Google Alert – সামরিক
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিকতম উত্তেজনার রেশ কিছুটা প্রশমিত হলেও দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ এখনো চলছে।
গত এপ্রিলে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার পর পাকিস্তানের ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’র বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল ভারত। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ওই উত্তেজনা মুহূর্তেই আন্তর্জাতিক স্তরের নজর কেড়েছিল।
তারপর কয়েক মাস কেটে গেলেও এই নিয়ে আলোচনা পুরোপুরি থামেনি–– তা সে আন্তর্জাতিক স্তরে হোক বা ভারতের ভেতরেই।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চালানো ওই অভিযানের ‘সাফল্য’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার সরকার বেশ সরব। প্রায় প্রতিটা জনসভাতেই প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতৃত্বকে এই বিষয়ে বলতে শোনা গেছে।
আবার এ নিয়ে ‘সাফল্য’ দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তিনি ক্রমাগত দাবি করে চলেছেন, দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্য ‘যুদ্ধ’ তিনিই থামিয়েছেন এবং ওই প্রসঙ্গে ‘ট্রেড টক’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ভারতের পক্ষ থেকে সেই দাবি খারিজ করা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও বিজেপি ‘অস্বস্তি বাড়িয়ে’ একই দাবি করেছেন মি. ট্রাম্প।
অন্যদিকে, পাকিস্তান প্রথম থেকেই একাধিক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি জানিয়ে চলেছে। সেই দাবিও খারিজ করেছে ভারত।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে কিছু জানানো হয়নি। আর দেশের ভেতরে ঠিক এই জায়গাগুলোকেই নিশানা করেছে রাজনৈতিক বিরোধীরা।
যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভূমিকা, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বা ‘অপারেশন সিন্দুরে’ ভারতের কতটা ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে–– সে নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন তুলেছিল বিরোধী দলগুলো। এই একই ইস্যুতে গত কয়েকদিন ধরে উত্তাল লোকসভা ও রাজ্যসভা।
শেষে নরেন্দ্র মোদী নিজেই সেই ‘প্রশ্নমালার’ উত্তর দিয়েছেন মঙ্গলবার এবং যা চলেছে টানা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে। পহেলগাম হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেওয়া সরকারের সিদ্ধান্তকে ভারতের সব রাজনৈতিক দলই সমর্থন করেছিল।
দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক স্তরে যে প্রতিনিধিদের পাঠানো হয়েছিল ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলতে, সেখানেও ভারতের সব রাজনৈতিক দলকেই এক সুরে কথা বলতে শোনা গিয়েছিল।
তবে এখন দেশের ভেতরে অবশ্য ‘অন্য সমীকরণ’ ধরা পড়েছে। প্রথম থেকেই দলগুলো সংসদে এ নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চেয়েছিল। সম্প্রতি সেই পর্ব অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং একে ঘিরেই উত্তাল রাজ্যসভা ও লোকসভা।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান নিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন, তার সূত্র ধরে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, “গতকাল আমি রাজনাথ সিংয়ের ভাষণ শুনছিলাম। উনি বলেছেন যে অপারেশন সিন্দুর রাত একটা বেজে পাঁচ মিনিটে শুরু হয় এবং ২২ মিনিট ধরে চলেছিল।”
“তারপরেই উনি মারাত্মক কথা বলেছেন যে রাত একটা ৩৫ মিনিটে আমরা পাকিস্তানকে জানাই–– অসামরিক ঘাঁটিকে নিশানা করা হয়েছে এবং আমরা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। এই ধরনের কথা বলেছেন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী! অপারেশন সিন্দুরের সময়ই ভারতের ডিজিএমওকে ভারত সরকার বলেছে রাত একটা ৩৫ মিনিটে সংঘর্ষ-বিরতির কথা বলতে…।”
বিজেপির সরাসরি কটাক্ষ করে রাহুল গান্ধী বলেছেন, “আপনারা সরাসরি পাকিস্তানকে আপনাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা জানিয়েছেন। আপনারা লড়াই করতেই চাননি…।”
তার আরও অভিযোগ, এই অভিযানের নেপথ্যে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ ছিল।
তিনি বলেছেন, “সরকারের পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাবমূর্তি রক্ষা করা, কারণ পহেলগামে নিহতদের রক্ত তার হাত লেগে আছে। এস জয়শঙ্কর আমাদের বলেছেন প্রতিটা দেশ পহেলগামের পর সন্ত্রাসের সমালোচনা করেছে, শতভাগ সঠিক। কিন্তু কোনো দেশই পাকিস্তানের নিন্দা করেনি, এর অর্থ কী? বিশ্ব আমাদের পাকিস্তানের সাথে তুলনা করছে।”
যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্তত ২৯ বার দাবি করেছেন- তার কথাতেই সংঘর্ষবিরতি মেনে নেয় ভারত এবং পাকিস্তান। সবসময় ইন্দিরা গান্ধীর আমলের সঙ্গে তুলনা টানা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর পঞ্চাশ শতাংশ দমও যদি প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে থাকে, তাহলে তিনি (নরেন্দ্র মোদী) সংসদে দাঁড়িয়ে বলুন যে ট্রাম্প মিথ্যে কথা বলছেন!”
এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কথাও উল্লেখ করেছেন রাহুল গান্ধী। তিনি বলেছেন, “ওই ব্যক্তি (ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে মধ্যাহ্নভোজ করছেন। ট্রাম্প সব প্রোটোকল ভঙ্গ করছেন এবং সেই ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়ছেন যিনি ভারতে সন্ত্রাসবাদ করেছেন…আর প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদী) কিছুই বলেননি।”
সামরিক অভিযানের সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন রাহুল গান্ধী। অভিযানের তিনি বলেছেন, “আমি সিডিএস জেনারেল অনিল চৌহান জিকে বলতে চাই, আপনি কোনো কৌশলগত ভুল করেননি। ভারতীয় বিমান বাহিনী কোনো ভুল করেনি। ভুলটা করেছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব।”
পাশাপাশি তার অভিযোগ, চীন ও পাকিস্তানকে আলাদা রাখায় ভারতীয় বিদেশ নীতির মূল ভিত্তিই আঘাত পেয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের পাশাপাশি বিরোধীদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের বাজেট বৃদ্ধি থেকে শুরু করে ওই সেক্টরে বিকাশ, আন্তর্জাতিক স্তরে দেশজ প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের চাহিদার বিষয়ে উল্লেখ করেন তিনি।
তারপর নাম না করে বিরোধীদের নিশানা করে বলেন, “জানি না এই সমস্ত দেখেও কারো কারো কেন এমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে যে যেন তাদের সম্পত্তি লুট হয়ে যাচ্ছে।” এরপর তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রসঙ্গ টানেন। নাম না করে নরেন্দ্র মোদী বলেন, “পৃথিবীর কোনো নেতা ভারতকে অপারেশন থামাতে বলেনি।”
তার কথার মাঝেই রাহুল গান্ধীকে বলতে শোনা যায়, “যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অসত্য বলেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত সংসদে স্পষ্ট করে বলা।”
এরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন মোদী। তিনি বলেছেন, “নয়ই মে রাতে মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই সময় আমি সেনাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলাম। পরে যখন আমি ফোন করি, তিনি বলেন পাকিস্তান বড় ধরনের হামলা করতে চলেছে।”
“আমি বলেছিলাম যদি পাকিস্তান সত্যিই হামলা করে তাহলে আমরা আরও বড় প্রত্যাঘাত করে জবাব দেব। গুলির জবাব আমরা গোলায় দেব। এরপর আমরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে তছনছ করে দিয়েছি।”
বিশ্বস্তরে ভারত কতটা সমর্থন পেয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন মোদী। তার কথায়, “জাতিসংঘের ১৯৩টা দেশের মধ্যে মাত্র তিনটে দেশ পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। আমরা বিশ্বের সমর্থন পেয়েছি, কিন্তু এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে কংগ্রেস আমাদের সমর্থন করেনি।”
পাকিস্তানের ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবির প্রসঙ্গে পাল্টা কংগ্রেসকে নিশানা করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “কিছু লোক সেনাবাহিনী যা বলছে তার বদলে পাকিস্তানের ন্যারেটিভকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
পাশাপাশি ভারতীয় সেনা যে পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিল তাও উল্লেখ করেন তিনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘লড়াইয়ে’ বিজেপির ‘সদিচ্ছা’ নিয়ে প্রশ্ন এবং আধঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানকে জানানোর প্রসঙ্গে মোদী বলেছেন, “পাকিস্তান থেকে ইস্যু আমদানি করছে কংগ্রেস।”
প্রধানমন্ত্রী মোদী জানিয়েছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এর যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন, “২২ মিনিটের মধ্যে আমরা ২২ এপ্রিলের হামলার প্রতিশোধ নিয়েছি… পাকিস্তান কিছুই করতে পারেনি।”
“সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, বালাকোটের পর ওরা (কংগ্রেস) খেলার চেষ্টা করেছিল। আর সিন্দুর অভিযানের পর ওরা জিজ্ঞাসা করছে- কেন এটা বন্ধ করে দেওয়া হলো? ওদের আসলে বিরোধিতা করার একটা কারণ দরকার।”
প্রসঙ্গত, পহেলগাম হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার এই প্রশ্নে প্রথম থেকেই মুখর ছিল কংগ্রেসসহ অন্যান্য বিরোধীরা।
এরই মাঝে জম্মু ও কাশ্মীরে গত সোমবার এবং আজ বুধবার ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘অপারেশন মহাদেব’ ও ‘অপারেশন শিবশক্তি’ নামে দুটি অভিযান চালায়। সেনার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এই দুই অভিযানে পাঁচজন ‘সন্ত্রাসীর’ মৃত্যু হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে বলেছিলেন, “অপারেশন মহাদেবে তিনজন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বন্দুক বৈসরণ উপত্যকায় নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।” তার এই দাবির বিরুদ্ধেও অবশ্য প্রশ্ন তুলতে দেখা গিয়েছে বিরোধীদের।
সব প্রশ্নের উত্তর মিলল কি?
সরকারের শীর্ষনেতৃত্বের জবাবে ‘সন্তুষ্ট’ নয় বিরোধীরা। তাদের পাল্টা অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী একবারও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম সরাসরি আনেননি। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সমীকরণের বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। সাম্প্রতিক অভিযানে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জানানো হয়নি।
অন্যদিকে, মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের সভাপতি এবং সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি প্রশ্ন তুলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যদি কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ থাকে, আকাশপথ ব্যবহারে বাধা থাকে তাহলে এশিয়া কাপে সে দেশের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠতে পারে কী করে? সেই প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি। সূত্র: বিবিসি।