পরিবারের সদস্য হিসেবে আহতদের পাশে ছিলেন চিকিৎসকরা

Google Alert – ইউনূস

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪— বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। এতে ৮৪৪ জন শহীদ হন। প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আহত হন, যাদের চোখে-মুখে ছিল দমন-পীড়নের চিহ্ন। সংকটের সেই মুহূর্তে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছিল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট (এনআইও) ও হাসপাতাল অন্যতম।

এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন এক হাজার ৭৪ জন জুলাই আহত। নিজস্ব চিকিৎসকদের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান ও নেপালের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ২১ জনকে সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে পাঠিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

এনআইওর চিকিৎসাসেবা

২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে গণঅভ্যুত্থানে আহত রোগীরা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আসা শুরু করে। সেদিন পাঁচজন আসে। এরপর থেকে প্রতিদিনই গণঅভ্যুত্থানে চক্ষু আহতদের গন্তব্য ছিল হাসপাতালটি। তবে ১৮ থেকে ২১ জুলাই এবং ৪ থেকে ৬ আগস্ট আহতদের চাপ ছিল অস্বাভাবিক।

আরও পড়ুন

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী, সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল, একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর ও সহকারী অধ্যাপক ডা. যাকিয়া সুলতানা নীলার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাসেবা চলে দীর্ঘদিন। হাসপাতালের ১৬২ জন চিকিৎসক, ২০৯ জন নার্স এবং শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মীর অক্লান্ত শ্রমে জুলাই আহতদের বিরতিহীন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষ করে অধ্যাপক ডা. মো. জিন্নুরাইন, সহযোগী অধ্যাপক মেজবাহুল আলম, ডা. শহীদুল ইসলাম ও ডা. মো. হাসানুজ্জান, সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মেহবুব উল কাদির, ডা. শ্যামল কুমার সরকার ও ডা. মাহবুবউল হক সজল, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আব্দুর রশিদ, মেডিকেল অফিসার ডা. তিশাদুর রহমান, ডা. সাজ্জাদ হোসেন, ডা. আব্দুল্লাহ আল আরাফাত, ডা. মেহেদী হাসান, ডা. তাযকিরাতুন নাঈম, ডা. আনিলা আফরিন অস্ত্রোপচার কক্ষে (ওটি) তাদের সারিয়ে তোলার যুদ্ধে ছিলেন অগ্রনায়ক। অনেকের একাধিকসহ মোট আট শতাধিক অস্ত্রোপচার করা হয়। এতে ডা. সঞ্জয় কুমার সরকার এবং ডা. আবিদ মজিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহযোগিতা ছিল উল্লেখযোগ্য।

বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ

গণঅভ্যুত্থানে আহতদের জন্য সারাদেশে সব সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গত ১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যকার্ড বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় অভ্যুত্থানে আহত নরসিংদী ইউনাইটেড কলেজের শিক্ষার্থী ও পুলিশের গুলিতে দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানো ইফাত হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমুর হাতে স্বাস্থ্যকার্ড তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এসময় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী প্রধান উপদেষ্টাকে চিকিৎসা কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। বলেন, ‘এখন পর্যন্ত চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে এক হাজার ৭৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১১ জনের দুই চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে, ২৮ জনের দুই চোখই আক্রান্ত। প্রায় ৪৫০ জনের এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

আরও পড়ুন

তিনি জানান, চোখের ইনজুরির জন্য প্রায় ৬৫০টি অপারেশন করা হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে তিনশ’র বেশি রেটিনা সার্জারি হয়। চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বাইরে দুটো হাসপাতালে ৬০ জন রোগীর অপারেশন হয়েছে। কোনো কোনো রোগীর তৃতীয় ধাপেও অপারেশন প্রয়োজন পড়ছে। এখন পর্যন্ত চীন, ফ্রান্স, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসকরা চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করেছেন এবং যে প্রক্রিয়ায়য় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তাতে চিকিৎসকরা সন্তোষ প্রকাশ করেন।

সেবা সহজীকরণে এনআইডি প্রদান

জুলাই আহত অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না থাকায় নানান ধরনের সেবা প্রদানে সমস্যা হচ্ছিল। যার কারণে হাসপাতাল থেকেই তাদের তথ্য ও বায়োমেট্রিক সংগ্রহ করে এনআইডি করে দেওয়া হয়। ২৮ জানুয়ারি জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসারতদের মধ্যে ৩৬ জনকে নতুন এনআইডি কার্ড দেওয়া হয়ে।

এ সময় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সুফল সবাই ভোগ করছি। আহতদের হাসপাতালে এসে কার্ড তুলে দেওয়া ছিল নৈতিক দায়িত্ব। ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের হাতে এরই মধ্যে ভোটার কার্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ভোটার হালনাগাদের কাজ চলছে।’

মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালা

গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিতে গিয়ে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত ৫৫ তরুণের ওপর গত বছর গবেষণা চালায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। তাদের বেশিরভাগই ২২ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থী, যারা চোখের চিকিৎসায় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি ছিলেন। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল আহত তরুণরা কী মাত্রায় বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও মানসিক চাপে ভুগছেন তা নিরীক্ষা করা।

গবেষণায় দেখা যায়, আহতদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ হালকা থেকে গুরুতর বিষণ্নতায় ভুগছেন এবং তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর স্তরে পৌঁছেছে। দেখা যায়, ৫০ শতাংশেরও বেশি ভুক্তভোগী হালকা থেকে গুরুতর উদ্বেগে ভুগছেন, ২০ শতাংশের বেশি অত্যন্ত গুরুতর উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই করছেন এবং প্রায় ৬০ শতাংশ মানসিক চাপে ভুগছেন।

আরও পড়ুন

জুলাই আহতদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর অরবিস ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ‘দৃষ্টিশক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য’ সম্পর্কিত এক কর্মশালার আয়োজন করে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, জাতীয় স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নেতৃস্থানীয় হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল কর্মশালায় উপস্থিত আহতদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

৭ দেশের বিশেষজ্ঞ এনে চিকিৎসা প্রদান

জুলাই আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান ও নেপালের চিকিৎসকদের এনে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

চীন থেকে আসা নয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে জুলাই আহত ২৯ জনকে চিকিৎসা দেন। চিকিৎসক দলে ছিলেন ডা. হু জিয়ানকুন, ডা. ইয়ান হুই, ডা. লিয়াও দেংবিন, ডা. তাং শিয়ুইয়ান, ডা. ঝৌ ঝোংজি, ডা. ওয়াং ইয়ানইয়াং, ডা. হে মিন, ডা. চেন জুন ও ডং কিয়ান

নেপাল থেকে আসা তিন সদস্যের চিকিৎসক দল ৫ থেকে ৭ অক্টোবর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে জুলাই আহতদের চিকিৎসা দেন। মোট ২৩৪ জনকে তারা চিকিৎসা দেন। এর মধ্যে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ১৭৩ জন ছিলেন। এর মধ্যে চারজনের অপারেশন করেছিলেন তারা।

ফ্রান্স থেকে আসা ভিডিও রেটিনা সার্জন ডা. লরেন্ট ভেলাস্কো ৮ থেকে ১২ অক্টোবর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা দেন। যুক্তরাষ্ট্রের গ্লুকোমা স্পেশালিস্ট ডা. রাশেদ নিজাম ৩০ ডিসেম্বর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা দেন।

গত ১ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল আই হাসপাতালের পাঁচ চিকিৎসক ২৭৮ জন চক্ষু রোগীর চিকিৎসা দেন। এর মধ্যে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞানের ১৪৬ জন এবং বাংলাদেশ আই হাসপাতালের ১৩২ জন জুলাই আহত ছিলেন। চিকিৎসক দলে ছিলেন ডা. ডোনাল্ড ট্যান, ডা. ব্লাঞ্চ লিম, ডা. রোনাল্ড ইয়োহ, ডা. নিকোল ট্যান এবং ডা. রুবেন ফু। তারা আহতদের চোখের অবস্থা মূল্যায়ন করেন এবং ভবিষ্যতের চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেন।

৮ থেকে ১১ মার্চ যুক্তরাজ্যের চিকিৎসক দল চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে জুলাই আহতদের চিকিৎসা দেন। তারা ১১৫ জন রোগী দেখেন। এর মধ্যে ২৩ জনের অস্ত্রোপচার করেন। চিকিৎসক দলে ছিলেন ডা. মাহিউল মুহাম্মদ খান মুকিত ও ডা. মোহাম্মদ নিয়াজ ইসলাম।

২১ আহতকে সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে প্রেরণ

উন্নত চিকিৎসার জন্য ২১ জন জুলাই আহতকে সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে পাঠিয়েও চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনকে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল আই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সাতজনকে তুরস্কের আঙ্কারার এটিলিক সিটি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে আমাদের হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে আহতদের চিকিৎসায় নিরলস শ্রম দিয়েছি। সবাইকে প্রত্যাশিত মানের সেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছে কি না জানি না, আমাদের সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও আমাদের চিকিৎসা বিষয়ে ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় মত দিয়েছে।’

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আহতরা যেমন দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমরাও তাদের সুস্থ করে তোলার জন্য সাধ্যের সবটুকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তাদের কোনো কিছুতেই কমতি করিনি।’

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর ও জুলাই আন্দোলনের আহতদের চিকিৎসা সমন্বয়ক সহকারী অধ্যাপক যাকিয়া সুলতানা নীলা বলেন, ‘আন্দোলনে যেমন তাদের সহযোদ্ধা ছিলাম। চিকিৎসায়ও তাদের সারিয়ে তুলতে দিনরাত শ্রম দিয়েছি আমরা। ওদের নিজের ভাই ও সন্তানের মতোই আমরা দেখেছি। পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের যে কোনো প্রয়োজনে পাশে ছিলাম।’

এসইউজে/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস

Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *