমণ চালায়। কিন্তু প্রতিবারই তারা যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
১৭ দিনের যুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ের আক্রমণে ব্যর্থতার পরও ভারতীয় বাহিনী এ বাঙালি পল্টনের ওপর আরও কয়েকবার প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু দুর্ধর্ষ বঙ্গশার্দুল বাহিনী প্রতিবারই তাদের প্রতিহত করে পিছু হটিয়ে দেয়। ভারতীয় বাহিনী কখনোই বিআরবি ক্যানেল অতিক্রম করতে পারেনি। এ যুদ্ধে ব্যাটালিয়নের বেশ কয়েকজন সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ১ম বেঙ্গল ১৫টি বীরত্বসূচক খেতাব লাভ করে, যা ছিল পাকিস্তানের সব ইউনিটের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ যুদ্ধে সিপাহি (পরে অনারারি ক্যাপ্টেন) আবুল হাসেম সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ টিজে বা তঘমায়ে জুরাত খেতাব লাভ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য তিনি ‘বীরবিক্রম’ খেতাবপ্রাপ্ত হন।
এ যুদ্ধ নিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পরে লিখেছেন, ‘সে সময়ে আমি ছিলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যার নামে গর্ববোধ করত তেমনি একটা ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার।…খেমকরণ রণাঙ্গনের বেদিয়ানে তখন আমরা যুদ্ধ করছিলাম। সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়ন বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল।…ব্যাটালিয়নের পুরস্কার বিজয়ী কোম্পানি ছিল আমার কোম্পানি।…পাকিস্তানিরা ভাবত বাঙালিরা ভালো সৈনিক নয়। খেমকরণের যুদ্ধে তাদের এই বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।…বাঙালি সৈনিকের বীরত্ব ও দক্ষতার প্রশংসা হয়েছিল তখন বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্রে, উল্লেখ করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম’ (একটি জাতির জন্ম, বিচিত্রা, ২৬ মার্চ, ১৯৭৪)।
এ যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো, মেজর জিয়াউর রহমানের এ কোম্পানি নিজেদের গোলায় বিধ্বস্ত ট্যাংক উদ্ধার করে রণক্ষেত্র থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। বর্তমানে এ ট্যাংকটি চট্টগ্রামস্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে রক্ষিত আছে।
সংখ্যার দিক থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনী এগিয়ে থাকলেও বিমান ও পাইলটের মানের ক্ষেত্রে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এগিয়ে ছিল। এ যুদ্ধে বাঙালি পাইলটরা অসাধারণ দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। স্কোয়াড্রন লিডার এমএম আলম (পরে পাকিস্তানে এয়ার কমোডর) ৭ সেপ্টেম্বর ৫টি ভারতীয় বিমান ধ্বংস করে রীতিমতো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ফ্লাইট লে. সাইফুল আজম (পরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন), স্কোয়াড্রন লিডার গোলাম মোহাম্মদ তাওয়াব (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমানবাহিনীর প্রধান), স্কোয়াড্রন লিডার আলাউদ্দিন আহমেদ, ফ্লাইট লে. এম শওকত উল ইসলাম (পরে গ্রুপ ক্যাপ্টন) ও ফ্লাইট লে. মমতাজ উদ্দিন আহমেদসহ (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমানবাহিনীর প্রধান) বেশ কয়েকজন বাঙালি পাইলট বিমানযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও দক্ষতা দেখিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেন।
এ যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ও ইন্টারেস্টিং একটি বিষয় ছিল যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে উভয় অংশে এক ধরনের ধর্মমিশ্রিত জোশ সৃষ্টি করা হয়। এ প্রসঙ্গে লেখক মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেছেন, ‘কবি-লেখকদের অনেকেই এ সময় পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ উপলক্ষ্যে অজস্র কবিতা, গান, গল্প ও নাটিকা ইত্যাদি রচিত হয়। ছড়ানো হয় নানা গালগল্প’ (স্বাধীনতার পটভূমি, ১৯৬০ দশক)।
পশ্চিম পাকিস্তানি কবি আগা শোরেস কাশ্মীরি এ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীরত্বের প্রশংসা করে কবিতা রচনা করেন। যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। লাহোর রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য এ ব্যাটালিয়নকে তথা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সেই সময়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে দেখা হতো। সে এক অন্য ইতিহাস।
১ম বেঙ্গল ও বিমানবাহিনীর পাইলট ছাড়াও তিন বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্য বিভিন্ন ফ্রন্টে বীরত্ব ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ফলে সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়। এটি বলা যায়, এ মনোবল ও স্পিরিট ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
৬০ বছর আগে সংঘটিত এ যুদ্ধে যেসব বাঙালি অফিসার ও সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। এখন প্রয়োজন হলো এ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের গবেষণাধর্মী, নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস, যেখানে উঠে আসবে এ যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের অসাধারণ বীরত্বের কথা। আমাদের সামরিক ইতিহাসের এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কি কালের গর্ভেই হারিয়ে যাবে?
মো. বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বিশ্লেষক ও গবেষক